১৯৭১ সালের মার্চের তপ্ত দুপুর। বসন্তের কোকিলটা শিমুলের মগডালে বসে বিদায়ী সুরের শেষ তানটা বাজিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণা বাতাসে গাছের পাতারা নেচে নেচে পাখির গানের সাথে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। বাঁশ ঝাড়ের ঘন ঝোঁপে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকের মাঝেই দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। গেল নির্বাচনে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠীর নির্মম পরাজয়ের পর ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের টাল বাহনা দেশে এ অস্থির অবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবরের সাথে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠী আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আলোচনার ফলাফল কি হবে বলা যাচ্ছে না। মকসুদ বসে বসে বিষয়গুলো ভাবছিল। দেশের অবস্থা নিয়ে সে খুব ই চিন্তিত। মকসুদের চিন্তার আরেকটি কারণ হল কিছুদিন পর তার বিয়ে। অনেকটা হুটহাট করে ই বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। মকসুদ অবশ্য বিয়েতে রাজি ছিলনা কিন্তু মায়ের এক কথা আমি একা আর এই সংসারের ঘানি টানতে পারব না। কি আর করা তাকে নিমরাজী হতেই হল।
আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ হবে রেসকোর্স ময়দানে। এলাকার অনেকেই ঢাকা গিয়েছে ভাষণ শোনতে। মকসুদের সে সুযোগ নেই। মা কিছু দিন যাবত অসুস্থ । এ এলাকায় একটি রেডিও আছে পারুলদের বাড়িতে। কিন্তু তাদের বাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে? পারুলের সাথে মকসুদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, এখন হুট করে তার বাড়িতে গেলে সবাই কি ভাববে? মকসুদ চিন্তায় পড়ে যায়। কি করা যায়? ওদিকে আজকের ভাষণ ও তো শোনা দরকার। বিষয়টা বন্ধু বদরুলকে জানায় সে। আরে এইডা কোন বিষয় হইল, রেডিও থাকব অগো উঠানে, কত মানুষ রাইতে উঠানে বইসা থাকব. হের ভিতর এক কোণায় আমরা থাকলে কে দেখব। বিষয়টা মন্দ কস নাই।
পারুলদের বাড়ির বিরাট উঠানটা কানায় কানায় পূর্ণ। একটি উচু টেবিলের উপর রেডিওটি রাখা। টেবিলের নিচে বিশাল সাইজের ব্যাটারী। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে রেডিওর গান শোনছে। রেডিও কাজী নজরুলের কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি বাজছে। সবার শিরায় শিরায় সেই গানের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। মকসুদ ও বদরুল উঠানের এক কোণায় বসেছে। ভাবী কুটুম বাড়ীতে এই ভাবে চোরের মত বসে আছে বিষয়টি ভাবতেই লজ্জা লাগছে তাঁদের। মকসুদ বদরুলকে তাড়া দেয়, কিরে ভাষণ কখন শুরু হইব। এইতো বেশিক্ষণ লাগব না। কছ কি সেই কখন থেইক্যা বইসা রইছি, পারুলগো বাড়ির কেউ দেখলে কি মনে করব ক দি। মনে করার কি আছে, জামাই বইলা কথা! তোর মাথা। এখন শোনবেন শেখ মজিবুর রহমানের ধারণকৃত ভাষণের অংশবিশেষ। তাদের কথার মাঝেই ঘোষণাটা আসে। পিন পতন নিরবতা। কোন এক মন্ত্রবলে সবাই চুপ হয়ে গেছে। সবাই শুনে চলছে এক অবিসংবাদিত নেতার ঝংকার পূর্ণ বক্তৃতা। প্রত্যেকের চেহেরায় ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা। এ যেন বক্তৃতা নয় কোন এক বিল্পবী কবির বাণি। সবার শেষে যখন ঘোষণা এল এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তখন কেউ আর স্থির থাকতে পারল না। জয়বাংলা স্লোগানে কেঁপে উঠে পুরো বাড়ি। মকসুদ আর বদরুল ও চিত্কার করছে। তারা মনে হয় একটা ঘোরের মধ্য আছে।
মুকসেদ ঠিক কতক্ষণ স্লোগান দিয়েছিল তা তার খেয়াল নেই। হঠাত্ পিছন থেকে কারো ডাকে সে সম্বিত ফিরে পায়। কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। মুকসেদের বিষয়টা তাই হল। পিছনে পারুলের ছোট ভাই রাসেল। সে একপাটি দাঁত বের করে বল্ল, দুলা ভাই কুনসুম আইলেন। মুকসেদ লা জবাব। মূহুর্তে বিষয়টা অন্দর মহলে ছড়িয়ে গেল। পারুলের বাপকে দেখা গেল। তা বাবাজি কহন আসলা। বাইরে কেন, ঘরে আইসা বহ। মুকসেদ আপত্তি জানায় কিন্তু ধোপে টিকেনা। তাদের বসানো হয় বারান্দার একটা চকিতে। তা বাবাজি একটু দেখা করলেওতো পারতা। মুকসেদ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মা পারু মেহমান লইগ্যা খাওন নিয়া আহো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চুড়ির শব্দ শোনা যায়। পর্দার ফাঁকগলে যেন এক টুকরো পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায়। মুকসেদ কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলে। বে রসিক বদরুল নিদারুণ চিমটি ও বেহিসেবী কাশিতে চাঁদমূখ মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়।
মুজিব ইয়াহিয়ার সংলাপ ভেঙে গেছে। চারদিকে গোমট পরিবেশ। মনে হচ্ছে বিশাল এক মেঘ যেন যেকোন সময় ঝর বইয়ে দেবার অপেক্ষায় বসে আছে। ঢাকার রাস্তার পাক সেনাদের আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চারদিকে অদ্ভুত নিরবতা। যেন সুনামী শুরু হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি! মুকসেদদের গায়ে অবশ্য বিষয়টা এত গভীরভাবে আঁচ করা যাচ্ছে না তবে একটা বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়টা তারাও আঁচ করতে পারছে। মাঝ রাতে বদরুলের চাঁপা কন্ঠে মুকসেদের ঘুম ভেঙে যায়। মুকসেদ এই মুকসেদ। কিরে এতো রাইতে তুই, ঘটনা কি? বাইরে আয়, খারাপ খবর আছে। খারাপ খবর! মুকসেদ দরছা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। কি অইছে? পাকিস্থানী মিলিটারীরা ঢাকা শহর আক্রমণ করছে, হাজার হাজার মানুষ মারতাছে কুত্তার বাচ্চারা। কস কি? মুকসেদের চোখে অবিশ্বাসের ছাপ। অবস্থা খুবই ভয়াবহ, একটু আগে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করছে। মুকসেদ ভয় পেয়ে যায়। ভয় পাইলে চলব না চল মাদবর বাড়ি সবাই বইসা আছে, কি করন যায় পরামর্শ করন দরকার।
২৬ শে মার্চ। সবাই পারুলদের বাড়িতে রেডিও নিয়ে বসে আছে। মুকসেদ আর বদরুল ও এসেছে। আজ তাদের লজ্জা করছে না। পৃথিবীর রোমান্টিসিজম আজ মুকসেদ কে নাড়া দিচ্ছেনা। চারদিকে লাশের খবরের মাঝে এ সব বিষয় তুচ্ছ মনে হচ্ছে তাদের কাছে। এরমধ্যে অবশ্য কয়েকবার পারুলের সাথে তার চোখাচোখি হয়েছে তবে তার চোখের ভাষা পড়ার মত অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি মুকসেদের মনে। তারা যেন প্রচন্ড বন্যার স্রোতে একটা ছোট জমিতে বসে আছে যেখানে সাপ ,ব্যঙ, বিড়াল কুকুর সব এক জায়গায় বসে আছে কিন্তু কারো প্রতি কারো অন্য দৃষ্টিতে তাকানোর সুযোগ নেই। হঠাত্ রেডিও তে ভেসে উঠল একটি কন্ঠ। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা, একটি নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা গড়ার ঘোষণা। জয়বাংলা কন্ঠে পারুদের বাড়িটি মূখরিত হয়ে গেছে। মুকসেদও চোখ বুজে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের দিকে পারুল তাকিয়ে আছে কিন্তু পারুলকে সে চোখ দেখতে পাচ্ছে না।
আজ মুকসেদের বিয়ে। আয়োজন খুব বেশি নয় তবু বিয়ে তো বিয়েই। বিয়েতে সাধারণত অনেক উত্সব হয় কিন্তু এ বিয়েতে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর অবশ্য একটা কারণ ও আছে গতকাল স্থানীয় হাইস্কুলে পাক সেনারা ক্যাম্প গেড়েছে। সারা গ্রামে একটা চাপা আতংক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় মুকসেদ বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু সবার অনুরোধে তাকে ঢেকি গিলতে হল। খুব সংক্ষেপে কিছু মুরব্বীর উপস্তিতে মুকসেদের বিয়েটা হয়ে গেল। পারুল অনেক কেঁদেছিল। মুকসেদ ও কিছুটা উতলা হয়ে গিয়েছিল একটি নিশ্চিত ভবিষতের মাঝে অনিশ্চিত যাত্রার পথে পারুলের কান্না দেখে।


সন্ধ্যা পার হয়ে চাঁদটা রাতের প্রথম প্রহরে এসে পড়ল। চারদিকে অদ্ভুত নিরবতা। পাক সেনাদের ভয়ে থেমে গেছে সকল ব্যস্ততা! মুকসেদ তাকিয়ে আছে পারুলের দিকে। পারু, আস্তে ডাক দেয় মুকসেদ। কন, পারুর ছোট্ট উত্তর। তোমার কি ডর করতাছে। না, আপনে পাশে থাকলে আমার কোন ডর নাই। ধর আমি যদি সবসময় তোমার পাশে না থাহি। তখন আসমানের ঐ চান্দের পানে চাইয়্যা থাকুম। যদি চান্দের গায় মেঘ লাগে? তবু চাইয়্যা থাকুম. মেঘ তো সবসময় থাকব না। মুকসেদের চোখে পানি। আপনে কানতাছেন? খুশি কানতাছি পারু. খুশিতে ।কথা শেষ করতে পারে না মুকসেদ বাহির থেকে বদরুলের ডাক আসে। মুকসেদ বাইরে বেরিয়ে আসে। দোস্ত সময় নাই, সবাই অপেক্ষা করতাছে. আইজ রাইতে বর্ডার পার হইতে অইব। মুকসেদ দেরী করেনা, পিছনে দাঁড়ানো মাকে সালাম করে। মা দোয়া কইর। মা মুকসেদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। মুকসেদ ভাঙা কন্ঠে বলে মা পারুরে তোমার কাছে রাইখা গেলাম। পারু এবার বিদায় দেও। পারু হাসে, দেখছেন আসমানে চান উঠছে, আমি চান্দের পানে চাইয়্যা আছি, আপনি যান। মুকসেদ এগিয়ে যায়। পিছনে ফিরে তাকায় না। তবে সে কাঁদছে। বদরুল ফিসফিস করে বলে পুরুষ মাইনষের কান্দন বড় কঠিন কান্দন, বড় কঠিন কান্দন।
আজ মুকসেদের শরীরটা একটু খারাপ। অবশ্য শরীর খারাপ না মন খারাপ তা বুঝা যাচ্ছেনা। বোধহয় মনটাই খারাপ। কতদিন হয় মায়ের মূখ দেখে না। পারু কেমন আছে কে জানে? বিয়ের দিন ই মেয়েটাকে ফেলে এসেছে সে। হাসি মূখে বিদায় দিয়েছে পারু। সেই হাসির আড়ালে যে কত বেদনা লুকিয়ে ছিল তা বিধাতাই ভালো জানে। মুকসেদ তাড়াতাড়ি তৈয়ার হ, মীর বাড়ির কাঠের পুলে আইজ অপারেশন. তাড়া দেয় বদরুল। মুকসেদ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলা নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। রওনা হয় মীর বাড়ির কাঠের পুলের দিকে। গত কয়েক মাসে তারা অনেক গুলো অপারেশন পরিচালনা করেছে। প্রায় প্রতিটা অপারেশন ই সফল হয়েছে তবে এজন্য মূল্য ও কম দিতে হয়নি তাদের। অনেকবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছে তারা। কয়েকজন তাদের মাঝ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।


মীর বাড়ির কাঠের পুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্থানী বাহিনীর একটি সৈন্য দল পার হবে এখান দিয়ে। তারা মার্চ করে কাঠেরপুলে উঠার সাথে সাথেই ভেঙে পড়বে পুলটি। সবঠিক ঠাক। মুকসেদদের দলটি পাশের ধানক্ষেতে অবস্থান নিয়েছে। পাক সেনারা পুলের কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত একটু আগেই বিস্ফোরিত হল পুলটি। শুরু হল তুমুল লড়াই। প্রাণপন যুদ্ধ চলছে। পাক সেনারা রাস্তার ওপারে অবস্থান নেওয়ায় সুবিধা করা যাচ্ছেনা। বদরুল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গুলি করতে থাকে। হঠাত্ একটি বুলেট তার কপালে আঘাত হানে। ফিনকি লাল রক্ত। মুকসেদ জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। ততক্ষণে সবশেষ। তার প্রিয় বন্ধুটি চলে গেছে না ফেরার দেশে। মুকসেদ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা। সে বেপোরোয়া বোমা মারতে থাকে পাকসেনাদের দিকে। সফল হয় কাঠের পুল অপারেশন।
পূর্ণিমার চাঁদটাকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। চাঁদের আলোয় পুরো গ্রাম যেন নতুন করে সেজেছে। পারুল মূখে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়ছে। সে জেগে আছে। আজ চাঁদকে সে ভালোভাবে দেখবে। চাঁদের আলোয় নিজেকে জড়িয়ে মুকসেদের উপস্থিতি অনুভব করবে সে। পাশে কোরান তেলোয়াত শোনা যাচ্ছে। মুকসেদের মা প্রতিদিন সুর করে কোরান তেলোয়াত করে। নামায পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করে। মাঝে মাঝে রোজাও রাখে। পারুলের মনটা আজ বড্ড আনমনা। মানুষটাকে সে ভালো করে দেখবার ও সময় পায়নি। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গেছে সে কিন্তু পারুল যে নিজের মনের সাথে কত বড় যুদ্ধ করছে তাকি বুঝে মুকসেদ। একদিন দেশ স্বাধীন হবে। তখন পুকুর পাড়ের ঐ কলমি ফুলের পাশে বসে তারা কথা বলবে। কথার ছলে মুকসেদ হয়ত তার খোঁপায় গুঁজে দেবে একটি কলমি ফুল। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় পারুল। হঠাত্ ভাবনায় ছেদ পড়ে। বাড়ির উঠানে অনেকগুলো বুটের শব্দ। মুকসেদের মার কোরান তেলোয়াত থেমে যায়। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। জুলমত রাজাকার জোরে জোরে পারুলকে ডাকছে। মুকসেদের মা এসে পারুল কে জড়িয়ে ধরে। এক সময় দরজাটা ভেঙে যায়। মুকসেদের মাকে বেঁধে ফেলে তারা। পারুলের উপর চলে পাশবিক নির্যাতন। হায়েনাদের হিংস্রতায় আলো আঁধারের মাঝে হারিয়ে যায় পারুল। হয়ত পূর্ণিমার চাঁদের পাশে একটি তারার মাঝে নতুন করে তার জায়গা হবে!
দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পাক বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসর্মপন করেছে। বাংলার মানুষ আজ মুক্ত। তাদের আজ একটি স্বাধীন পতাকা আছে, একটি স্বাধীন মানচিত্র আছে। ভাবতেই ভালো লাগে মুকসেদের। এখনো তার গায়ে যুদ্ধার সাজ। কাঁধে রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। সরিষা ক্ষেতের আলে হলুদ ফুল গুলো তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। মৌমাছির মৌ মৌ গুণজনে সে মুগ্ধ হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। আচ্ছা পারুল কি তার জন্য উঠানের কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে? কত কথা জমে আছে, কত গল্প উপন্যাস হয়ে গেছে, কত কবিতা ব্যাখা করার বাকি আছে। পারুলকে সে সব গল্পগুলো শোনাবে। গল্প শোনতে শোনতে চাঁদনী রাত হয়ত ক্লান্ত হবে কিন্তু তারা ক্লান্তহীনভাবে গল্প করে যাবে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায় মুকসেদ। কি ব্যাপার বাড়িটা এমন খাঁ খাঁ করছে কেন? মা মাগো জোরে চিত্কার করে মুকসেদ। দরজাটা এক ঝটকায় খোলে যায়। পাগলের মত ছোটে আসে মুকসেদের মা। বাপ তুই আইছছ, আইছছ বাপ? কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। মুকসেদ ও কাঁদছে। পাশের ডাহুক পাখিটা তাদের কান্নার সাথি হয়ে শিষ দিয়ে যাচ্ছে। মুকসেদ ভাঙা গলায় বলে মা পারু কই। মুকসেদের মায়ের কান্না বাড়ে। মুকসেদ মনে হয় কিছুটা আঁচ করে। দাঁত চেপে ধরে সে। বুক ফেটে আসে। কিন্তু যুদ্ধ জয়ী সৈনিকের কি এত ভেঙে পড়লে চলে? মুকসেদ নিজেকে সামলে নেয়। মুকসেদের মা মুকসেদের হাত ধরে শিউলী গাছের তলায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি নতুন কবর। মুকসেদ অশ্রু লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালায়। কাঁদছে সে। বনের ঘু ঘু টি মুকসেদের বেদনায় এই ভর দুপুরে তার কন্ঠে করুণ সুর তোলছে। কবরের গায়ে ফুটে আছে একটি টকটকে লাল গোলাপ। স্বাধীন দেশের রক্ত নদে ফুটন্ত গোলাপ। গোলাপের গায়ে পারুলের মূখটি ভেসে উঠে। মুকসেদ মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।