বিষাদ সিন্ধু বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় এক কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম। শতবর্ষেরও অধিককাল পূর্বে প্রকাশিত এই উপন্যাস এখনও বাংলা ভাষা সাহিত্য পিপাসুদের কাছে এক অনুপম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর  মধ্যে “বিষাদসিন্ধু’ নিঃসন্দেহে অন্যতম।
‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থটি তিন খন্ডে সম্পন্ন- প্রথম খন্ড ‘মহরম পর্ব’ (১৮৮৫), দ্বিতীয় খন্ড ‘ উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), তৃতীয় খন্ড ‘এজিদ বধন’ (১৮৯০) হিজরি ৬১ সালের মহরম মাসে সংঘটিত কারবালার মর্মন্তুদ কাহিনী অবলম্বনে রচিত বিষাদসিন্ধু উপন্যাস। কাহিনী উৎস যা-ই হোক, ইতিহাসের সত্যকে মহাকাব্যিক বিশালয়তায় রূপদান করার মধ্যেই ব্যতিক্রমী শিল্প চেতনার পরিচয় পরিস্ফুট। ‘বিষাদ সিন্ধু’র মতো একটি কালজয়ী উপন্যাস সৃষ্টি করতে সাহিত্য প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রেখেছেন যিনি তিনি হলেন- মীর মশাররফ হোসেন। বাংলা গদ্যসাহিত্যের একজন পথ প্রদর্শক। যাকে উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবেও ভাবা হয়। সেই মহান সাহিত্যিকের জীবনী লিখেছেন, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। আর তিনি স্বয়ং মীর মশাররফ হোসেনকে বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সাথে তুলনা করা অসঙ্গত নয় বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সেই অমর সাহিত্যিক ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন মাইল পূর্বে গড়াই নদীর তীরের লাহিনী পাড়া গ্রামের এক ধনাঢ্য জমিদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও গৃহিনী দৌলতন নেছার সংসারে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেনের পূর্ব পুরুষ সৈয়দ সা’দুল­াহ। তিনি ইরাকের বাগদাদ থেকে প্রথমে দিল্লি এসে মোগল সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। ইংরেজদের আগমনের পর মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সা’দুল­াহ পালিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরে চলে আসেন। তার চরিত্রমাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে ফরিদপুর জেলার স্যাকরা গ্রামের এক বনেদি ব্রা²ণ পরিবার ইসলাম কবুল করেন। তিনি ব্রা²ন কন্যাকে বিয়ে করে পদমদী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার দাদা মীর ইব্রাহীম হোসেনের পিতা মীর উমর দরাজকে ব্রিটিশ সরকার এলাকার জমিদারি ও পিতা মীর মোয়াজ্জাম হোসেন জমিদারি তদারকির সুবিধার্থে কুষ্টিয়ার লাহিনী পাড়া গ্রামে বসবাস করেন। যখন মীর মশাররফ হোসেনের চার বছর চার মাস বয়স তখন তার নিজ বাড়িতে পড়ালেখার হাতেখড়ি দেন মুন্সি জমীর উদ্দিন। মজার ব্যাপার হলো মশাররফের পিতাও পড়ালেখঅর হাতেখড়ি নেন মুন্সি জমির উদ্দিনের কাছ থেকে। ১৪ বছর বয়সে মশাররফ তার মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুরপর কিছুদিন তাঁর পড়ালেখা বন্ধ থাকে। তিনি এ সময় তার বাবার সাথে ফরদপুরের পদমদী বরিশালের বামনা, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। তার বাবার ঢাকা থেকে ফিরে কুষ্টিয়ার ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দেন। এছাড়াও তিনি পদমদী ও কৃষ্ণনগরে লেখাপড়া করেছেন। সে সময় ভারত জুড়ে বাল্যবিবাহের ছড়াছড়ি। আর এর ¯^ীকারও হোন মীর মশাররফ হোসেন। কলকাতা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পড়াশোনার সুবিধার্থে তার বাবার বন্ধু নাজির আহমদের বাড়িতেই থাকেন। নাজির আহমদের ছিল দু’কন্যা। বড় মেয়ে লতিফন ছিলেন সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। মশাররফ হোসেন তাকে পছন্দ করেন। ১৮৬৫ সালের ১৯ মে মীর মশাররফ হোসেন বিয়ে করেন। বিন্তু পছন্দের মেয়েকে তিনি বিয়ে করতে পারেননি। নাজির আহমদের ভুলের কারণে তার বড় মেয়ে লতিফনের বদলে আজিজনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় লতিফনও মশাররফ উভয় কষ্ট পান। কষ্ট সইতে না পেরে লতিফন মারা যায়। এতে করে মশাররফের মন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে পড়াশোনায় আর মনোনিবেশ করতে পারেনি। আজিজনের সঙ্গে বিয়ে সুখের হয়নি বিধায় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কুলসুম বিবি নামে এক বিধবাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিয়ের তিনি বাড়ি ছেড়ে এসে ফরিদপুরের জমিদারের অধীনে চাকুরি নেন। ১৮৮৪ সালে তিনি টাঙ্গাইলেরর দেলদুয়ার আসেন। দেলদুয়ারে এসে দেখে তা ভাগ হয়ে গেছে পরে কুরিমুন্নেসার জমিদারিতে ব্যবস্থাপক পদে চাকুরি নেন। পাশাপাশি তিনি লেখালিখিতে আত্মনিয়োগ করেন। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক, প্রহসন, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন বেশ দীর্ঘদিন জড়িত। সে সময় কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হতো ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি পত্রিকা। এ পত্রিকার সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার মশারররফকে খুব স্নেহ করতেন। তার প্রেরণায় মশাররফ ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় লিখতেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত কলকাতার ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার কুষ্টিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তৎকালীন কলকাতার বাবুদের ভিড়ে মীর মশাররফ হোসেন প্রথম বাংলা গদ্যসাহিত্যিক হিসেবে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। বাবুরা বলাবলি শুরু করেন। মুসলমানদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশুদ্ধ বাংলা চর্চা করেছেন। তিনি তার প্রথম স্ত্রী আজিজুন নেসার সাথে মিল রেখে মাসিক ‘ আজিজন নেহার, (১৮৭৪) নামে একটি পত্রিকা এবং পাক্ষিক‘ হিতকরী’ (১৮৯০) পত্রিকা নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করতেন। তিনি পত্রিকা দু’টির সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন।
তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘রত্মাবতী,(১৮৬৯), প্রথম গ্রন্থ, এ গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হল ‘ধন বড় না বিদ্যা বড়’। এরপর ‘বসন্ত কুমারী’ (১৮৭৩) মশাররফ হোসেন রচিত একটি বিখ্যাত নাটক। ‘এর উপায় কি’ (১৮৭৫) প্রহসনটিতে মীর মশাররফ উনিশ শতকে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের উচ্ছৃক্সখলতা ব্যঙ্গ আকারে তুলে ধরেছেন। ‘মৌলুদ শরীফ’ (১৮৯৪) গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে রচিত বিখ্যাত ‘জমিদার দর্পন (১৮৭৩) নাটকটিতে তিনি অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদাররা কিভাবে প্রজাদের শোষন করতো তা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ‘ আমার জীবনী (১৮৭৩) মীর মশাররফ শাসকদের প্রকৃত রূপ উন্মোচনের লাবণ্যে ‘বেহুলা গীতাভিনয়’ সৃষ্টি করেন। মীর মশাররফ হোসেন মূলত তার লেখনীর মাঝে ইসলাম ও মুসলমানদের কথাই বেশী তুলে ধরেছেন। এ জন্য তার লেখা মুসলিম জাতির কাছে সমাধৃত হয়ে আছে। এছাড়া ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), গাজী মিয়ার বস্তানী ‘এসলামের জয়’ (১৯০৮) উলে­খযোগ্য। গদ্য,পদ্য,নাটক, উপন্যাস মিলে মীর মশাররফ হোসেন প্রায় ৩৭ খানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখনীর ধারা এতই ভাল ছিল তখনকার। অনেক বিখ্যাত হিন্দু লেখকও তাঁর মতো লিখতে ব্যর্থ হয়েছে। বাঙ্গালি মুসলমানদের সাহিত্য জগতে প্রাণের সঞ্চার জাগান মীর মশাররফ হোসেন। এ সাহিত্যিক ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পদমদী গ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে তার প্রিয়তমা স্ত্রী বিবি কুলসুমের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে কোন কোন জীবনী লেখক মীর মশাররফ হোসেনের মৃত্যুকাল ১৯১২ সালের কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষকগণ মনে করেন, ডিসেম্বর বছরের শেষ হওয়ায় এ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।