রাস্তার কান্না দেখেছো কখনো?
ফুলতলি থেকে শিকারপুরের মেঠোপথের দীর্ঘশ্বাস?
গাঁয়ের মানুষের চেনা পায়ের ছন্দকাতর পথ
বিহবল হয়ে পড়েছিল বিষন্নতায়
এক নির্যাতিত কিশোরীর বিভ্রান্ত অচেনা পদশব্দে।
সেই সাফিয়া, সেই ঝরাফুলের গল্প বলছি;
তারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে এই পথেই
নরক খুলে দেয়া উন্মত্ততা চোখে-মুখে নিয়ে।
তারা তাকে ছেড়েও দিয়েছিল এই পথে
গাঁয়ের মানুষের কাছে তাদের বর্বরতার স্মারক।
মৃতপ্রায় কিশোরী তাদের উল্লাসের দাবী
আর সইতে পারতো না।
বিরু বৈরাগীর ভিটা থেকে দাঁড়িয়ে সারা জীবন
এই পথের দিকেই বোবা হয়ে থাকতো তার দৃষ্টি।
এই পথ থেকে খুলে গিয়েছিল নরকের পথগুলি
সেই নরক শেষ হয়নি জীবনের শেষ দিনেও।


সেদিনের কান্না ছিল অপার্থিব
কেউ কোনদিন শুনেনি এমন মর্মভেদী বিলাপ
এই পথে বিধবা হয়ে ফেরা কোন মেয়ের কণ্ঠে নয়
মৃতের জন্য মাতমকারীদের কণ্ঠেও নয়
সেই কান্নায় ঝরে পড়েছিল দু'ধারের সব রাধাচূড়া।
উড়তে ভুলে যাওয়া বলাকার দল দেখে
সুতিয়া খালে জমে গিয়েছিল সব বৈঠাধরা হাত।
কেউ আসেনি তাকে ঈগলের ছোবল থেকে বাঁচাতে
ভীতু গেঁয়ো মুখগুলো শিখেছে শুধু আশংকায় নত হতে
তারপর কলঙ্কের তাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে।


জীবনের প্রথম উর্দি দেখেছিল সে
উর্দির ভিতর মানুষ থাকে না তাও দেখেছিল
রাক্ষসরা ঠাকুরমার ঝুলিতে থাকে না তাও বুঝেছিল।
চৌদ্দ বছরের কিশোরী, চোখ ভরা রাজ্যের উচ্ছলতা
সেই চোখটা হয়ে গেলো ম্রিয়মান, অপমানিত।
তেরটা দিনের ব্যবধানে যেন হাজার দিবস পেরিয়ে গেল
সেই কৈশোর আর ফিরে এল না।


তারপর নিজের গ্রামটিই হয়ে গেলো আরেকটি ক্যাম্প
গায়ের সমাজপতিরা ভুলে গেল যুদ্ধের গন্ধ
তারা ছিল উর্দিহীন কিন্তু বিবেকের দংশনহীন;
একটি ফুলের নেতিয়ে যাওয়া ছবি
তাদের দুয়ারে তৈরি করে নি কোন মায়ার প্রতিবিম্ব।
গাঁয়ের উঠোনে নারীর মর্যাদার বিচারদন্ডে
সাফিয়া ছিল লোকচক্ষুর কপটতায় বন্দী।
বিষন্ন এক দেয়াল ঝুলে থাকত চারপাশের বাতাসে
যেখানে তার স্বাধীনতাগুলো ছিল কুণ্ঠিত।
পশুরা ছুঁয়ে দিলে শুধু নারীত্বের অধিকারই নয়
বন্দি হয়ে যায় চোখ, মুখ, কান, দেমাগের অধিকার।
তাদের কাছে গল্পটি ছিল দুর্বিনীত তরুণীর প্রায়শ্চিত্ত
তার দুর্বিনীত পায়ের আঘাতে উড়া ধুলো
ঘৃণায় মলিন করে দিয়েছে নিন্দুকের স্মৃতিকোঠা।


যদি রাস্তার নয়নতারার ঝোপগুলোয় কথা ফুটত
ন্যাড়া গাছগুলোয় ইশারা ফুটে উঠত
কোন এক অর্বাচীন কবি হয়তো লিখত
বিভৎস্য তেরো দিনের পান্ডুলিপি।
যুদ্ধের এই ফ্রন্ট ভুলে যেতে পারতো না উত্তর প্রজন্ম।
এই প্রজন্ম তাকে দেখেছিল লঙ্ঘিত শরীর আগলে হাঁটতে
ছিন্ন কাপড়ের নির্যাতিত নারী পার হতে পারে নি
গাঁয়ের সম্ভ্রমের সংস্কার।


তার হৃদয় দুয়ারে আঘাত করার মত কেউ ছিল না
কেউ ছিল না পাঁচ গাঁয়ে তার পাণি প্রার্থনার
জানালায় তার পড়ন্ত সূর্যের লজ্জা এসে উঁকি দিত
আর দখিনা বাতাস নিংড়ে দিত সব শূণ্যতা।
চারপাশের করুণার চোখগুলোকে
সে ঘৃণা করত উর্দিওয়ালাদের চেয়ে বেশি।
কেউ কেউ শরীর লঙ্ঘন করতে চাইত
সম্ভ্রমহীন শরীর রাস্তায় ফোটা ফুলের মতো সহজ।


রাতের পাঁজরে পাঁজরে খেলে বেড়াত রাক্ষসের হাত
স্মৃতি দাবিয়ে দিত আরো কোন অন্ধকার কোটরে।
কত রাতের নিনাদ বালিশে গিয়েছে মিশে
কত অনুযোগ ফিরে এসেছে শূণ্য বাতাসে।
চারপাশে লঙ্ঘিত সম্ভ্রমের গল্পকথায়
হাজার বার যেন ছিঁড়ে যায় সম্ভ্রমের পোশাক।
অবিচারের যাতনা তাকে দিয়েছে গভীর অন্তর্মুখ
মৃত অগ্নিগিরির জ্বালামুখের উৎসের মত।


ঘুনপোকার মত মগজ খেয়ে যায় সমাজের ফিসফিসানি
প্রতি দংশনে সে শুনতে পেত সেই নরকের নিশ্বাসগুলো
তাই সে মুক্তি চাইত মগজের কলকল শব্দ থেকে।
সাফিয়া বেঁচে ফিরেছিল ৭১ এর বৈশাখে
বিশটি বছর অনেক ছিন্নপত্রের বেদনা জড়ো হল
সমাজের চোখে সাফিয়া মরে গিয়েছিল ৭১ এর বৈশাখে।


দেশের জন্যই ছিল সে বিসর্জিত
পরিবার তাকে ত্যাগ করেছিল ভীষণ লজ্জায়
সমাজ তাকে ত্যাগ করেছিল বোঝা হিসেবে
দেশ কখনো তাকে নিয়ে ভাবতেই শিখেনি।
তার যুদ্ধকে সে বয়ে এনেছে একা
তার যুদ্ধ থামবার ছিল না।
চৌদ্দ বছরের সুন্দর স্বপ্নগুলো
ভেঙে যাওয়ার যুদ্ধ কখনো থামবার ছিল না।
দেশের জন্য বিসর্জনের যুদ্ধ
কখনো থামবার ছিল না।
আজও মন খারাপ করা দুপুরে
গায়ের নারীদের বৈঠকে বেঁচে থাকে সাফিয়া
বৈরাগীর ভিটায় প্রতিবাদী চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাফিয়া।