১৯৬৯ সালে "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে? ১৯৮১ সাল নাগাদ যার বিশ তম সংস্করন যখন মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় তখন তা একটি জাতির মুখের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে একটি দেশের স্বাধীনতার অনুপ্রেরনার মাইল ফলক হয়ে গিয়েছে l যার প্রথম লাইন ছিলোঃ- "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় l" কবি পরিচিতি দেওয়া বাতুলতা মাত্র l এ আসরের প্রখ্যাত কবি তালিকার অন্যতম নাম তিনি l কিন্তু এ লেখার কেন্দ্রবিন্দু তিনি নন,অন্য কেউ l তারই সমসাময়িক একজন যিনি ৭১ এবং পরবর্তী সময়কে হয়তো তেমনই দক্ষতায় ধরেছিলেন ফুলস্কেপে l কবির কথায় আসার আগে একটি ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি এটি শুধুমাত্র লেখার জন্য লেখা নয় l একটি আলোচনার পেছনে অধ্যবসায়,বিবেকের আবেগ এবং হৃদয়ের সমর্থন অবশ্যই জরুরী কিন্তু তা সবটুকু নয় l যাঁকে ঘিরে এই রচনার অবতারনা তিনি তাঁর কালখন্ড পেড়িয়ে দূরদর্শিতার সাবলীলত্বে এখনও যেহেতু সমসাময়িক ,তাই l কবিতা যেখানে নিজেই স্বতস্ফুর্তভাবে বাঙ্ময়,সেখানে কবির টুকরো কোলাজে কবি নিজেই কথা বলবেন l


              যখন লিখছি,তখন "বাতাসে লাশের গন্ধ",দুঃস্বপ্নে ও কাগজের শিরোনামে অনাবশ্যক একটি বিশ্বযুদ্ধের সাইরেন আর স্মৃতিতে উইনষ্টন চার্চিল এবং দ্য ফেমাস বেঙ্গল স্টারভেশন l চার লক্ষাধিক লোকের অনাহারক্লিষ্ট মৃতমুখ বলছেঃ-


      "আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
       প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি মৃত্যুর সুষ্পষ্ট প্রতিচ্ছবি
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে দীর্ঘ প্রতিক্ষায়
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে l "
  
বোধকরি কিশোর কবি সুকান্তের এই শেষতম লাইনটির অপেক্ষায় ছিলেন উত্তরসূরী l তিনি লিখলেনঃ-


     "আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
      আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে
এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত,সেই রক্তাক্ত সময় l"
  
             কবি পরিচিতি নিঃস্প্রয়োজন l নামটিই যথেষ্ট,রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ l কিন্তু কেন রুদ্র? আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষাপটে যখন তৃতীয় বিশ্বে চোখ রাখি,সুদূর বার্মা মুলুক হয়ে ভারত এবং বাংলাদেশ,-আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে খুব প্রয়োজন অনুভূত হয় একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনার রুদ্রের,যে অতীতের উত্তাল দিনগুলি স্মরণ করিয়ে জিজ্ঞেস করবেঃ-


"মনে পড়ে বট? রাজপথ,পিচ? মনে পড়ে ইতিহাস?
যেন সাগরের উতলানো জল নেমেছে পিচের পথে
মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভাঙ্গা জীবনের কুলে?
মনে কি পড়ে না,মনে কি পড়ে না,মনে কি পড়ে না তবু?...
গেরামের সেই শান্ত ছেলেটি কী রোষে পড়েছে ফেটে
বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত
সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিঁড়ে..
হাতিয়ারহীন,প্রস্তুতি নেই,এলো যুদ্ধের ডাক
এলো মৃত্যুর,এলো ধ্বংসের রক্ত মাখানো চিঠি
গ্রাম থেকে গ্রামে,মাঠ থেকে মাঠে গঞ্জের সুবাতাসে
সে চিঠি ছড়ায় রক্ত খবর,সে চিঠি ঝরায় খুন,
স্বজনের হাড়ে করোটিতে জ্বলে সে চিঠির সে আগুন l "


            স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত দলিলের যেমন কোনো সাহিত্যমূল্য হয়না তেমনই হয়না কোনো রঙের মেরুকরণ l কারন ত্যাগের আদর্শ ছিলো সার্বিকঃ-


"ভরা হাট ভেঙে গেলো,
মাই থেকে শিশু তুলে নিলো মুখ সহসা সন্দিহান,
থেমে গেলো দূরে রাখালের বাঁশি,পাখিরা থামালো গান
শ্মশান নগরী,খাঁ-খাঁ রাজপথে কাকেরা ভুললো ডাক
পড়ে রলো পাছে সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটে
পড়ে রলো ঘর,স্বজনের লাশ,উনুনে ভাতের হাঁড়ি
ভেঙে পড়ে রলো জীবনের মানে জ্বলন্ত জনপদে-
নাড়ি-ছেঁড়া উন্মুল মানুষের সন্ত্রাসে কাঁপা স্রোত
জীবনের টানে পার হয়ে গেলো মানচিত্রের সীমা l"


             কথায় আছে দ্বন্দ্ব করে মন্দ লোকে l কিন্তু ক্রমবিন্যাসে দ্বন্দ্ব যখন অন্তরদ্বন্দ্ব,একটি সম্প্রদায়,একটি জাতি,একটি দেশের উর্দ্ধে উঠে সমগ্র মানুষ তথা মানবতার কষ্ঠিপাথরে খাঁটি প্রমানিত হয়,সে দ্বন্দ্ব স্বাগতঃ-


    "হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই
     অশুভের সাথে আপোস বিহীন দ্বন্দ্ব চাই l "


       " শ্লোগান" কবিতায় শামসুর রাহমান যে কথাটি বলেছেন ঠিক একই ভাব ফুটে উঠেছে রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহের কবিতায় এবং সমসাময়িকতার প্রেক্ষাপটে দেশ কাল নির্বিশেষে যা অবশ্যই ইঙ্গিতবাহীঃ-


      "ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে
       চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তে তাদের
       আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে
       দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়
      আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ l"

            
                  বাংলা একটি পাঁচ হাজার বছরেরও বেশী সময়কালীন সংস্কৃতির ধ্রুপদী ধারা,যাঁর আবেগে থরোথরো ত্রিশ লক্ষ দক্ষ কারিগর এবং দশ লক্ষ ইজ্জতহারা মা বোনের অশ্রুমথিত আর্তনাদের প্রসব বেদনায় জন্ম যেই দেশের-তার অগনিত সন্তান রুদ্র'র মতো আরও সমসাময়িক কবির হাত ধরে এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিগুলির সাথে ফিরে ফিরে পরিচিত হোক l এক্ষেত্রে কবি ও কবিতার ভূমিকা অপরিসীম l মাননীয় অ্যাডমিন মহোদয়ের কাছে সবিনয়ে প্রস্তাব রাখবো রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ সহ ভাষা আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাথে সম্পৃক্ত কবিদের খ্যাতিমান কবি তালিকায় সংযুক্তিকরণের, যাতে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম জানতে সক্ষম হয় তার জাতিগত পরিচয় l