বিক্ষিপ্ত গোলাকার পাথরের গায়ে
হ্রদের জলের প্রতিফলনে সূর্যের রং
যেখান টোল খেয়ে যায়;
যেখানে গ্রানাইট পাঁথর খাঁড়ার মতো
কেটে দেয় জল, পাহাড়ের উন্মুক্ত বিদারণে...
সেখানে ধূসর মসৃণ পাথরের আবছায়ে
বিশ্রাম নেয় আমার শারীরিক অবক্ষয়।


আমার শ্রান্ত বিশ্রামের পাশে
ছায়াঘেরা চিক্‌চিকে স্রোতে বয়ে যায়
সেঞ্চল হ্রদ... দু'পারে জন্মানো পাহাড়,  
তারই কোলে স্নেহভরে সেঞ্চলের নীল জলে
প্রথা ভেঙ্গে ভেসে ওঠা কিছু নাম না জানা অর্কিড,  
আর দুপারে আরামোরা ভেঙে জেগে ওঠা
আনকোরা বনভূমি; সমবেত কলতানে তারা
রোধ করে যায় আমার নিরন্তর অবক্ষয়।


তাই এই পাহাড়ের পাদদেশে,
সেঞ্চল জলসীমা ছুঁয়ে যাওয়া বনভূমিতে,  
দ্বীপপুঞ্জের জমাট ব্যাথা নিয়ে  
আজও স্বপ্নে জেগে ওঠে
নীল জলে স্নাত আমার শান্ত কবর...
কুয়াশা ছায়াঘেরা উপসাগরের
রুপালি বালিয়াড়ির সমুদ্র সৈকতে।  


এই ক্রোমেলক কার পূর্ণতা বয়ে নিয়ে চলে আজও?
এই বনসম্পদ, পাহাড়!
নাকি সে যোদ্ধার, যে বুড়ো পাইনের গায়ে
খোদাই করে দিয়েছিলো তার উল্লাস!
তবুও, আমার অনতিদূরেই পাইন কাঠের মন্দিরে বসে
মন্ত্রোচ্চারণ করে চলে সে খোদিত জয়গান যে পুরোহিত,  
সে কি নবী, ঋষি নাকি জাদুকর...
তার পূর্ণতাও এই ক্রোমেলকে ম্লান!

তারাদের উত্থানে সূর্যাস্তের দিনের বেগুনি ফুল জেগে থাকে না,
ভোর হয়ে যায় পাহাড় থেকে চাঁদ ঝরে পরায়,
এ সকাল পাঠে আঁকা নয়...  
উভচর, জলচর, খেচরের এই সেঞ্চল হ্রদে  
ছদ্মবেশে নিস্তেজ বাদামী ভাল্লুকের
কোমল আদুরে লোমশ আস্তানা
ঘিরে রাখে আমার এ ক্রোমেলক।
প্রলুব্ধের জন্য প্রেমময় বন হিংস্র উপযোগিতায়!


যে দাঁড়িয়ে আছে বহুদূরে তার জন্যে
সগোত্রে পাহাড় ও গাছের আনন্দ ছিল মুঠোবন্দী ...
প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বিস্ময়গুলোতে
বেগুনি পর্বত বারেবার কাকে চেয়ে ফিরে যায়...
যদিও উঁচু শৃঙ্গে আরোহণ আজ অনুচিত...


এই শিবিরে মধ্যরাতে পায়ে পায়ে হেঁটে আসে
চাঁদ ও নক্ষত্র থেকে চুরি করা শীত তবুও;
প্রকাশ করে দূরবর্তী যা কিছু অস্পষ্ট ,
এই জৈবিক শৈত্যে নিয়তি  
ভেবেছিলো কি একবারও ঈশ্বরের কথা? কে জানে...


চামড়া আর বাকলের বহুমুল্য রাষ্ট্রতান্ত্রিক পোশাকে
ভীত নেকড়ে ও ঈগলের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভাসে আজও,  
সে মরদেহের রহস্যে কি কোনও বিলাপ ছিল কোনওদিনও?
সে আর্তনাদ এখনও কি ভাষা পেতে পারে!
এখানে কোলাহলে নীল জয়ধ্বনি জেগে ওঠে,  
ছায়াঘেরা সেঞ্চলের ঢেউ লাগা বুকের নীচে
সোচ্চারে মিথ্যা বলে চলে সে এক অন্য পুরুষ;  
তার পদমর্যাদা, নাম কিম্বা আড়ম্বর ঘুমোয় কবরের গনতন্ত্রে।


তোমার নীল ঠোঁট খুলে দাও সেঞ্চল,
ছুঁয়ে দাও গ্রানাইটের শ্যাওলা পাঁজর শিলা,
ভেঙে যাক ক্রোমেলকের নীরবতা,
বুড়ো পাইন গাছ তুমি গল্প বল আবার...  
কথা বল বুড়ো পাইন, বুড়ো ওক, বলো কখন, কিভাবে
মৃত্যু হয় সে পরাক্রমী পুরুষদের রাজার... আমার!


"সেঞ্চলের নীল জলে, ধূসর মসৃণ পাথরের আবছায়া থেকে
পাথরের সে রাজ অঙ্গুরীয় আজ খুঁজে বেড়ানো বৃথা!  
ভেঙে যাওয়া হাড়ের অনুসন্ধান বৃথা...  
গভীরতম রহস্যের শব্দহীন প্রাচীন নীরবতা দুঃখজনক, লজ্জার"...
নতমস্তকে বলে গেলো পাইন-ওকের বুড়োটে নৈশব্দ।  


মাটির সাথে মাটি ধীরে ধীরে, দিনে দিনে মিশে যায় নামহীন, পরিচয়হীন...  
কিন্তু কোথাও এখনও সেই মানবিক শক্তির সুসজ্জিত আলো
চালিত করে মহাবিশ্বকে, তাই আজও কোথাও বেঁচে আছে সে...  
সেই অন্ধকার আত্মা শুভ কিছুর জন্যে কোথাও, স্থির।  


সে আত্মার অন্ধকার রাশিফলে কোনও তারকাখোচিত চিহ্ন নেই;
তবুও যে অদৃশ্য প্রতিকূলতায় সে ক্রোমেলকে ফোটে রডোডেন্ড্রন,
সে কার বেশি করুণার?... ঈশ্বরের, নাকি প্রকৃতির?  


এমনই ভাবছিলাম বসে গ্রীষ্মের সে সন্ধ্যায় সেঞ্চলের কোলে...
এ ঘন জঙ্গলে, লুকোনো সাগরে, আর পাহাড় রহস্যে
মনে হয়েছিলো এ দমবন্ধ করা পৃথিবী অবলুপ্ত...
যেন এক বিশ্রামহীন বিরতি, প্রার্থনার আগে !


তাদেরই জন্য এ প্রার্থনা, যারা বিশ্রাম করে
পৃথিবীর উন্মুক্ত স্তনের উপরে...
ধর্মাশ্ব দৌড়ের মাঠে, বা লুকানো শিলা-গুহায় বা পিরামিডে...
যারা ঘুমায়, যারা বেঁচে থাকে তাদের মতো করে
'ক্ষমা করো' এই প্রার্থনার প্রয়োজন হতে পারে।


হাঁটু-গভীর ধূলিকণায় ভ্রমণকারী মরুযাত্রীদল
চেয়ে দ্যাখো, চারিপাশে জনবহুল সমাধি...
ক্ষয়াটে হাড়ের স্তূপে মোড়ানো সমুদ্র তল...
আরও দ্যাখো চেয়ে যুদ্ধ পরিখাগুলোয়
বিরাজমান আদি অন্ত শুধু শূন্যতা স্তূপীকৃত... 
এরা সবাই চায় একান্তভাবে সেঞ্চলের স্নিগ্ধতা!


প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তারও পরে প্রজন্ম ;
তার প্রাচীনতায় বাজে নি কোনও গির্জার ঘণ্টা,  
পরেনি আজান, শুধু নেত্রহীন শিবের অন্ধ চক্ষু উত্তোলনে
ধর্ম যুদ্ধের বেহিসেবি ক্ষয় লেখা হয়
আকাশের নীরবতায় তামাদি খতিয়ানে, আমার ক্রোমেলকে...
অজস্র মৃত মানুষের জন্যে আমার আত্মা অস্থির।  


এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না সেই সব নীরব আমন্ত্রক,  
খুঁজে পাওয়া যায় না সেই সব ভুতুরে রণাঙ্গন,  
বা তাদের, যারা নেতৃত্বে ছিল বর্ণিল স্বপ্নগুলো
মৃতদের ফ্যকাসে সাদা ক্র্যাভাটে ফুটিয়ে তোলার...
এ যেন এক অপার রহস্য আগলে রেখেছে বুকে
এই কুহকিনী, কুয়াশা ছুঁয়ে দেওয়া মায়াবিনী নীল সেঞ্চল !  


তারপর... উষ্ণ আকাশ গড়ে তুলতে ঝুঁকে পড়ে
সেঞ্চলের জলে দ্বিগুণ সূর্যাস্ত, আমি অনেক ওপর থেকে দেখেছি
সে আলোর জাঁকজমক, সে যেন আমার আত্মার চুরি যাওয়া উত্তরের মতো ...


যে সামান্য বিশ্বাসে কি বলছে পাহাড়, বনভূমি, তুমি শোনো...  
তুমি শোনো গাছগুলো কী বলে ফিসফিস করে কানে কানে,  
সেই সামান্য বিস্বাসের জন্যে তাঁকে বিশ্বাস করো, যত্ন নাও সে ঐশ্বরিকের...
জেনো, তোমার দৃষ্টির ম্লানতা তাঁর জন্যে তাঁরই সন্দেহ !


রাতের মতো যেখানে পরে থাকে রোদ্দুর সীমাহীন,  
সেখানে শক্তিশালী কারাগারে মলিন অথচ
জ্বলন্ত স্ব-জালে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যথাদের বসবাস ...
সেখানেও তাঁর অন্ধ অপেক্ষার শুরু আছে শুধু, শেষ নেই !  


হস্তান্তরিত ঘৃণা দিয়ে নয়, প্রেমের অনন্ত প্রবাহের তাড়নায়
আত্মার প্রতিটি শৃঙ্খল চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়
নামাজের শেষ নিঃশ্বাসে, আর দরজা খুলে দেয়  
অনুতাপকারীর আগুনের আকাঙ্খা...  


তবুও তোমার প্রেম এই কারাগার ছুঁতে চায়..  
শব্দের যে গভীরতা ছুঁয়ে দাও তুমি হে ঈশ্বর
তোমার ত্রিশূলের, তোমার ক্রুশের পতনে...  
সে গভীরতর অতল গহবরের চেয়েও।  


তাই যারা ঘুমোয় সম-বিশ্বাসে তারা ভালো থাকে;  
তোমাকে নিয়ে, তোমার গাছগাছালি, পাখপখালির সাথে।
শোনো মনোরম সেঞ্চল নীল জলরাশি...  
তোমার শীতল ছায়ায় আমার দেশের ঘাসজমি
আমার কবরে আজও আরাম দেয়,
তাই ফুটে ওঠে আমার বুকে রডোডেন্ড্রন,  
তাঁর সেই অতল গভীর সুরের থেকে...  
যেমন করে তৈরি হয় বহু ওপরে  
ছন্দে ছন্দ বেঁধে গিয়ে সর্ব শক্তিমানের প্রেমের বলয় বৃত্ত।  


প্রশ্ন ওঠে জেগে কাকচক্ষু হ্রদের দৃষ্টিতে মৃদুস্বরে,
এই প্রকৃতি যা কিছু রেখেছে আগলে নিজ নেমি মাঝে ...
সে তার স্রস্টার মুচলেকা; কেন বৃথা সেখানে করা নাড়া?
এ নিরন্তর হেঁটে যাওয়া, এক অমীমাংসিত রহস্য আজও... অনুদ্ঘাটিত...  
এক ধোঁয়াশা দেওয়াল পেরিয়ে এখানে
স্বপ্নেরা মারা যায়, দরজা খোলার শব্দহীন অপেক্ষায়।  


হতাশায় ঘুরে বেড়ানো মরু যাত্রীরা শুধু উত্তর দেয়...  
নিজের ন্যায্য সৌন্দর্যের চেয়ে
গানের ধর্ম যদি গায়কেই বেছে নেয়;  
তাহলে ব্যবহারের মিলের মাঝে নয়,
অজুহাতে, ভিক্ষায় বা অবসরেও নয়...  
শুধু নমনীয় অনুশাসনের আন্তরিকতায়
সেই সুরও গোধুলির শেষ রঙের ধুসরতায়
ছড়িয়ে দিতে পারে বায়ুমণ্ডলে সাতরঙা রামধনু রঙ।  


"কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে মিলিয়ে যায় সে বিশ্বাস"।
তাই তো সে গৌরবময় পিতৃত্বে স্বর্গের অধিকার মাত্র ...
আর পৃথিবীতে যা কিছু সবই শাশ্বত মঙ্গলের জন্য।
আমাদের ইচ্ছে শক্তির মুক্ত উত্তরাধিকারে
সমগ্র পৃথিবীতে বয়ে চলে দুঃখের খরস্রোত।
তাঁর সেই অন্তিম দিন জানি নিখুঁত ছায়াহীন,  
তবুও ভালবাসায় যত্নশীল।


এমনই অন্তর্মুখী দোটানায়
সাহসের সাথে স্বীকৃত ভয়ে বিবেক চালিত হয়,
আর মানুষের চিরন্তন মহাকাব্য
কবির মিস্টি স্বপ্নের বাগানে কখনও
ফুল হয়ে ফুটে উঠে ফুল হয়ে ঝড়ে পড়ে যায়।


সেঞ্চলের ঢেউয়ের দীর্ঘ ধোঁয়ার উপর
লাল, হলুদ, সবুজ ও নীলের আকরিক বাতিঘর...    
যেন সাদা ফেনা ফেনা পুষ্পস্তবকের মধ্যে দিয়ে
বয়ে যাওয়া কিছু আগাছার জট !


এমনই সকল পার্থিব অপার্থিবের মাঝখানে
সে দরজা খুলে দাঁড়ালো এসে ধীরে, এলোচুলে ...
কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর উপসাগরীয় হাওয়া করজোড়ে
আমার ক্রোমেলকে হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনায়...  
উড়ে যায় চৈত্রের ঝড়ে রাষ্ট্রীয় জাহাজ,  
ভিড়ে ঠাসা পালে ভেসে যায় নাবিকের হাল,  
উড়ে এসে বাগানের সন্ধ্যার বাতাসে
ফিস্‌ফিস্‌ করে কথা কয় খড়কুটো, ধ্বংসস্তূপ...  
আর আমি যা কিছু শুনি হৃদয় দিয়ে সব
তা সমুদ্রের শব্দে হতেই পারে কোনও গোলাপের পরাজয়।


তাই আজও বিক্ষিপ্ত গোলাকার পাথরের গায়ে
আমার শ্রান্ত বিশ্রামের পাশে
ছায়াঘেরা চিক্‌চিকে স্রোতে বয়ে যায়
সেঞ্চল হ্রদ...
আর সেখানেই সে গোলাপ কখনও
মহাকাব্যের মতো কবির মিস্টি স্বপ্নের বাগানে বারেবারে
ফুল হয়ে ফুটে উঠে ফুল হয়ে ঝড়ে পড়ে যায়।