সূরা আবাসা‌
বিতারিত শয়তান থেকে আল্লার কাছে আশ্রয় চাইছি,
পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লার নামে শুরু করছি ।  


ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন তিনি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ;
যখন তার কাছে এক অন্ধ আগমন করলেন
হে নবী!তুমি কি জান, সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত
কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে সে উপকার পেত ।


পরন্তু যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল।
সে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার নেই কোন দোষ।
পক্ষান্তরে যে আপনার কাছে ছুটে আসে, ভয় করে,
আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন না হয়ে সন্তোষ


না, এটা মোটেই ঠিক না, এটা উপদেশবানী।
কাজেই যার ইচ্ছা এটি গ্রহণ করবে।
এটা লিখিত আছে মর্যাদাসম্পন্ন কিতাবসমূহে,
যা চিরকাল সমুন্নত, পবিত্র থাকবে


এমন লিপিকারের হাতের লেখা তা ,
যারা সদা মহা সম্মানিত, পূত-পবিত্র ;
মানুষ ধ্বংস হোক, সে কত অকৃতজ্ঞ
কোন বস্তু হতে তার সৃষ্টি যা অপবিত্র !
শুক্রবিন্দু থেকে তাকে সৃষ্টি করেছেন,
অতঃপর তাকে পরিমিতভাবে গড়ে তুলেন।
অতঃপর তার চলার পথ সহজ করেছেন
অতঃপর তাকে মৃত্যু দিয়ে কবরস্থ করেন।


আবার যখনই তিনি ইচ্ছা করবেন
তখন তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন ;
কখখনো নয় সে আল্লাহ‌র আদেশ অমান্য করেছিল ,
কর্তব্য পালন করেনি সে আল্লাহ যা হুকুম দিয়েছিল ।
মানুষ তার খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি দিক,
আমি প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি,
তারপর  ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি,
তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য অধিক ।
আঙ্গুর, শাক-সব্জি, যয়তুন, খেজুর,
আর ঘন উদ্যান।
নানা ফল ও ঘাস ,তোমাদের ও গৃহপালিত পশুর
জীবন ধারণের উপাদান ।


পরে যখন ঐ ধ্বংস ধ্বনি এসে পড়বে দিকে দিকে ,
সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে ;
তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে ,
সেদিন তারা  নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকবে প্রত্যেকে ।


সেদিন কতক মুখ হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল ,
আর কিছু মুখ হবে হতাশায় ধুলিমলিন তুল্য ;
মলিনতা তাদের ঘিরে আছে চারিধার ,
তারাই অবিশ্বাসী, করে পাপাচার ।


            *******


সূরা আবাসা‌ (আরবি ভাষায়: عبس‎) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ৮০ তম সূরা, এর আয়াত অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ৪২; এর রূকু তথা অনুচ্ছেদ ১ টি। সূরা আবাসা‌ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।
নামকরণ
এই সূরাটির প্রথম শব্দ عَبَسَ থেকে এই সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে; অর্থাৎ, যে সূরাটি عَبَسَ (‘আবাসা‌’) শব্দটি দ্বারা শুরু হয়েছে এটি সেই সূরা।[১]
নাযিল হওয়ার সময় ও স্থান
শানে নুযূল
মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, অত্র সূরাটি অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম সম্পর্কে (মক্কায়) নাযিল হয়। তিনি কোন একটি বিষয় জানার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক মুশরিক নেতার সাথে কথা বলছিলেন। এভাবে কথার মধ্যে কথা বলায় (অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উম্মে মাকতূম পীড়াপীড়ি করায়) রাসূল (ছাঃ) বিরক্ত হন এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঐ নেতার প্রতি মনোনিবেশ করেন, যাতে তিনি হেদায়াত প্রাপ্ত হন। তখন অত্র আয়াতসমূহ নাযিল হয়।


উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের কারণে তিরস্কারমূলক এই স্মরণীয় আয়াতগুলি নাযিল হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে খুবই সমাদর করতেন । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধে গমনকালে তাকে প্রায়ই মদীনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। জীবনীকারগণ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর, ওহোদ, হামরাউল আসাদ ও বিদায় হজ্জ সহ মোট ১৩ বার মদীনা ত্যাগকালে তাকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান। বেলাল তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান দিতেন এবং তিনি ফজরের আযান দিতেন। মূলতঃ এ সবই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে তাকে বিশেষ মর্যাদা দানের ফল। আর এই মর্যাদা দানের কারণ ছিল তার উপলক্ষে সূরার প্রথম আয়াতগুলি নাযিল হওয়া। নিঃসন্দেহে এটি ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। যতদিন দুনিয়া থাকবে ও কুরআনের পাঠক থাকবে, ততদিন মানুষ অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের নাম স্মরণ করবে। এই সৌভাগ্য হযরত আবুবকর (তওবা ৯/৪০), আয়েশা (নূর ২৪/১১-২৬) ও যায়েদ বিন হারেছাহ (আহযাব ৩৩/৩৭) ব্যতীত আর কারো হয়নি।


বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
আপাতদৃষ্টিতে ভাষণের সূচনায় যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা দেখে মনে হয় , অন্ধের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন ও তার কথায় কান না দিয়ে বড় বড় সরদারদের প্রতি মনোযোগ দেবার কারণে এই সূরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে তিরস্কার ও তাঁর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো সূরাটির সমস্ত বিষয়বস্তুকে একসাথে সামনে রেখে চিন্তা করলে দেখা যাবে , আসলে এখানে ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে কুরাইশদের কাফের সরদারদের বিরুদ্ধে। কারণ এই সরদাররা তাদের অহংকার , হঠধর্মিতা ও সত্য বিমুখতার কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যের দাওয়াতকে অবজ্ঞা ও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছিল। এই সংগে এখানে নবীকে তাঁর সত্য দীনের দাওয়াত দেবার সঠিক পদ্ধতি শেখবার সাথে সাথে নবুওয়াত লাভের প্রথম অবস্থায় নিজের কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে তিনি যে পদ্ধতিগত ভুল করে যাচ্ছিলেন তা তাকে বুঝানো হয়েছে । একজন অন্ধের প্রতি তাঁর অমনোযোগিতা ও তার কথায় কান না দিয়ে কুরাইশ সরদারদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কারণ এ ছিল না যে , তিনি বড়লোকদের বেশী সম্মানিত মনে করতেন এবং একজন অন্ধকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন , নাউযুবিল্লাহ তাঁর চরিত্রে এই ধরনের কোন বক্রতা ছিল না যার ফলে আল্লাহ তাঁকে পকড়াও করতে পারেন । বরং আসল ব্যাপার এই ছিল , একজন সত্য দীনের দাওয়াত দানকারী যখন তাঁর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দৃষ্টি চলে যায় জাতির প্রভাবশালী লোকদের দিকে। তিনি চান , এই প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করুক। এভাবে তাঁর কাজ সহজ হয়ে যাবে। আর অন্যদিকে দুর্বল , অক্ষম ও সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তিহীন লোকদের মধ্যে তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লেও তাতে সমাজ ব্যবস্থায় কোন বড় রকমের পার্থক্য দেখা দেয় না। প্রথম দিকে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও প্রায় এই একই ধরণের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর এই কর্মপদ্ধতি গ্রহণের পেছনে একান্তভাবে কাজ করেছিল তাঁর আন্তরিকতা ও সত্য দীনের দাওয়াতকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার প্ররণা । বড়লোকদের প্রতি সম্মাবোধ এবং গরীব , দুর্বল ও প্রভাবহীন লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার ধারণা এর পেছনে মোটেই সক্রিয় ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে বুঝালেন , এটা ইসলামী দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং এই দাওয়াতের দৃষ্টিতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বের অধিকারী , যে সত্যের সন্ধানে ফিরছে , সে যতই দুর্বল , প্রভাবহীন ও অক্ষম হোক না কেন আবার এর দৃষ্টিতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বহীন , যে নিজেই সত্যবিমুখ , সে সমাজে যত বড় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন। তাই ইসলামের দাওয়াত আপনি জোরেশোরে সবাইকে দিয়ে যান কিন্তু যাদের মধ্যে সত্যের গ্রহণ করার আগ্রহ পাওয়া যায় তারাই হবে আপনার আগ্রহের আসল কেন্দ্রবিন্দু । আর যেসব আত্মম্ভরী লোক নিজেদের অহংকারে মত্ত হয়ে মনে করে , আপনি ছাড়া তাদের চলবে কিন্তু তারা ছাড়া আপনার চলবে না , তাদের সামনে আপনার এই দাওয়াত পেশ করা এই দাওয়াতের উন্নত মর্যাদার সাথে মোটেই খাপ খায় না।


সূরার প্রথম থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত এই বিষয়বস্তুই আলোচিত হয়েছে । তারপর ১৭ আয়াত থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী কাফেরদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে । তারা নিজেদের স্রষ্টা ও রিযিকদাতা আল্লাহর মোকাবিলায় যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল প্রথমে সে জন্য তাদের নিন্দা ও তিরস্কার করা হয়েছে । সবশেষে তাদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে , কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের এই কর্মনীতির অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণাম দেখতে পাবে।