জুরান পোদ্দার। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারা
একটু কার্টুন কার্টুন হাবভাব। নিরীহ ভদ্র ছেলে।
বয়স তার খুব বেশি হলে পয়ত্রিশ বছর হবে।
সে একজন সোনার দোকানে সোনারুর কাজ করে
তার ঘর পরিবার চালায়।


একটু বোকা বোকা টাইপের তার হাবভাব।
সে কিন্তু পরম বিশ্বাসী ও দায়িত্ববান সৎ চরিত্রের একজন নিপাট ভদ্র ছেলে
হলেও সারা দিন দোকানের মালকিনের ধমক খেতেই থাকে।  
মালকিন তার খারাপ নয় কিন্তু কথায় কথায়
ধমক দেওয়াই তার স্বভাব।


জুরান পোদ্দার বছর বিশেক মালিক যখন বেঁচে ছিল সে তখন থেকেই
এই একই দোকানেই কাজ করে চলেছে।
বাড়ি মালিকের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না হলেও
ওই দিনে একবার যায় আবার ফিরে আসে।
রাত্রে প্রায়শই মালিকের বাড়িতেই থাকে।


আসলে অত বড় তিনতলা বাড়িতে শুধু মালকিন আর তার ছেলে থাকে।
তার উপর দোকানে অত সোনা রুপার অলঙ্কার।
রাত বিরাতে তাই তারা ভয় পায় আর সেজন্য
জুরান পোদ্দারকে রাতে রেখে দেয় তাদের বাড়িতে।


তার বউ মালকিনকে খুব শ্রদ্ধা করে তাই সে তেমন আপত্তি জানায় না তাতে।
আসলে এত পুরাতন কর্মচারী সে
যেন এই বাড়িরই একজন সদস্য হয়ে গেছে।
মালকিন তার উপর রাগ করলে, ধমক তমক করলেও
অন্তরে তার জন্য অনেক দয়া, মায়া আছে তার।


জুরান পোদ্দার মালকিন কে দিদি ডাকে সম্বোধন করে।  
ঘরে মাঝে মধ্যেই বউ এর হাতে মার খাওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
মালকিন ও মাঝে মধ্যে দু-চার থাপ্পর মেরে দেয়।
এ সবে তার কিছুই যায় আসে না ,
সে নির্বিকার থাকে। কিন্তু দোষ তার একটাই।


মাঝে মধ্যে মদ খেয়ে ফেলে প্রচুর আর মদ খেলেই সে লোক চিনতে ভুল করে।
মা কে বলে মাসি আর বউকে বলে শাশুমা আর তার ভাবভঙ্গি
আর কথাবার্তা ঠিক রাজা মহারাজাদের মতো হয়ে যায়।
এই তো সেদিন, বেশিদিন হয় নাই।
নেশা করে ঘরে ফিরে বউকে মা মা সম্বোধন করলে
বউ তাকে লাঠি দিয়ে আচ্ছামত ঠেঙ্গানি দিয়েছিল।
তার এই ব্যবহারে সবাই তখন অতিষ্ট হয়ে ওঠে।
মালকিনের অনেক ধমক তমক তাকে শুনতে হয় ঠিক এই কারণেই।


যাই হোক সেদিন জুরান পোদ্দার মালিকের বাড়িতেই রাতে ছিল।
হটাৎ করে জুরান পোদ্দার দোকান বন্ধ করবার পর কোথা থেকে
মদ্য গিলে ফেলে  ধুন্ধুমার কান্ড বাঁধিয়ে দেয় মালিকের বাড়িতেই।
মালিকের বাড়িতে সেদিন মালিকের বোন জামাই এসেছিল অন্য শহর থেকে।
জুরান পোদ্দার মালিকের বোনকে বলতে শুরু করে,
শুনেন মাসিমা আমি হইলাম গিয়ে এই দোকানের মালিক।
আমি মালিক। এই বাড়ির আমি মালিক।
মালকিনের ত্রিশ বছরের বোন তার কাছে তখন মাসিমা লাগছে! সে তো তাজ্জব।


ঢুলুঢুলু চোখে জুরান পোদ্দার তাকে জড়ানো সুরে বলে,
মাসিমা আমি একটা নাচ দেখাই আপনাকে,
আমি-আ-আমি দারুন নাচতে পারি মাসিমা।
মালিকের বোন জোরে জোরে ডাক দেয় দিদিকে।
মালকিন তখন রান্নাঘরে রান্না করছিল।
ওখান থেকেই সে চিৎকার করে বলে, কী রে সীমা, কী হয়েছে।
সীমা বলে দেখনা তোর দোকানের ছেলেটা নেশা খেয়ে কী রকম করছে,
আমাকে মাসিমা বলছে।


মালকিন রান্নাবান্না ছেড়ে আসেন আর চিৎকার করে বলেন ,
জুরান তুই আবার মদ খেয়ে এসেছিস। দাঁড়া তোকে মজা দেখাচ্ছি।
সেদিন এতগুলা থাপ্পরের কথা এত তাড়িতাড়ি ভুলে গেলি।
দাঁড়া ব্যাটা আজকে তোকে মেরেই ফেলবো।
মালকিন কোথা থেকে একটা লাঠি নিয়ে এসে জুরান পোদ্দারকে ইচ্ছেমত পেটাতে থাকে।


জুরান পোদ্দারের নেশা ছুটে যায়, ও মা গো,
ও বাবা গো বলে চিৎকার করতে থাকে।
লাঠির বাড়ি আর থামে না।
জুরান পোদ্দার মালকিনের দুই পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,
আর মাইরেন না দিদি, আর মাইরেন না আমাকে।
আমি আর কোনদিন মদ খাব না।


মালকিন একটু থামলে জুরান পোদ্দার বলে, খাব না কী, ছুঁবই না আমি।
আমি মদের গন্ধ পাইলেই অনেক দূরে ভাগবো।
আরো দুই বাড়ি দিয়ে মালকিন বলে কান ধরে উঠবস কর একশো বার
আর বলতে থাকবি, আমি আর মদ ছুঁব না, আমি আর মদ ছুঁব না।


জুরান পোদ্দার কান ধরে উঠবস করতে থাকে আর বলতে থাকে
এক, দুই তিন চার। মালকিন আবার এক বাড়ি দিয়ে বলে
ওই তোকে আমি এক দুই গুনতে বলছি??
জুরান পোদ্দার বলে , না না ভুল হয়ে গেছে।


এবার ঠিক বলতেছি বলে জুরান পোদ্দার বলতে থাকে ,
আমি আর মদ ছুঁব না , আমি আর মদ ছুঁ-ছুঁব না, আমি আর ছুঁ-ছুঁব না।
মালকিন আবার এক বাড়ি দিয়ে বলে
ওই তোকে শুধু মুখ দিয়ে বলতে বলছি আমি?
আরো এক ঘা লাগায় মালকিন। উ মা! করে গোঙানি দেয় জুরান পোদ্দার।
এবার উঠবস শুরু করে আর বলতে থাকে আমি আর ছুঁবো না,
আমি না, আমি না, আমি ছুঁ ছুঁ করতে করতে
সেখানেই নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে।


যাই হোক, মালকিনের ছেলে তার পা টেনে টেনে  
ঘরের বাইরে গ্রিল ঘেরা বারান্দায় নিয়ে রেখে
তারা রাতের খাওয়া খেয়ে শুয়ে পরে।


পরদিন সকালে জুরান পোদ্দারের সারা শরীরে বেদম ব্যথা।
সকালেও মালকিনের একপ্রস্থ গালমন্দ শোনে জুরান পোদ্দার।
ব্যথা শরীর নিয়েই সারাদিন কাজ করে।
এইভাবে দিন কয়েক কেটে গেলে তার শরীরের ব্যথাও কমে যায়।
জুরান পোদ্দার মালকিন কে বলে
আমাকে মার দিয়ে খুব ভাল করছেন।


আমি আর কোনদিন নেশাই করবো না। মালকিন বলে ভালো। এইবার তো ছেড়ে দিলাম আবার যদি কোনদিন খাস তো এবার তোকে মেরেই ফেলবো। জুরান পোদ্দার বলে, হ্যা, মাইরেই ফেলবেন একেবারে। তারপর ই কৌতুক করে বলে , আমি তো আর কোন দিন মদ খাবই না, মারবেন কেমন করে। দিন দশেক পরের ঘটনা। মালকিন সন্ধ্যা বেলায় কোন কাজে বাইরে গেছে। জুরান পোদ্দারকে বলে গেছে সময় মত দোকান বন্ধ করে বাড়িতেই থাকতে। জুরান পোদ্দার ঠিন নয়টার সময় দোকানও বন্ধ করে দিয়েছিল। রাত দশ টার দিকে মালকিন ও তার ছেলে বাজার থেকে ফিরে দোতলায় উঠতেই জুরান পোদ্দার তাদেরকে দেখতেই বলে ওঠে, এই এই, ও মাসিমা আমাদের বাড়িতে ক্যান ঢুকছেন?? যান যান বাইরে বেরিয়ে যান এক্ষুনি।
যা বোঝার তা তো মালকিন বুঝেই নিয়েছেন ততক্ষণে। তিনি তার ছেলে কে বলেন , যা তো বাবু ওকে নিচে নামিয়ে বাড়ির বাইরে ছেড়ে আয়। দরজাটা ভালো করে ভিতর থেকে লাগিয়ে দিবি। ব্যাটা আজকে সারারাত মশার কামড়ই খাক। বলেই মালকিন হতাশ ভাবে স্বগতোক্তি করেন, "কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা।এত্ত মারলাম ছেলেটাকে সেদিন তাও ব্যাটা আবার মদ গিলে নিল”.