শুরু করা যাক হঠাৎ চোখে পড়া একালের কোনো কবিতার দু'একটি লাইন দিয়ে যেখানে ছন্দ বা মিল সেভাবে নেই।
"নীলাঞ্জনা তো রাজ নন্দিনী।
সে তো এমন নীরব থাকতে পারে না।
আসলে ভালোবাসায় এমন নীরবতা
এমন উন্নাসিকতা এমন উপেক্ষা বড্ড বেমানান"
হয়তো কারো বেশ লাগছে, কারো বা লাগছে না। কিন্তু যে লিখেছে তার নিজের হিসেবে এটা নিশ্চয়ই খুব আকর্ষণীয় কবিতা। এখন একটু ভাবা যাক যে ছন্দ মিল বর্জিত হওয়ায় কতটা ভালো হল বা হল না।
যে লিখল তার তো সুবিধা হলই। ছন্দ মিল মাত্রা এসব নিয়ে ভাবতেই হল না। নিজের মনের ভাবনাটা প্রায় গদ্যের মতো ক'রে ব'লে দেওয়া গেল। এখনকার অনেক কবি বলবে বেশ সুবিধাই তো হল। ছন্দ মিল নিয়ে অযথা বিব্রত হতে হল না অথচ কী সুন্দর কবিতা হয়ে গেল। কিন্তু এতে সত্যি কি কবির কোনো উপকার হল বা কবিতার কোনো উৎকর্ষ সাধিত হল? এই উত্তর দেওয়া বেশ মুশকিল এবং যে উত্তরই দেওয়া হোক, বিতর্ক এড়ানো যাবে না। কিন্তু একথা বলা যায় যে তাৎক্ষণিকভাবে কারো ভালো লাগলেও এই লাইনগুলি কারো দীর্ঘ দিন মনে থাকবে না।
এবার একটা পুরনো কবিতায় আসি।
"কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী।" কারো ছন্দের প্রতি অনীহা থাকলেও এই প্রকাশ ভঙ্গির আবেদন সে অস্বীকার করতে পারবে ব'লে মনে হয় না। কিন্তু একই কথা এভাবেও বলা যেতে পারত -
কারার ঐ লোহার দুয়ার ভেঙে ফেল কর রে বিলীন রক্তে রাঙা শিকল পূজার পাষাণবেদী।
এবার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক, আগের মতোই ভালো লাগছে না মন্দ লাগছে তার বিচারের ভার। এবার একটু ভাবা যাক নজরুলকে কি অনেক কসরত ক'রে অনেক সময় ব্যয় করে কবিতাটি লিখতে হয়েছিল? তবে আর অত বড় কবিতা বা গানটি সৃষ্টি হত না। লেখাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছন্দ মিলের সহযোগেই বেরিয়ে এসেছিল কবির লেখনী থেকে।
আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
সমুখে ঐ হেরি পথ, আমার কি রথ পৌঁছোবে না তোমার দ্বারে!
এটা এমনও লেখা যেতে পারত -
সমুখের রাস্তা ধ'রে আমার রথ কি পৌঁছোবে না তোমার দ্বারে!
ভালো লাগার পরিমান কুমল কিনা তা আর স্পষ্ট ক'রে বলার প্রয়োজন নেই।
এখন ভাবার কথা হচ্ছে, কবিতায় ছন্দ মিলের উপযোগিতা আছে কি নেই? থাকলে কতটুকু। এ নিয়ে অনেক কবির অনেক মত। তাই অসংখ্য মানুষের প্রিয় একটা কবিতা বা গানকে অবলম্বন ক'রে ব্যাপারটাকে আর একটু ভাবানোর চেষ্টা করি। ঐ যে বিখ্যাত লেখাটি


জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে  ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে,
জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে।
আমার অনাগত   আমার অনাহত
তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা--
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥


যেটা শুনলে এখনো অসংখ্য বাঙালির হৃদয়ের বেদনার ভার নিশ্চিতভাবে লাঘব হয়। সেটিকে মিল ছন্দ বর্জন ক'রে এভাবেও লেখা যেতে পারে। রবি ঠাকুরের লেখাটি অপ্রকাশিত থাকলে এই লেখাটিই হয়তো একটি ভালো কবিতার শিরোপা পেয়ে যেত।


যত পুজো এ জীবনে
হয়নি সমাপ্ত করা
তাও কিন্তু সম্পূর্ণ যায়নি বিফলে।
ফোটার আগেই ঝ'রে গেছে যে ফুল
মরুভূমিতেই হারিয়ে গেল যে নদীর ধারা,
ব্যর্থ নয় তাও পুরোপুরি।
যা কিছু আমার জীবনে
ঘটতে বাকি রয়ে গেল হে করুণাময়
তা-ও মিথ্যে হয়ে যায়নি একেবারে।
যে সম্ভাবনা দেখা দেয়নি সত্যি হয়ে
যা রয়ে গেল কেবলই পবিত্রতার কল্পনায়
তাও বেজে চলেছে প্রভু
শুনতে না পাওয়া সঙ্গীতের মতো
তোমারই বীণা তারে।


আর বেশি কিছু আজকের মতো বলতে চাই না। শুধু বলব একালের এক বিখ্যাত কবির একটি বিশিষ্ট কবিতা অনেকের নজরে পড়েছে হয়তো বা।


আমাদের স্তিমিত চোখের সামনে
আজ তোমার আবির্ভাব হল।
স্বপ্নের মতো চোখ, সুন্দর, শুভ্র বুক
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভীক আভাস
আমাদের কলুষিত দেহে
আমাদের দুর্বল ভীরু অন্তরে।
সে উজ্জ্বল বাসনা যেন তীক্ষ্ম প্রহার।


এটিকে ছন্দ মিল সহ লিখতে পারলে কেমন হতে পারত তা দেখানোর চেষ্টা করা খুবই কঠিন কাজ এবং অনুচিতও। কারণ যে কবিতা যেভাবে বিখ্যাত হয়ে গেছে তাকে সেভাবে থাকতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।


উপসংহারে বলতে চাই জোর ক'রে ছন্দ মিল প্রয়োগ করতে গেলে কিন্তু তা আদৌ ভালো কবিতা হয়ে উঠবে না। চর্চায় এবং চেষ্টায় যখন ছন্দ মিল কবির সহজাত ক্ষমতায় পরিণত হবে তখনই ছন্দ মিলের কবিতা "কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ" হবে।
তা না হলে যেমন চলছে চলুক। জোড় ক'রে মিল ছন্দ চাপানোর চেষ্টা করার চেয়ে আধুনিক গদ্য কবিতাই ভালো। তবে "হঠাৎ দেখা" বা "কলকাতার যিশু" লিখে ফেলা কিন্তু খুবই মুশকিল।