আমি বিনিতা।
শুয়ে আছি লাশকাটা ঘরে
ময়না তদন্তের অপেক্ষায়।
যদি অনুমতি দাও,
আমার কাহিনী তোমাদের শোনাতে চাই।
                        ★
প্রথম যেদিন শ্বশুরবাড়ি গেলাম...
সে বাড়ির লোকের কাছে দুর্ব্যবহারই পেলাম।
পিসিশাশুড়ি বললো আমায়...
"বৌমা, তোমার গয়নাগুলো বড্ড বেশী হালকা!
তোমার বাবা কিন্তু দেয়নি এখনো পণের পুরো টাকা!
যাবে যখন অষ্টমঙ্গলায়...
বাবাকে বলো,
টাকাগুলো যেন দিয়ে যায়।
আর হ্যাঁ! খোকার জন্য চাই
একখানা চার-চাকা গাড়ি।
বাবাকে বলো,
সেটা দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।"
                          ★
ওদের কথায় কান দিইনি তেমন।
তুমিই তো মা বলেছিলে,
"একটু সহ্য করিস কেমন!
শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মান-সম্মান দিবি...
ছোট-খাটো ঝুট-ঝামেলা মানিয়ে-গুছিয়ে নিবি।"
বাবা বলেছিল....
"মা আমার...লক্ষী হয়ে থাকিস,
বুড়ো বাপ-মায়ের মর্যাদাটা রাখিস!
মান্য করিস ওদের কথা,
যা বলবে স্বামী-শাশুড়ি;
সংসারে সুখ পেতে হলে
এডজাস্টমেন্টটা খুব জরুরী।"
                            ★
তোমাদের কথামতোই ছিলাম লক্ষী হয়ে...
দিন-রাত্তির কটু কথার গঞ্জনা সয়ে সয়ে!
কথা ছিল,
বিয়ের পরে গ্র্যাজুয়েশনটা করবো!
সারাদিনের কাজের শেষে বই-খাতাটা পড়ব!
শ্বাশুড়ি মা ধমক দিয়ে বললেন...
"এটা ভদ্রবাড়ি, লেখাপড়া নিয়ে দেখছি
তোমার বড্ড বাড়াবাড়ি!
এ বাড়ির আদব-কায়দাগুলো শেখো!
সমাজে আমাদের মান আছে,
সেটা মাথায় রেখো!
আর শোনো,এখানে তোমার
কোনো কথা চলবে না!
আমার কথার উপর তুমি
কোনো কথা বলবে না!"
                          ★
জানো মা,তোমার জামাইটিও কেমন যেন;
বুঝতে পারি না!
আমার প্রতি অন্যায়ে সে রা-টি কাড়ে না!
সেদিন জানো খুব কেঁদেছি!
তবু কাউকে বুঝতে দিইনি...
এডজাস্টমেন্টটা শিখে গেছি মা!
আমি যে তোমার বিনি!
কতবার ভেবেছিলাম, তোমায় বলবো সব...
বুকের ভেতর যন্ত্রনাটা করবো খানিক লাঘব!
বলি বলি করেও তোমায় কিচ্ছু বলিনি।
ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে,
বাবার শরীর তো ভালো নেই মা
অযথা শুনে কষ্ট পাবে!
                         ★
এমনি করেই মন্দ-ভালোই কাটছিল মা দিন!
গলির মোড়ে পলির সাথে দেখা হলো সেদিন।
চিনতে পারলে মা পলিকে?
আমার কলেজের বান্ধবী...
পলি বললো--
"আর যাই হোক,ফাইনালটা দিবি।
আমিও তো বি.এড.দিলাম শ্বশুরবাড়ি এসে।
ওরা ভীষন সাপোর্রটিভ,
মেয়ের মতোই ভালোবাসে।"
মাগো! পলির মতো শ্বশুরবাড়ি আমি পেলাম কই?
ওর মতো ভাগ্যবতী হয়তো আমি নই!
তবু পলির কথা শুনে,
আবার পড়ায় মন দিলাম!
দিনে-রাতে গাল-মন্দ সহ্য করেই গেলাম।
আমার ওপর অত্যাচার বাড়ছিল দিনে দিনে!
না পেরে তো সেদিন তোমায়
বলেছিলাম ফোনে!
তুমি বললে--
"পাগলী মেয়ে, সংসার বলে কাকে?
একটু-আধটু খিটি-মিটি ওসব হয়েই থাকে।
দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে রে মা!
নিজের কথাই ভাবলি শুধু?
সন্তানের কথা ভাবলি না?"
                             ★
মাগো! তোমরা কেউই আমার কথা বুঝলে না!
আমার ভয়ের কারণটাও তোমরা একটু খুঁজলে না?
বলো, তোমায় কেমন করে বোঝাই?
ওরা আমার পেটের সন্তান হত্যা করতে চায়!
কন্যা-সন্তান চাননা তাঁরা,
তাঁদের চাই বংশধর....
বলতে পারো মা!
কোথায় থাকেন ঈশ্বর?
আচ্ছা মা! মেয়েদের কেন
পরের ঘরে যেতে হয়?
শ্বশুর-বাড়ি,বাপের-বাড়ি
কোনটাই কি আমার নয়?
                         ★
মুখ বুজে সহ্য করেই ছিলাম
দাঁত-কপাটি চেপে,
হঠাৎ সেদিন পায়ের তলার
মাটি উঠলো কেঁপে!
আচমকাই শ্বাশুড়ি-মা
ধরলো চুলের মুঠি!
স্বামী আমার সজোরে
চেপে ধরলো টুঁটি!
চেঁচিয়েছিলাম প্রানপনে
"বাঁচাও বাঁচাও" বলে!
শেষ রক্ষা হলো না মা....
তোমার বিনি নেতিয়ে পড়লো
মরণেরই কোলে!
তারপর কি হলো...
আর তো জানিনা!
কি অপরাধ ছিল আমার--
বলতে পারো মা?
                            ★
মাগো!
তোমার আদরের বিনি
এখন লাশকাটা ঘরে,
ময়নাতদন্তের অপেক্ষায়!
মৃত্যুসংবাদ পেয়েছ বুঝি?
সকলে এসেছো তাই!
বড্ড দেরী করলে মা,
কেঁদে আর কি হবে ?
বাঁচার মতো বাঁচতে মেয়েরা
শিখবে বলো কবে ?
এ সমাজে কেন মেয়েরা
প্রাপ্য অধিকার পায় না?
অনুরোধ করি মা,
বোনের জন্য একটু ভেবো,
আর তো কিছুই চাই না!
আমার মতো যেন না হয়
কারোর পরিনতি!
মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখুক
শুধু এইটুকু,
শুধু এইটুকু মিনতি!!
-------------------------------------
✍️সুলেখা রায়।(ভারতবর্ষ)
                        
(আমার কবিতায় বিনি একটি কাল্পনিক চরিত্র..... সে কারো কন্যা, আবার কোন বাড়ির বৌমা। সমাজে অভিশপ্ত পণ-প্রথা আজো অব্যাহত... প্রতিনিয়ত বধূ-হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। এই লেখাটি সেই মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে, যাঁরা মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে যে কোনো পরিস্থিতিতে এডজাস্ট করে থাকার পরামর্শ দেন..... তাঁদের কাছে অনুরোধ.... মেয়েদের পাশে থাকুন, বিনীতারা যেন এভাবে অকালে হারিয়ে না যায়.. প্রত্যেকটি মেয়ে যেন পলির মতো শ্বশুরবাড়ি পায়... এবং প্রত্যেক শ্বশুরবাড়ি বৌমাদের মেয়ের মতোই আপন করে নিতে পারে। )🙏
--------------------------------------------