মা মনোমোহিনীদেবী কিশোরীবয়সের হলেও  প্রতিভায় তিনি স্বভাব কবি। মনে মনে একা একা কত ধ্রুপদ সংগীতও গেয়ে উঠতেন! এসব গানও তিনি  নিজের অজান্তেই রচনা করে ফেলতেন। ভাবতে না ভাবতেই কত কবিতার আলোর ঝলক তাঁর অন্তর মাঝে সৃষ্টি হতো- সে  যেন এক ঐশী প্রভা! মনোমোহিনীদেবীর  প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে শিশুর নামকরণ করবেন- ঠিক তখনও একটি কবিতা লিখে চলছেন তিনি; মাত্র চার চরণের একটি অনুকবিতা। অনিন্দ্যসুন্দর এই কবিতার মর্মার্থ! তিনি লিখেছিলেন-
'অকূলে পড়িলে দীনহীন জনে,
নুয়াইও শির কহিও কথা ।
কূল দিতে তারে সেধো প্রাণপণে,
লক্ষ্য করি তার নাশিও ব্যথা।’
কবি-মা মনোমোহিনী দেবী- এই চারটি চরণ লিখেছেন সন্তানের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে। এ চারটি চরণের শুরুর বর্ণ চারটি মিলে তৈরি হলো : অ-নু-কূ-ল। এক ছান্দসিক আদর্শ সন্তানের জীবনে প্রতি পদক্ষেপে বয়ে চলুক সেই প্রত্যাশায়  তিনি সন্তানের নামটিই রেখে দিলেন 'অনুকূল'। 'অনুকূল' যেন কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, একটি কবিতার আদ্যাক্ষরে গড়ে ওঠা এক কবি-মা-র কবিপুত্রের  চেহারার কাঞ্চনজ্যোতি। তাই অনুকূল এক ক্ষণজন্মা কবি।
শিশু অনুকূল একটু বড়ো হলে, স্কুলে যেতে শুরু করল। স্কুলশিক্ষক বালক অনুকূলের প্রজ্ঞাজ্যোতি দেখে ‘শ্রীশ্রীঠাকুর’ উপাধি দিলে, সেই উপাধিই তাঁর নামের সাথে এক চিরায়ত পরিচিতি লাভ করল; আর, নাম হয়ে উঠল- শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র।
এই বিরলপ্রজ কবি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও অস্তিত্বেরই পূর্ণ সাক্ষর। তিনি অপেক্ষাকৃত অশ্রুত কবি মনে হলেও তিনি সাহিত্য পাতায় বিশ্বনন্দিত কবি; জন্মেছিলেন- ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই সেপ্টেম্বরে  অবিভক্ত ভারতের অধুনা পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রামে। রবীন্দ্র-নজরুল-বিভূতি-বন্দে আলি মিঞা তাঁর সাহিত্যে মুগ্ধ ছিলেন। শের এ বাংলা এ.কে. ফজলুল হক শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছ থেকে রাজনৈতিক পরামর্শ গ্রহণ করতেন; যেমনটা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও  শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশে  চলতে পেরে সীমাহীন  তৃপ্তিবোধ করতেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সাহিত্য ও দর্শনের ওপর পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করছেন ড. জীবন চক্রবর্তী ড. রেবতীমেহন বিশ্বাস, ড. আতপেন্দ্র রায়চৌধুরী, ড. রাধাকৃষ্ণ পাল, ড. নিরঞ্জন মিশ্র, ড. কুমার মুখোপাধ্যায়-সহ অনেকই। আমেরিকান সাহিত্যিক মি. হাউজারম্যান শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনী নিয়ে লিখেছেন ‘ওশান অন অ্যা টী-কাপ’।
ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গ-পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত  ‘সৎসঙ্গী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি বন্দে আলি মিঞা।
জীবনবাদের কবি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র স্বাধীনতা-প্রসঙ্গে বহু সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন; যা সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যক্ত করা কষ্টসাধ্য বইকি। কবির ধারণা এই যে, আদর্শিক সেবা যেখানে যত বেশি জাগ্রত, স্বাধীনতা সেখানে তত বেশি সমুন্নত।  তাই  তিনি বললেন-
আদর্শ যেথা অটুট হ'য়ে
সেবায় আনে বর্দ্ধনা,
যুক্ততানে উঠবে সেথায়
স্বাধীনতার  র্মূচ্ছনা। (অনুশ্রুতি- ১ম খণ্ড)


স্বাধীনতা শব্দটির বুৎপত্তি  'স্ব+অধীনতা'র সাথে মিল রেখে তিনি নতুনভাবে শোনালেন সেই চিরায়ত কণ্ঠ- 'স্ব' অর্থাৎ  নিজ থেকে উদ্ভব হওয়া চেতনা।  নিজ কূল বা নিজের জাতীয়তা, নিজের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য শিষ্টভাবে চরিত্রে সেই অনুশীন ধারণ করার মধ্যেই স্বাধীনতার নিগূঢ় সার্থকতা লুকানো রয়েছে।  কবি তাঁর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন-
স্ব-এর উদ্ভব যা' হ'তে তোর
অটুট নিষ্ঠায় বজায় রাখা,
ঠিক জানিস্ তুমি স্বাধীনতা তা'ই
কুল-ঐতিহ্যে বজায় থাকা।
শিষ্টভাবে স্ব-কে ধারণ
পালন-পোষণ রক্ষা করা,
স্বাধীনতার স্বার্থকতা
তাতেই জানিস থাকে ধরা। (অনুশ্রুতি- ৪র্থ খণ্ড)


কবি উচ্ছৃঙ্খল চলা-বলাকে স্বাধীনতা বলেন নি। বাধাহীনভাবে ভালো কিছু করার নামই  স্বাধীনতা,  বাধাহীনভাবে যাচ্ছে করে চলা স্বাধীনতা নয়। তাই তিনি  বললেন-
অবাধে ভাল করতে পারাই
স্বাধীনতা কয়,
উচ্ছৃঙ্খলের প্রশ্রয় পাওয়া
স্বরাজ কিন্তু নয় । (অনুশ্রুতি- ১ম খণ্ড)


কবি মনেপ্রাণে চান-  প্রতিটি ঘরে-ঘরে, নগরে-দেশে-প্রদেশে সবাই আরোতর  সুন্দরে সংবর্ধিত হোক; একজন আরেকজনের জন্য সহনপটুতা নিয়ে প্রীতির চলনে চলুক, সবার জীবনে বয়ে আনুক সমৃদ্ধির সমুত্থান । তাই কবি বললেন-
প্রতি ঘরে-ঘরে প্রতিটি নগরে
প্রদেশ-দেশের সঙ্গতি,
স্বস্থ সম্বর্দ্ধনী নিয়মনে চ'লে
রাখুক অটুট সংস্থিতি ;
সবাই সবা'র বান্ধব হো'ক্
স্বস্তি-ঋদ্ধির ঊর্জ্জনায়,
ক্লেশসুখপ্রিয় হউক সবাই
স্বতঃ সুদীপনী নন্দনায় ;
বাঁচাবাড়া  হো’ক্ সবার প্রকৃতি
স্বতঃস্বস্থ নিয়মনায়,
স্বাধীনতা হো’ক্ অটুট বিশাল
প্রতিটি ব্যক্তির সাধনায় ৷ ( অনুশ্রুতি- ৪র্থ খণ্ড)


তাই, আসুন আমরা বিশুদ্ধ স্বাধীনতাবোধে জাগ্রত হই।আর, সচেষ্ট হই অনুকূলসাহিত্য পাঠে ও প্রকাশে।