চলন্ত ট্রেনের কামরায় দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসেছিলো লোকটা।
ময়লা জামাকাপড়, জটপড়া চুল, ঠান্ডার কামড় থেকে বাঁচতে গামছাটা কানমাথা জড়িয়ে বাঁধা।
খালি পা, খড়ি ওঠা গা, ঘোলাটে দৃষ্টি! কে জানে, নেশাভাঙ করে হয়তো!
ও শুরু করেছিলো ওর অতীত জীবনের স্বছ্ছলতার কাহিনী দিয়ে-
একটা সুখী ছোটো সংসার ছিলো নাকি ও'র- ছিলো মানে, সংসারটা এখনও আছে; সুখটাই যা নেই।
হয় রংমিস্ত্রী, নয় রাজমিস্ত্রী, এই গোছের কিছু একটা কাজ করতো (কে জানে, সত্যি কিনা !); তারপর একদিন নাকি অনেক উঁচু বাঁশের ভারার উপর থেকে পড়ে ও'র বাঁ পা টা ---!!
আমি আড়চোখে, উদাসীন দৃষ্টিতে একঝলক দেখে নিলাম ও'র ক্ষতিগ্রস্ত পা টা; সত্যি বলতে কি, অস্বাভাবিক কিছু মনে হ'ল না...
লোকটা বলেই চলেছিলো - এখন ও'র কোনো রোজগার নেই, তাই ও'র সংসারটার দশাও হয়েছে ও'র বাঁ পা'র মতই - খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে;
তবে ও'র কষ্টের আসল জায়গাটা ও'র ছেলে, ও'র একমাত্র ছেলেকে ঘিরে, ও'র অচল পা'র জন্য যার লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে!
সেই কারনেই, হ্যাঁ, শুধুমাত্র সেই কারনেই, চলন্ত ট্রেনে আমাদের মত সহৃদয়, বিবেকবান সহনাগরিকদের কাছে ও হাত পেতে দিয়েছে;
আমি মনে মনে বাঁকা হাসি... রাসকেল ! রোজগারের কত ফন্দি-ফিকিরই না জানে !
উপেক্ষা করবো করবো করেও কিছুতেই লোকটা কে মন থেকে ঠেলে ফেলতে পারছিলাম না - পোস্তদানার মত মনটা গুনগুন করছিলো-
হাজার হোক, একটা শিশুর শিক্ষা পাওয়ার প্রশ্ন; শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি...
অগত্যা, খুচরো পয়সা, কারেন্সি নোট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডে ঠাসা আমার পেটমোটা টাকার ব্যাগটা হাতড়ে একটা পাঁচটাকা...না, না, দুটাকা...না, একটাকার কয়েন লোকটার বাড়িয়ে ধরা আগ্রহী হাতের উপর নিরাপদ দূরত্ব থেকে নিক্ষেপ করি এবং সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিতে পেরে, আমার জাগ্রত বিবেকের পিঠ চাপড়ে দিয়ে খানিকটা শ্লাঘা অনুভব করি।
লোকটা ততক্ষণে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে ... "ও দাদা, ও মাসীমা, ও কাকা, আমার জন্য চাইছি না; শুধু আমার ছেলেটার পড়াশোনার জন্য......" !!