১২০২ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কী আক্রমণ সংঘটিত হয়। তা বাংলার ইতিহাসে আমুল পরিবর্তন আনে। দেশের প্রচলিত জীবন সমাজব্যবস্থা সংস্কৃতি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা, প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমান শাসন। তুর্কী আক্রমণের ভয়াবহতা অতিক্রম করে বদান্য শাসকদের প্রয়াসে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি নতুন করে জেগে ওঠে নতুন প্রত্যয় নতুন ভাবনায়।
.
খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকেই বাংলায় সংস্কৃতের চর্চা ছিল। সংস্কৃতে সাহিত্য ব্যাকরণ স্মৃতিপুরাণ ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদি রচিত হয় তখন থেকেই। ভট্টনারায়ণের ‘বেণীসংহার’, বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’, ক্ষেমীশ্বরের ‘চণ্ডকৌশিক’ প্রভৃতি নাটক এই সময়েই রচিত হয়। অনুমান করা হয় যে এই লেখকরা ছিলেন বাঙালী এবং গ্রন্থগুলি সংস্কৃতেই লেখা। অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দী দুই কবির একই নামের দুটি কাব্য ‘রামচরিত’ অবশ্যই বাঙালীর লেখা। সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যটি এই কারণে বিশেষ উল্লেখ্য যে চারটি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই কাব্যটি দ্ব্যর্থকভাবে তিনি রচনা করেছেন যার এক অর্থ রামায়ণের রামচন্দ্রের কাহিনী, অন্য অর্থ তখন পাল রাজা রামপাল ও তার পুত্র মদনপালের কথা। সাহিত্য ব্যতীত সংস্কৃতে অন্যান্য গ্রন্থও রচিত হয় গুপ্ত, পাল ও সেন যুগে। যেমন শ্রীধরের ‘ন্যায়কন্দলী’, গৌড়পাদের ‘আগমশাস্ত্র’, ভবদেবের ‘ব্যবহারতিলক’, ‘প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ’, জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’, হলায়ুধের ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’, চন্দ্রগোমীর ‘ব্যাকরণ’, বন্দ্যঘাটীয় সর্বানন্দর ‘টীকাসর্বস্ব’, পালকপ্যের ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’, মাধবের ‘রুগবিনিশ্চয়’, চক্রপাণি দত্ত-র ‘চিকিত্সাসারসংগ্রহ’ ইত্যাদি ধর্ম দর্শন চিকিত্সাবিষয়ক অজস্র গ্রন্থ।
.
লক্ষ্ণণসেন ছিলেন শিল্পসংসকৃতির বড় পৃষ্ঠপোষক। সে যুগের কবি পণ্ডিত রাষ্ট্রবিদরা তাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’, ধোয়ীর ‘পবনদূত’, গোবর্ধন আচার্যর ‘আর্যাসপ্তশতী’ বাঙালী রচিত সংস্কৃত কাব্যের উজ্জ্বল নিদর্শন।
.
প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ বেশ কিছু রচনা সংকলন আছে যাতে বাঙালী কবির লেখা ও বাংলার পটভূমিকায় রচিত বেশ কিছু কবিতা আছে। প্রাকৃত ভাষায় লেখা ‘প্রাকৃত-পৈঙ্গল’ বিশেষ উল্লেখ্য রচনা সংকলন। প্রাকৃত-পৈঙ্গলের কিছু কবিতা উল্লেখ্য যাতে বাঙালী জীবনের ছাপ আছে।
একটি কবিতায় খাবার তালিকা দেওয়া হয়েছে যা বাঙালীর রসনাতৃপ্তির উপযোগী –
ওগগর ভত্তা
রম্ভঅ পত্তা।
গায়িকা ঘিত্তা
দুগ্ধ সজুত্তা।
মোইনি মচ্ছা
নালিচ গচ্ছা।
দিজ্জই কন্তা।
খাই পুণবন্তা।।
-ওগরা ভাত, রম্ভার (কলাগাছের) পাত, গাওয়া ঘি, সাজা দুধ অর্থাৎ দই, ময়না মাছ, নালিতা (পাট) শাক। কান্তা রেঁধে দেয়। পুণ্যবান খায়।
প্রেমের কথা, কৃষ্ণর নৌকাবিলাসের কথা কয়েকটি কবিতায় আছে। ‘প্রাকৃত-পৈঙ্গল’ বাংলা বৈষ্ণবকাব্য বা মঙ্গলকাব্য ইত্যাদিকে প্রভাবিত করেছিল।
(এই সব কথার মাঝেও চর্যাযুগের কথা ও পরেও আধুনিক যুগের বাংলা ভাষার কথা বলব...অজানা পথে চলতে চলতেই দেখা হবে...নব জন্মের সৃজনের সাথে।)