আর একমুঠ ভাত দিবি মা-রে
পান্তা ভাত বেশিক্ষণ পেটে থাকে না মা
এক বোঝা ক্ষ্যাপ মারলেই শেষ
মাজায় বল পাই না!


সালেহা চোখের জল মুছে
তাদের দুজন (মা-মেয়ের) জন্য রাখা ভাত থেকে
আরও কিছু ভাত তুলে দেয় পাতে
রমজান নুন দিয়ে কচলাইয়া গিলে নেয়।


সালেহা চোখবুলায় হারানো দিনের পাতায়-
এইতো বছর দুই হবে রাক্ষুসী পদ্মা কোনো জানান না দিয়ে
হঠাৎ তাদের সাজানো সুখের সংসার ভিটেমাটি
সবটুকু গিলে নেয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে ছেলেমেয়ে দুটো নিয়ে
শূন্য হাতে খোলামাঠে ঠাঁই নেয়, উদবাস্তু!


তিনদিনে পুরো এক গ্রাম গিলে মিটেনি গাঙ্গের ক্ষুধা
সরকারী ত্রাণতহবিল থেকে কিছু শুকনা খাবার, পানি
মাথা গোঁজার জন্য তাবু কম্বল আর কিছু টাকা দিয়েছেন।
হাজার হাজার লোকের চাহিদা কতোদিন মিটাবে?


সালেহার স্বামী মেরাজ মিঞার কোনো ভিটেমাটি নাই
সর্বহারা আর দশজনের মতন তারা চলে আসে ঢাকার শহরে
ঠাঁই নেয় সবাই মিলে বস্তিতে। বাঁচার নতুন সংগ্রামে প্রত্যয়ী!
দিনমজুরের কাজ মিলে যায় দালান বানানো প্রতিষ্ঠানে
বেশ চলছিল। বিধিবাম একদিন ছাদ ধ্বসে অনেক শ্রমিক
মারা যায়, মরেনা মেরাজ, মাজা ভেঙ্গে পঙ্গুহাসপাতালে ঠাঁই।
কোম্পানির খরচেই চিকিৎসা, মাসখানেক পরে বাসায়।
মুখ আর পেট বেঁচে আছে সোজাহয়ে দাঁড়ানোর শক্তি শেষ।
কোম্পানির লোকজন ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা
গুঁজে দিয়েযায় সালেহার হাতে। তার বুকে কোনো ব্যথা নাই
সে কাঁদে না শুধু চোখ দুটো লাল চুনীপাথর হয়ে গেছে।


অচল স্বামীর সেবাযন্তে কোনো ত্রুটি নাই শক্ত হাতে
বুকে জড়িয়ে এপাশ ওপাশ শোয়ায় তবুও শেষ রক্ষা
হয়নি, মেরাজের শরীরে পচনধরে। তিন মাসের মাথায়
মেরাজ পালায় অচল খাঁচাটা ফেলে রেখে, সাপের মতন
ঠাণ্ডা শরীরটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে সালেহা!


তিন দিন তিন রাত বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে গাছের মতন
যখন মনে হলো সে এখন পাথরের মতো শক্ত, ক্ষুধা-কষ্ট অনুভূতি
ভোতা হয়ে গেছে; ছেলে-মেয়ে দুটো বুকে জড়িয়ে নিয়ে থাকল
নির্বাক নির্ঘুম। মনে পড়ে- মেরাজের বুকে নীরবে তার চোখের জল
যখন ঝরতো, পরম আদরে তার স্বামী মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো-
'বউ মনটারে শক্ত বানিয়ে ফেল সন্তান দুটোকে আগলে রাখিস'!


জমানো টাকা শেষের পথে, তার কিছু রোজগার করা দরকার
মাজেদা খালার হাত ধরে এক বাসায় ঝি এর কাজ নেয়
ছেলে মেয়ে দুটো স্কুলে পাঠায় নিয়মিত। কোথাও ঝি এর কাজ
বেশি দিন করতে পারে না, সব বাড়ির পুরুষ গুলো ভাদ্র মাসের
কুত্তার মতন হয়ে ওঠে এমনকি বস্তির মাস্তান পুরুষগুলান।
শেষবার যে বাড়ির কাজ ছাড়ে সেইদিন বাড়ির জোয়ান পোলা
পাকের ঘরে আতকা তারে জাপটে ধরে, ধস্তাধস্তি করে নিজেকে
মুক্ত করে হাতে মাছকাটা বঁটি তুলে নিয়ে কোপিত চাপাস্বরে বলে আর
এক পা যদি এদিকে আসো কোপাইয়া টুকরা টুকরা বানামু; যা ভাগ!
ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে বাড়িওয়ালীকে বলে-
খালাআম্মা আমি আর কাজ করুম না ইচ্ছে হইলে বেতনের
টাকাটা দিয়ে দেন না দিলে না দেন। ভদ্রমহিলা আগেই সব
দেখেছেন তাই চুপচাপ বেতনের পুরো টাকাটা ওর হাতে দেন।
ঐদিনই ওই টাকা দিয়ে কামারের দোকান থেকে একটা
ধারালো রাম-দা কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে আর কোনো দিন কাজে যায়নি।
রাম-দাকে বালিশের পাশে নিয়ে স্বামীর মতন রক্ষাকবচ বানিয়ে ঘুমায়...


রমজানের বয়স ১১, স্কুল ছেড়ে কাওরান বাজারে মিনতির (মজুর) কাজ করে
মা আর মেয়ে কাগজের ঠোঙ্গা বানায়, এইভাবে কাটে সালেহার দিনকাল...