আজ আলোচনা করব বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগ নিয়ে । ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কেই মধ্য যুগ বলা হয় । এই সময় কালটা কে অন্ধকার যুগ বলা হয় । কেউ কেউ আবার এই যুগটা কে বাংলা সাহত্যের বন্ধা যুগ বলে মনে করেন। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর “লাল নীল দীপাবলী” গ্রন্থে (পৃ. ১৭) লিখেছেন- “১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোন সাহিত্য কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়না বলে এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এ-সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি।এ- সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।” কিন্তু, ওয়াকিল আহমেদ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ (পৃ. ১০৫)-এ লিখেছেন- “বাংলা সাতিহ্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম -শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মূখ্য কারণ।” সময়ের সাহিত্য নিদর্শন: ১. প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ ২. রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত) ৩. হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত) ৪. ডাক ও খনার বচন । এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য।  ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে পুথিটি প্রকাশিত হয়। যদিও কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’।
কৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত। পুথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির পথ সুগম হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন,
“জয়দেব ও ভারতচন্দ্রকে বাদ দিলে এ ধরণের কাব্য সমগ্র পূর্বভারতেই আর পাওয়া যাবে না।... বোধ হয় সেকালের শ্রোতারা এই পাঁচালি গানে বাস্তবতার সঙ্গে কিছু অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাও লাভ করত। কিন্তু আধুনিক কালের পাঠক এ কাব্যের প্রত্যক্ষ আবরণ অধিকতর আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করবেন। রাধাকৃষ্ণলীলায় কিছু উত্তাপ ছিল, জয়দেবের গীতগোবিন্দে সেই উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, সে উত্তাপ ‘অভিনব জয়দেব’ বিদ্যাপতির পদেও কিছু স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করেছে। ভারতচন্দ্র সেই উত্তাপকে কামনার পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে নর-নারীর প্রণয়চর্চাকে আলোকিত করেছেন। দেহের এই রহস্য চৈতন্য ও উত্তর-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে উত্তাপ হারিয়ে স্থির দীপশিখায় পরিণত হয়েছে।”
চলবে ......।


তথ্য সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া/ উইকিপিডিয়া/