চোখ জুড়ানো মন ভোলানো ওই সুন্দর পাহাড়-টিলা। সারি সারি চা-বগান যেন এক অপরূপ অমরার শোভা! পাহাড়-টিলা-হাওড়-বন এই নিয়েই তো হবিগঞ্জ জেলা; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এমন প্রকৃতির কোলে প্রকৃতজনেরাও জন্ম নেন পৃথিবীকে আরোতর সৌন্দর্যমন্ডিত করবার জন্য।  কবি লিখে যান প্রকৃতির নেশা নিয়ে –
“বন্ধুর পথ ধরে এসে দেখি
অচলা, বিরহ-কাঁদনে পাগলপারা,
কলকল স্রোতস্বিনী ঝরনাধারা,
তৃষিত তনুমনে,  জলের নাচনে
ভাসিয়ে আপনারে
স্নাত ক্ষণে ক্ষণে।” (আবর্তিত ছায়াবৃত্ত, পৃষ্ঠা : ৫৩)
এমন দারুণ কাব্যজ্যোতিতে হবিগঞ্জে যিনি জন্মগ্রহণ করেন তাঁর নাম কামাল আহমেদ। জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি।  হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রাজার বাজারের আশ্রাফপুর গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ মহসিন মিয়া ও মায়ের নাম আকারুন নাহার। মহসিন মিয়ার অনেক বড়ো পরিবার। কবি কামাল আহমেদেরা চোদ্দো ভাইবোন। এদের মধ্যে  কামাল মা-বাবার নবম সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই ধী-শক্তির প্রকাশ পায় তাঁর। তিনি যখন  অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখনই তাঁর কাব্যপ্রতিভার প্রকাশ পায়। ভাষা দিবস উপলক্ষে উন্মোচিত করে একটি দে’য়াল-পত্রিকা। কবির কিশোর বয়সে একটি কবিতা ওখানে স্থান পায়। তার পর কবির লেখালেখির গতি আরোতর বেড়ে যায়। কবির লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে।
এই কাব্যসাধনায় গুরুদায়িত্ব পালন করেন কবির প্রিয় শিক্ষক প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাধেশ্যাম মজুমদার। আরও  সাহায্য করেন কবির বড়ো ভাই মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান।
কবি ইতোমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে, উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন সরকারি বৃন্দাবন কলেজে। এ-পর্যায়ে  এসে কবির কাব্যশক্তি আরও শাণিত হয়ে উঠেছে। এভাবে লেখালেখি চলমান থাকায় দিনে দিনে একজন অগ্রণী লেখক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে অক্টোবর  মাসে সিলেটের ‘যুগভেরী’ পত্রিকায় কামাল আহমেদের প্রবন্ধ : ‘দিব্যকান্তিতে এসো’ প্রকাশিত হয়। তার পর থেকে  তিনি নিয়মিতভাবে সমকালীন পত্রিকাগুলোতে উপসম্পাদকীয় ও সাহিত্যপাতায়  লিখে এসছেন।
২০১৬ সালে কবি কামাল আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আবর্তিত ছায়াবৃত্ত’ প্রকাশিত। তার পর প্রকাশিত হয় ‘প্রহসনে প্রণয় দুর্গ’। এ ছাড়া  ‘ছোটদের গল্পকথা’, ‘চুনারুঘাটের ইতিহাস’,  ‘সাড়ে সাতশ বছরে চুনারুঘাটের কীর্তিমান’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চুনারুঘাট’ প্রভৃতি অপ্রকাশিত গ্রন্থ ।
কবি কমাল আহমেদ ‘আমাদের গল্পকথা’র  ‘সাহিত্যসম্মাননা-২০১৬’ ও ‘বাসাসপ সাহিত্যসম্মাননা-২০১৭’ লাভ করেন।
কবির নিজ রাড়িতে প্রকৃতির শোভিত অঙ্গনে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সাহিত্য আড্ডা।  ‘আম্রকুঞ্জ’ নামকরণ করা হয় তার; দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিক অতিথি হিসেবে আসেন কবির বাড়িতে। আবৃত্তিতে আলোচনায় জমে ওঠে আড্ডা! স্ত্রী নিলুফা ইয়াছমিনের আতিথ্যপরায়নাতায় কখনোই যেন কোনও ত্রুটি থাকে না ।  তিনি স্বামীর সাহিত্যসাধনাকে সানন্দে সমর্থন করেন সবসময়।  কবি কামাল আহমেদের কাব্যপ্রবাহের একটিই লক্ষ্য – পৃথিবীতে আসুক মানবতার স্বর্গীয় আলো।
কবি কামাল আহমেদে লেখালেখি করেন মূলত মানবিকতারই নেশায়। তিনি দেশ ও জাতির জন্য রেখে যেতে চান : এক সত্তামুখী  শিক্ষা। এ-শিক্ষার নেশা তাঁর যেন স্বভাবজাত। কবি তাঁর কর্মজীবন হিসেবে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
কবি তাঁর কবিতায় জরা-মৃত্যু-ব্যধি থকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। শোনান এক জীবনসংগীত : ও পথে আর আসবো না গো,/ এ ঘাটে নাও বাইবো না গো,/ অন্য ঘাটে চল রে এবার/ অন্য ঘাটে চল/। কবি আবার কখনও প্রকৃতির প্রেমে মাতোয়ারা হতেন। শিশিরের শাদা ধোঁয়ায় মন ভাসিয়ে দিতেন। রাতের শিশির দেখে তৈরি হতো কবিতার মন। লিখে যেতেন কবি – “গোধূলি হওয়ায় শিশিরকণা/ ধোঁয়া, ধুলো উড়ে যায়, / ভেসে যায় পথে পথে কাশবনে/ শারদীয় সন্ধ্যায়। ” আবার কখনও আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হন। জীবনের অন্তিমসময়ে কথা ভাবতে ভাবতে আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। নিজেকে মনে হয় পথ পথিক! নিজের অজান্তেই স্রষ্টার প্রতি আকুল প্রাণে ভক্তি জেগে ওঠে! কবিতায়ও তার প্রকাশ ফুটে ওঠে অমিয় ছন্দে ও শব্দে। ‘পথহারা’ কবিতায় তিনি লিখলেন – “ও কাণ্ডারী,  অথৈ নদী দেব পাড়ি,/ কে হবে গো পথের দিশারি।”/ কবি সুন্দর করে নিষ্কলুষ প্রার্থনা জানালেন কবিতার মাধ্যমে। তিনি লিখলেন – “… করো দয়া স্বামী, পথহারা দীনজনে,/ কে বলো আর পথ দেখাবে তুমি বিনে?/ কালো চোখে আলো দিলে পাড়ে যেতে পারি।/”
  জীবনবোধের এই প্রখ্যাত কবি আরোতর সমুত্থিত হোক। বাংলা সাহিত্যকে জীবননীয় প্রবাহে ভরিয়ে দিবেন এ আমাদের তৃষিত অনুভব!