আমার এক বহিন ছিল, সরিতা
কালো, রোগা, হাড় বের করা
উঁচু কপালে, ক্ষীণ কেশরাশি
অনেকটা আমারই মত ...
ছিল স্বামী সন্তান মকান ঘরদুয়ার
ঠিক যেন বিজ্ঞাপনের সুখী পরিবার
আমি তখন বুকে আঁকড়ে ধরতাম শিশু
কথায় কথায় হামি দিতাম চোখে
রাতে দু'জনে দেখতাম হিন্দী ফিল্ম্
রুটি সেঁকে খাইয়ে দিতাম সাথে
দিওয়ালিতে জ্বালাতাম আতশবাজি
ফাগুনে মাখতাম রঙ
আর দেওরের সাথে করতাম মজা ...
যেমনটা বেশীর ভাগ মানুষ করে
আবার যেমনটা কেউ কেউ করেনা
আমার বহিন এমনই একজন
তেমনই কোনো এক রাতে
আমার সেই সরিতা বহিন
ছেড়ে চলে আসে কোলের সন্তান
ঘর গেরস্থালি বিত্তশালী পরিবার
চার চাকা আদর আরাম
নতুন ঠিকানা তার ...  শব্দগাঁও
বিহারের প্রত্যন্ত এক গ্রাম


শাসন ও শোষণের ঝান্ডাধারী
রক্তচক্ষু বাহিনীর কানে
বার্তা পৌঁছে গেল নিমেষে
- এ ছোকরি অনপঢ় মানুষের জন্য
জান দিতে পারে ? সচ্ !
হো হো শব্দ করে হেসে উঠল
জমি মাফিয়ারা, দলা করে
অনাবিল তাচ্ছিল্যের থুক্ ফেলল
দখল করা জমির ওপর
কিলবিল কিলবিল করে চোখগুলো ঘোরা ফেরা করতে লাগল
বহিনের শরীরে বুকের আশেপাশে
-- ছোকরি শাদি করলে হ্যয় কা রে বুধওয়া !
-- শালি বেঘর হো গৈল কা ?
-- রাত কঁহা কটাএব্ রে ?
-- কল তোহর ঘর, কল হম্মর !


বহিনের চোখের তারাদুটো নির্ভয়
হাজার বছরের নিশ্চয়তায় স্থির
গরীব খেটে খাওয়া মানুষের
জমি উদ্ধারের লক্ষ্যে, অবিচল
পশ্চিমের আকাশ তখন সবে লাল
বহিনের দিকে এগিয়ে এল
আরো কয়েক জোড়া হাত
জড়ো হতে লাগল লড়াইয়ের জন্য
এরপর এক গ্রীষ্ম দুপুরে
আবির্ভূত হল এক ৠজু পুরুষ
হাতে হাত মিলল কাঁধে কাঁধ
সরিতা বহিনের সাথে
জোট বাঁধল মহেশ ভাই
শুরু হল এক সংগঠিত লড়াই


পূর্ণিমার সফেদ আলোয়
সুস্পষ্ট ভরা মকই ক্ষেত
মুছে গেছে টুকরো অন্ধকার
ঘরে ঘরে মজুত হয়েছে
যৌথ খামারের ফসল
আনন্দধারা ধরা দিয়েছে
আমাদের প্রিয় ধরিত্রীর বুকে
বিঘা বিঘা জমিন আজ
মাফিয়াদের কবল মুক্ত
মশাল জ্বলছে উজ্জ্বল
আলোকিত অন্দর বাহির
শব্দগাঁও মেতে উঠেছে
নবান্নের আনন্দ উৎসবে


ওদিকে তখন জমাট বেঁধেছে প্রতিহিংসার কালো
অন্ধকারে চকচক করে ওঠে
কার্তুজ, বন্দুকের নল
-- শালোঁকো আজ হি মার ডালনা হ্যয়, তুরন্ত !
চিৎকার করে ওঠে এক রক্তচক্ষু
অশ্রাব্য গালিগালাজ করে কোরাসে
হিসহিসিয়ে ওঠে খুনীর জিহ্বা
কচুরিপানায় ধাক্কা খেয়ে
ডোবায় গেঁথে গেল
দেশি মদের ভাঙা বোতল
চাই খুন, তাজা খুন চাই


সারারাত জেগেছিল কালপেঁচা
খালের ধারে গোখরো সাপ
শিকার গিলে নিতে ব্যস্ত
মসজিদে আজান পড়া শেষ
সবে ভোর হল পূবের দিগন্তে
খালের ওপরে ছোট্ট সাঁকো
সাঁকোটা জুড়ে শুধুই রক্ত
মাথার ঘিলু ছিটিয়ে পড়ে পথে
এফোঁড় ওফোঁড় বুকে গভীর ক্ষত
শুয়ে আছে দুটো শরীর
সরিতা মহেশ ... নীথর নিহত !


আমি নিশ্চিত, জেগে উঠবে শব্দগাঁও
জেগে উঠবে নিঃশব্দ বিপ্লবে
আমার এক সরিতা বহিন
এক মহেশ ভাই শহীদ হয়েছে সবে ...


( ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বেশ কিছু আগের একটি ঘটনা অবলম্বনে লেখা ৷ মূল ঘটনাকে অবিকল রেখে সামান্য কিছু উপাদান যোগ করতে হল ৷ এনজিও চালানো অত্যন্ত সাধারণ দুটি মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে বিপ্লব এনে দিতে পেরেছিলেন ৷ সেখানকার মানুষ গ্রামের প্রবেশ দ্বারে দুই শহীদের প্রস্তর মূর্তি স্থাপন করে প্রতিদিন ঈশ্বরকে  স্মরণ করে থাকেন ৷
তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৷ )