মুরব্বিদের মুখে প্রায়ই শুনতাম- “খৈলশা উজায় পুঁটি উজায়। লগে তিটপুঁটিও উজায়।” গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এ কিছু দুষ্ট লোকের বিভিন্ন স্ট্যাটাস চোখে পড়ছিলো। কারো কারো স্ট্যাটাস দেখলেই বুঝা যায় কাঁচা হাতের লেখা। লেখালেখির অভিজ্ঞতা হয়ত খুব বেশি দিনের না। কিন্তু লেখাগুলোর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। সম্ভবত নিজ স্বার্থ উদ্ধার হয়নি বলে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে লেখা কিংবা যা নিজ মুখে বলা যায়না তা অন্যের মুখ থেকে(মানে কাউকে বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার করে। তাও আবার সমাজের বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে) সিনেমার গল্পের মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে এসব কাঁচা হাতের লেখকরা ওইসব বিশেষ ব্যক্তিদের দীর্ঘ কর্মময় এবং ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা না পেয়েই সিনিয়র হিসেবে তাদেরকে সম্মান প্রদর্শণের বদলে ব্যক্তিগত ঈর্শ্বা থেকে এসব লিখছে তা খালি চোখে যে কেউই বুঝতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে অনেকে ফেসবুকে আবার মোবাইলেও ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করেন- “আপা, এইযে দু' চারদিন ধরে লেখালেখির জগতে পা রাখা এসব পোলাপান ফেসবুকে যা লিখছে আবার বিভিন্ন জনের আইডিতে তা আনন্দের সাথে শেয়ারও করছে। তা যে ওরা না জেনে লিখছে তা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, কিন্তু এদের অতী লেখক সাজার কারণে অনেক সম্মানী ব্যক্তির যে মানহানি হচ্ছে এর প্রতিকার কোথায়?”


আবার কোনো কোনো নারী বলছেন যে কিছু কিছু লোকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করলে বিভিন্ন নামে ফেক আইডি খুলে ওরা আমাদের কর্মস্থল এর অনলাইন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত আইডির বিভিন্ন স্ট্যাটাসের নিচে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করে কর্মস্থলের সবার কাছে আমাদের বাজেভাবে পরিচয় করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার অনেক সময় সারাদিন পেশাগত কারণে অনলাইনে কাজের ব্যস্ততার কারণে অনেকের আইডি ভালো ভাবে না দেখে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড লিস্ট দেখেই একসেপ্ট করার পর যখন তারা ফেসবুক এর চ্যাট বক্সে যেয়ে দিনের পর দিন কথা বলতে চেয়েও আমাদের দিক থেকে কোনো জবাব পায়না তখন ওরা চ্যাট বক্সে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল ছবি(যা অত্যন্ত বাজে ও অশ্লীল বলে কাউকে এমনকি স্বামীকে ছাড়া কাউকে দেখানো যায়না) পোস্ট করে এবং নোংরা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বিরক্ত করা শুরু করে।


আমি সবাইকে একটাই উত্তর দেই যে একেতো এখনকার ছেলেপুলেরা অল্পতেই নিজেদেরকে অনেক বড় কিছু ভেবে এবং যাদের সম্পর্কে লিখছে তাদের দিয়ে কোনো স্বার্থ হাসিল না হওয়াতেই এসব লিখছে হয়ত। আর তাদের রুচি এতোটাই বাজে এবং তাদের সঠিক শিক্ষাগত যোগ্যতার এতোটাই অভাব যে তারা এসব করে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। তাদের ধারনা সারাদিন অনলাইনে যেসব ভিজিটরদের (বিশেষ করে নারীদেরকে) দেখা যাচ্ছে তারা হয়ত ওদেরই মতো বিভিন্ন পর্ণো সাইট দেখে টাইম পাস করার জন্যই অনলাইনে সময় ব্যয় করছে। তাই নিজেদের পক্ষের লোক ভেবেই এসব ছবি পোস্ট এবং ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করলে বাজে মন্তব্য করে বেড়াচ্ছে। ওরা ভাবে যে- ওই মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পারসনরা সমাজে নিজেদের ব্যক্তিগত ইমেজ রক্ষার জন্যই ওদের এসব বাজে কার্যকলাপ ফাঁস করবেনা এবং ওদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনা। আর এটাই ওদের একমাত্র ভরসা। এসব অপরাধ ধর্ষণের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।


তবে এর প্রতিকার একটাই। তা হলো- “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন ২০১৩” প্রয়োগ করা। লেখা লেখি করলেও দেশের আইন ও এসব বিষয়ে যথেস্ট জ্ঞ্যান না থাকার কারণেই ওরা একের পর এক মনগড়া কাহিনী লিখে তা প্রচার করে নিজেদেরকে অন্যের কাছে পন্ডিত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পায়তারা করছে। আসলে যারা সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানি তারা লেখা দেখলেই বুঝবে এর সত্যতা কতটুকু এবং এর আসল উদ্দেশ্য কি।


ধরুন- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে যদি এ যুগের কোনো উঠতি নতুন লেখক কিংবা কবি দাবি করেন- “ওনি আসলে বিশ্বকবি না, ওনি একজন চোর ছিলেন। ওনার মা এবং স্ত্রী দু'জনই বেশ্যা ছিলেন। ওনার উত্তরসুরীরাও বেশ্যাপল্লীতে বেড়ে উঠেছে। বেশ্যাবৃত্তিই ছিল তাদের একমাত্র পেশা। সে কোনো দিন এক কলম লিখেও দেখেনি। ওনি কোনোভাবেই বিশ্বকবি হতে পারেন না আর নোবেল পুরস্কারতো দুরেরই কথা। যারা তাকে বিশ্বকবি কিংবা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছেন তারা কেনো করল এটা? না না এটা উচিত হয়নি। ওনি আসলে বেশ্যার স্বামী এবং বেশ্যার সন্তান। ওনার বাবা ডাকাতদের সর্দার ছিলেন। ওনি নিজেও বেশ্যাদের দালাল ছিল।”  


তাহলে কি ওই নতুন নির্বোধ কবির এ দাবিগুলো সত্যি হয়ে যাবে? কখনোই না। তবে হ্যা, কেউ কেউ তার ওই দাবি বিশ্বাস করতেই পারে। তারাই করবে যারা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ধারনা রাখেনা। যারা জানেনা যারা বুঝেনা। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে এদের সংখ্যা গুটি কয়েক বলেই আমার ধারনা।


যাইহোক, আমি এই সমাজের খুবই নগন্য একজন মানুষ। প্রায় ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের আইন সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি তা থেকে আমার সকল বন্ধু এবং বিশেষ করে সেইসব কাঁচা হাতের লেখকদের উদ্দেশ্যে “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন ২০১৩” এর একটি বিশেষ ধারা তুলে ধরছি।


আশা করি দুষ্টরা সতর্ক হবে এবং সমাজের বিশেষ সেই দায়িত্বশীল সম্মানীত ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবারের মতো নিজেকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচতে সাহায্য করবেন। আর সম্মানীত দায়িত্বশীলরা চুপ হয়ে বসে না থেকে ওদের টেনে হেচরে ঘর থেকে বের করে এনে জনসম্মুখে কষিয়ে চর-থাপ্পর আর কিল-ঘুষি, লাথি মেরে তাদেরকে স্ব-সম্মানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর(র্যাব কিংবা পুলিশ। কারণ এমনিতেই তারা এখন চাপের মুখে আছে। এখন কোনো কমপ্লিন পাওয়া মানেই অপরাধীদের হয় ক্রস ফায়ার আর না হয় টর্চার ডেথ) হাতে সোপর্দ করবেন। মনে রাখবেন, আজকে চুপ থাকবেন তো কাল আরো বেশি করবে ওরা।


তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন ২০১৩ :
এই আইনে যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ বছর। এআইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ৫৭ ধারা। এই ধারাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার কারণে ইন্টারনেটের যে কোনো কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সংবাদপত্রের অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা সম্প্রচার করা কোন কিছু মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে একই দণ্ড হবে। এ আইনে কারো বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা অভিযোগও হয় তবু মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপনার জামিন মিলছে না।


এই আইনের অধীনে অপরাধসূমহ অ-জামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আপনি যদি বৃদ্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত কিংবা নির্দোষও হন তাহলে মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন মিলছে না। এছাড়া অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে।


৫৭ ধারায় বলা আছে, (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ কাজে আগ্রহী হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয় তাহলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ? আর এর সর্বনিম্ন সাজা হচ্ছে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।


লেখক:
সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ই-মেইল: preity077@gmail.com