পলাশডাঙার আদিবাসী পাড়ার একটা ঘরে
আজ কু'ন আলো জ্বলেক্‌নি,
তুলসীতলায় কু'ন পিদিম জ্বলেক্‌নি,
জ্বইলবেক বা কেনে-
এক বছর ধরে তিল তিল করে গড়া স্বইপ্নো
ভেঙে ধূলায় গড়ায় গেছে।
অইন্‌ধোকার দাওয়াতে এইক কোণে বুইসে
গালে হাইত দিয়ে শিবু সোরেন ভাবে-
বউটা মোরে ঠকাইছে বটে!ব্যাটা দিব বুলে শ্যাষে
বিটিটা দিলো!বংশের বাতিটা এখুন জ্বালাইবেক কে?


মনে পড়ে-
একদিন কলের লাঙল চালাবার ফাঁকে চৌধুরীবাবু কয়েছিলেন-
শিবু,ব্যাটা হ’ল গিয়ে বংশের বাতি।ব্যাটা না থাইকলে বংশের
কি রইল শুনি!
অবাক চোখে শিবু ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে ছিল।
রেতে বউটারে সোহাগভরে কইছিল-
ফুলমণি-আমার ব্যাটা চাই,ব্যাটা।বংশের পিদিম-


ভাঙাঘরের টিনেরচালের ফুটো দিয়ে পূর্ণিমার আলো
এসে পড়ে ফুলমণির সদ্যজাত বিটির মুখে,
চাঁদপানার মতো মুখ,হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে।
আদর করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ফুলমণি।
হলই বা বিটি,বিটিই বা কম কিসে?
ওরে আমি পড়ামু-বড়ো হয়ে অনেক লেকাপড়া করবেক,
চাকরি করবেক।সকইলকে ডেকে কমু-
দ্যাখো-আমার বিটি কত বড়ো হইছে!
শিবুর মুখটা ভেসে উঠতেই থম্ মেরে যায় ফুলমণি।
না-মরদটারে সে কুথা দিয়ে কুথাটা রাইখ্তে পারে নাই।
মরদটা তার ব্যাটা চেয়েছিল,সে ব্যাটা দিতে পারে নাই।
তাই তার ঘরটাতে পিদিম জ্বলে নাই,অইন্‌ধোকার-
শুধুই অইন্‌ধোকার।


বিটিটার কান্না শুনে বাপের মনটা কেঁদে ওঠে,
ছুটে গিয়ে কোলে করতে চায়-আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে চায়-
উঠতে গিয়েও বসে পরে শিবু।দু’টো হাঁটুর ভাঁজে মাথাটা গুঁজে
চৌধুরীবাবুর কুথাটো ভাবে-
ব্যাটা তো সত্যিই পিদিম,ব্যাটা বড়ো হবেক-
কাজ করবেক,আমার মুতন কলের লাঙল চালাইয়ে
পয়সা কামাবেক,বাপ-মা রে খাতির করবেক-


ফুলমণি অবাক চোখে বিটিটার দিকে তাকায়,
বিটির চোখ দু'টো জ্বলজ্বল করে যেন ফুলমণিকে
দেখছে আর বলছে-
মা,আমি এসেছি-
তুমি খুশি হও লাই!বুঝেছি-
আমি বিটি,তাই!কিন্তু মা-তুমিও তো বিটি,
তুমার মা-ওতো বিটি,বাপের মা-
সে ওতো বিটিই ছিলো,তাহলে?
বিটিরা না জন্মালে
তুমাদের জন্ম হতো ক্যামনে?
দু'চোখ জলে ভরে ওঠে ফুলমণির।


ঢাকের শব্দে,বাজির শব্দে হুঁস ফেরে শিবুর।
দূরে আলোর রোশনাই,চৌধুরীবাড়ী সেজে উঠেছে,
আজ যে মায়ের বোধন!


ছুটে ঘরে ঢুকে শিবু বিটিকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে।
খিল্ খিল্ করে বিটি হাসে,ফুলমণি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
আনন্দে শিবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
শিবু কয়-
ফুলমণি,আমি ভুলটা বুঝতে পারিছি রে-
এখুন আমার কুনো রাগ নাই,
কুনো রাগ নাই।
চৌধুরীবাবুটা মোরে মিছে কুথা কইছিল বটে!
বিটি যদি পিদিম না হবেক তো চৌধুরীবাবুর বাড়িতে
এত্তো আলো ক্যানে?এত্তো বাদ্দি-এত্তো বাজি-
মা দুগ্গাও তো বিটি বটে!


ফুলমণি অবাক চোখে তার মরদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাপের কোলে বিটি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
বোধনের বাজনা বাজে,বোধন শুরু হয় চৌধুরীবাড়ীতে।