আসলে আমরা কবিতায় যা লিখি তার এক শতাংশ মানব সভ্যতা কাজে লাগায়। এই কথাই আইনস্টাইনের E = MC2 সমীকরণের ভিতর নিহীত। অনেকেই বুঝতে পারেননিই সাধারণ বস্তুর মদ্যে প্রভূত শক্তি নিহিত – এই কথাটির মধ্যে কি এমন তাৎপর্য রয়েছে! স্থিরশক্তি – আপেক্ষিকতাবাদের মধ্যে চরম গবেষণার অন্যতম। কোনও জিনিসের স্থিরশক্তি তার নিজের গতিশক্তি বা পর্যবেক্ষকের গতিশক্তির ওপর নির্ভর করে না কিন্তু শক্তির উৎস হিসেবে স্থিরশক্তির কথা অন্তঃসারশূন্য মনে হয়। কেন না সবচেয়ে সক্রিয় কেন্দ্রীন বিক্রিয়াও স্থির শক্তির এক শতাংশ কাজে লাগাতে পারে। বাকী নিরানব্বই শতাংশ...তবে!
.
জানি কবিতার মধ্যে কি সব বিজ্ঞান পুরাণ বলছি...শুনুন একটু। এগুলোর পথ ধরেই যে কবিতা উপত্যকায় আমাদের যাত্রা। স্থিতিশক্তি ব্যাপারটা যে নিছক কল্পনা নয় তা প্রকাশিত হয় যখন পরীক্ষামূলক ভর সৃষ্টি সম্ভব হয়। পারমাণবিক কণা নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত পদার্থবিদরা দেখলেন যে পর্যাপ্ত শক্তি সম্পন্ন আলো প্রকৃত অর্থে গামা রশ্মি, নতুন কণা সৃষ্টি করতে পারে। আলোর শক্তি সেখানে ভরে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন কণা তৈরির ন্যূনতম যে শক্তি দরকার তা কণারই স্থির শক্তির উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে উপরের তথ্য অনুসারে সমৃদ্ধ হলাম। আগে শূন্য ছিল একটি স্থান যেখানে আজ নতুন বস্তু সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং বুঝতেই পারছি স্থির শক্তি বস্তু তৈরির প্রয়োজনীয় শক্তি। কল্পনায় বিশ্বের জন্ম ইতিহাসে আমরা বিগব্যাঙ-এর কথা জানি। সেই সময় সৃষ্টি ও লয়ের প্রচন্ড লীলায় প্রচুর সংখ্যক কণা ও প্রতীপ কণা সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্ব যত ঠান্ডা হতে লাগল এবং পারিপার্শ্বিক শক্তির পরিমাণ কমতে লাগল ততই লয় প্রক্রিয়া প্রাধান্য পেতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভরের এক বিলিয়ন অংশ পড়ে রইল।
.
আমাদের দেহের মধ্যেও পরমাণু নানাভাবে যুক্ত বা বিযুক্ত হয়েছে যদিও মূল অংশের প্রোটন ও ইলেকট্রন সৃষ্টি হয়েছিল তপ্ত অকল্পনীয় চুল্লীতে। গীতায় রয়েছে –
এতদ্ যোনীনি ভূতানি সর্ব্বানীত্যুপধারয়।
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলস্তথা।।
অনুবাদ – সমস্ত ভূত(পদার্থ) সকল এই উভয় প্রকৃতি হতে জাত, ইহা বিশেষভাবে জানবে। আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের কারণ।
ব্যাখ্যা – জীবের চেতনাংশ পরা প্রকৃতি এবং জড়াংশ অপরা প্রকৃতি। এই পরা ও অপরা প্রকৃতির সমাবেশ ও সমন্বয়ই সমস্ত ভূত সমূহের (চেতন ও অচেতন) উৎপত্তির উৎসস্বরূপ। অবশ্য সৃষ্টির মূল ও স্বাধীন সত্তা হচ্ছে পরা প্রকৃতি (চেতন অংশ) এবং সৃষ্টির নিম্নস্তরে অপরা প্রকৃতির (নিকৃষ্ট জড় পদার্থ) ক্রিয়া ও তার কোনও স্বতন্ত্র সত্তা নেই। সৃষ্টির রহস্যের অন্তরালে চৈতন্য প্রকৃতি জড়ের আধারকে নির্ভর করে জীব মূর্তি ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ - জড় প্রকৃতি দেহক্ষেত্র রূপে রূপান্তরিত হলে চৈতন্যশক্তি ক্ষেত্র রূপে প্রবেশ করে সেই দেহ ধারণ করে থাকে। সেই জন্য এই দুই প্রকৃতিকেই সর্বভূতের যোনিতুল্য বলে। তাই বিশ্বের প্রতি অণু-পরমাণুর মধ্যে চিৎ জড় সম্মিলিত ভাবে অবস্থান রত।
.
প্রসঙ্গত চিৎ জ্ঞান রূপা ও ইচ্ছাশক্তিময়ী। আর জড় হচ্ছে ক্রিয়াশক্তিময়ী। চিত্তের সঙ্গে মিলনই জড়ের ক্রিয়াশক্তির উন্মীলন ঘটে। তাই যেখানে ক্রিয়া, সেখানেই জ্ঞান। আবার যেখানে জ্ঞান সেখানেই ক্রিয়ার সুপ্ত অবস্থিতি। সেই জন্য চিৎ জড়ময়ী প্রকৃতি পরমশক্তির সৃজনী প্রতিভার অনন্তশক্তি। আর এই সৃজনী চেতনার মুক্তি দেয় কবিতা। তাই কবিতার জন্য, কবিতার পাঠকের জন্য এই উপত্যকার খোঁজ চলতে থাকবে।
.
(কৃতজ্ঞতা শক্তিতত্ত্ব - সৌকিল চ্যাটার্জী)