সেই ছেলেটার সাথে সেদিন আবার দেখা হলো।
আগে রোজই প্রায় ফোন করত,
দিদি দিদি বলে। আমারও অবসরজীবন। যাপন।
কথা বলতাম। সারাদিন ইঁট-কাঠ-টেবিল-টিভির বাইরে...
বুঝতাম যদি ফোন কেটে দিই, তাহলে রাগ করবে,
তাই মুখের উপর কিছু বলতে পারি না।
চুপ করে হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতাম।


সেই ছেলেটার সাথে পরিচয় পর্ণশ্রী বাসস্ট্যান্ডে।
আমার পায়ের উপর দিয়ে অটো চলে যায়,
আমায় ছেলেটি সাহায্য না করলে, ঐ দিন ডি.পি.পি. রোডে
আমার ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পারতাম না।
বর মেয়ে কেউ তখন ছিল না, কাছাকাছি।


আচ্ছা ছেলেটির সাথে যে কথা বলি,
শুধুই কী কৃতজ্ঞতা!
আমাকে ছেলেটি কী নতুন করে কিছু ভাবায় না!
আমার স্বামীকে বলেছিলাম একদিন, ওর কথা।
স্বামী হেসে বলেছিল, ‘বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়লি নাকী রে’
আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, ‘তুই একটা যাচ্ছেতাই।’


গত দেড় সপ্তাহ ছেলেটির ফোন নেই।
রাস্তাতে দেখাও হয়নি।
ফেসবুকেও কোন ম্যাসেজ করেনি,
শুধু একবার কভার ফটো আপডেট করেছিল—
“হে বন্ধু, বিদায়”
আমি আর ভয়ে জিজ্ঞেস করিনি—কী হয়েছে।
সত্যিই আমি মধ্যবিত্তই বটে।
ছেলেটি আমার বন্ধু হয়েছিল, আমি পারিনি
আমার আধুনিকতার একাকীত্বে পাশে দাঁড়িয়েছিল
সে কত কথা,
বৃষ্টি থেকে শীত, খাওয়া থেকে রাজনীতি
খেলা থেকে সিনেমা। অজস্র যাপন। অজস্র স্মৃতি।
নিমন্ত্রণ করে মাংস ভাতও খাইয়েছিলাম।
ছেলেটি খেয়েছিল তৃপ্তি করে।
ওর মা বৃদ্ধা। আর্থিক সামর্থ্য কম। হয়তো ভালো করে...


যা হোক খবর নেই।
কেন জানি না, আপনজনের মতো আজ
প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে।
আমার মেয়ে দেরি করে ফিরলে যেমন হয়,
ঠিক তেমনই অনুভব করছি। আগে হয়নি,
আমার বর বলে, ‘তুই দিন দিন লেখিকা হচ্ছিস,
কত্ত টেলিপ্যাথি কাজ করছে তোর ভিতর’


সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় সবে রানি রাসমণি চালিয়েছি,
কলিং বেল বাজল, একটা বড় পার্সেল এসেছে।
বুড়ো বয়সে কে আবার আমাকে এসব পাঠাবে...
আমার মেয়ের নামে হলে তাও হতো।
ক্ষ্যাপাতাম, ‘এবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে তোর একটা...’


সিরিয়াল সাতটায় শেষ হলে পার্সেলটা খুললাম
আমাদের তিনজনের ছবি হাতে আঁকা।
নিচে ডানদিকে ছোট করে লেখা, ‘সেই ছেলেটা’


পরে কোরিয়ার সার্ভিস, ফেসবুকে অনেক খোঁজ নিয়েছি
ছেলেটির খোঁজ পাইনি।
একদিন ওদের পাড়ায় আমার বর খোঁজ নিয়ে এসে বলল—
‘কেউ কিছুই বলতে পারল না।’


ছবিটা মুছতে গিয়ে আজ ওর কথা মনে পড়ল—
কত পাগলামী, কত দুষ্টুমী করত।
কিন্তু বিদায় বলে কোথায় গেল!
মনে পড়ে গেল ও একদিন বলেছিল—
‘দিদি লালন সাঁই, রবি ঠাকুর যেমন তোমার বুকে, আমাকে ঐ বুকে স্থান দেবে!’
সেদিন ভয় পেলেও, আজ কেঁদে ফেললাম...
বয়স বাড়লে কান্নারা নীরব হয়, নীরবতায়।