সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কবিতাwww.bangla-kobita.com ওয়েবসাইটে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর প্রকাশিত কবিতাসমূহ।uuid:2782cc4c-711d-4403-b8f7-50c47540831c;id=6792024-03-28T14:40:08Zhttps://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/barthotar/ব্যর্থতার তীব্র টান2024-01-19T17:12:53-05:002024-01-19T17:12:53-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>একটা সীমানাহীন ধূ ধূ গেরুয়া রঙের প্রান্তরে, একা, খুব একা<br />শীতে কালাে রঙের চাদর মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে আছে আমার কৈশাের<br />তার ওষ্ঠে লেগে আছে ব্যর্থ প্রেমের বিষাদ, চোখ দুটি ঈষৎ ঝাপসা<br />দিগন্ত জোড়া আকাশে আকাশে ছড়িয়ে আছে তার অভিমানের লাবণ্যময় আভা<br />এই সুন্দর ছবিটি আমি দেখছি দূর থেকে, বহু বছর পেরিয়ে<br />বুকে ব্যথা হয় না, এখন অনায়াসে কৌতুক করা যায়<br />ব্যর্থ প্রেমের আগে সত্যিই কি প্রেম ছিল? সেই বয়ঃসন্ধির সময়ে<br />আগুন জ্বলত অনবরত, কাঠকুটোর অভাবে আমি নিজেই কি<br /> একদিন আহুতি দিইনি এক কিশােরীকে?<br />অসংখ্য চিঠির প্রতিটি শব্দই কি আসলে অস্ত্রে শান দেওয়া নয়?<br />অথচ নিজেও তাে হাত পুড়িয়েছি বারবার, সেই কিশােরীটির জন্য<br /> হৃৎপিণ্ড উপড়ে দিতেও রাজি ছিলাম<br /> না?<br />তবু কোথায় যেন ছিল সার্থকতার চেয়ে ব্যর্থতার প্রতি তীব্র টান<br />এক নদীর কথা মনে পড়ে, বারবার ফিরে আসে কবিতায়, <br /> তবু<br /> সেই নদীকেও তাে অনায়াসে ছেড়ে এসেছি<br />নদীকে এত ভালােবাসতাম, তার জলে শরীর মিশিয়ে তাে থাকত চাইনি সারা জীবন<br />ব্যর্থ প্রেম কি তবে নিজেরই অজান্তে এক গােপন স্বার্থপরতা?<br />দূর থেকে সেই কৈশােরের ছবিটি দেখি, হঠাৎ শুনতে পাই<br /> পাহাড় কাঁপানাে এক নিদারুণ হাহাকার</p>
<br /><p>অমনি আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়,<br />আমার হাত থেক খসে পড়ল কলম।। </p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ-<br />"সেই মুহূর্তে নীরা"</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sri/স্মৃতির শহর ২২2024-01-19T17:08:22-05:002024-03-21T04:03:22-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কৈশোর ভেঙেছে তার একমাত্র গোপন কার্নিশ <br />কৈশোরই ভেঙেছে<br />ভেঙে গেছে যত ঢেউ ছিল দূর আকাশগঙ্গায়<br />শত টুকরো হয়ে গেছে সোনালি পিরিচ<br />সে ভেঙেছে, সে নিজে ভেঙেছে<br />পাথরকুচির আঠা দুই চোখে লেগেছিল তার<br />রক্ত ঝরে পড়েছিল হাতে<br />তবুও সমস্ত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে এসে<br />পা সেঁকে নিয়েছে গাঢ় আগুনের আঁচে<br />কৈশোর ভেঙেছে সব ফেরার নিয়ম<br />যে-রকম জলস্তম্ভ ভাঙে<br />কৈশোর ভেঙেছে তার নীল মখমলে ঢাকা অতিপ্রিয় পুতুলের দেশ<br />সে ভেঙেছে অনুপম তাঁত<br />চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন প্রতিষ্ঠান, চুন, সুর্কি ধুলো<br />মৃত পাখিদের কলকণ্ঠস্বর উড়ে গেছে হাওয়ার ঝাপটে<br />যেখানে বরফ ছিল সেখানেই জ্বলছে মশাল<br />যেখানে কুহক ছিল সেখানে কান্নার শুকনো দাগ<br />এখনও স্নেহের পাশে লেগে আছে ক্ষীণ অভিমান<br />আয়নায় যাকে দেখা, তাকেই সে ভেঙেছিল বেশি<br />কৈশোর ভেঙেছে সব, কৈশোরই ভেঙেছে<br />যখন সবাই তাকে সমস্বরে বলে উঠেছিল, মা নিষাদ<br />সেইক্ষণে সে ভেঙেছে, তার নিজ হাতে গড়া ঈশ্বরের মুখ…</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/jodi-konodin/যদি কোনোদিন2024-01-17T04:20:00-05:002024-02-23T20:00:51-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যদি কোনোদিন একা তুমি যাও কাজলা দিঘিতে <br />যখন বিকেল আসন্ন শীতে মন্থর-বেগ, <br />দেখবে কত না রহস্য আছে এই পৃথিবীতে <br />কত স্বল্পের অচেনা আকাশ ছায়াময় মেঘ।</p>
<br /><p>দেখবে সেখানে বনের বর্ণ মহা সমারোহে <br />শব্দে মিশেছে। নদীর জোয়ার বাতাসের গানে <br />বিকেলের ঘ্রাণ ঘুমের মতন অপরূপ মোহে <br />ছড়াবে তোমার চোখের মৌনে-অস্ফুট প্রাণে।</p>
<br /><p>তুমি ভুলে যাবে আপন স্বরূপ, ভাববে আকুল <br />এ পরীর, মন, আভাস-উদাস-দু'চোখ এ কার? <br />এ কার আকাশ, পাখি, মেঘ, বন, নতুন মুকুল <br />এতদিন পরে তোমার হৃদয়ে কোন্ ঝংকার।</p>
<br /><p>যদি কোনোদিন একা তুমি যাও কাজলা দিঘিতে <br />হয়তো আবার বাঁচতে চাইবে এই পৃথিবীতে।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/kumari/কুমারী মেয়েরা, কবিতা পড়ে না2024-01-17T02:13:59-05:002024-02-01T11:49:59-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কুমারী মেয়েরা, কবিতা পড়ো না, বিপদে পড়বে<br />যে-বয়সে মেঘ বেশী ডাকে তার আকাশ অন্য<br />কবিতার বই ভুলেও ছুঁয়োনা, আঙুল পুড়বে<br />কবিরা নিজেরা স্বেচ্ছায় জ্বলে লেখার জন্য।</p>
<br /><p>সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে উঠে হঠাৎ দাঁড়িয়ে <br />কী শুনলে তুমি ? কে যেন ডাকছে অচেনা গলায়<br />কেউ নেই তবু হাওয়াও জড়ায় দু'হাত বাড়িয়ে<br />মেঘ ভাঙা চাঁদ তোমাকে ভোলায় ছলায় কলায় ।</p>
<br /><p>যারা কাছাকাছি, সব বড় চেনা চোখের চাহনি<br />এক এক সময় স্নেহ তেতো লাগে, দপ করে জ্বলো<br />যখন যা আসে সব ভুল, তুমি কিছুই চাওনি<br />বাথরুমে গিয়ে আয়নার ঠোঁটে সব কথা বলো।</p>
<br /><p>কুমারী মেয়েরা, কবিতা পড়ো না, ছুঁয়ো না ও বই<br />ছেলেরা পড়ুক, চিঠিতে দিক না খাসা উদ্ধৃতি<br />বুঝে বা না বুঝে বন্ধুরা মিলে করো রৈ রৈ<br />কোনো একদিন সেই হাসিটাই হয়ে যাবে স্মৃতি।</p>
<br /><p>যে-সব নারীরা আড়ালে, অচেনা নদীর মতন<br />কবিরা তাদেরই মূর্তি গড়ার ভাষা খুঁজে মরে<br />তাদের লুকোনো দুঃখে থাকে না ছন্দপতন<br />নির্মাণ খেলা সারাটা জীবন কালো অক্ষরে ।</p>
<br /><p>কুমারী মেয়েরা, বিপদটাকেও আচারের মতো<br />চেখে নিতে চাও চকিতে একলা দুপুরের দিকে ?<br />চাখো তবে, দায়ী করো না কিন্তু, হও সম্মত<br />এমন মধুর সর্বনাশের জন্য কবিকে !</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/bondhubandhop/বন্ধুবান্ধব2024-01-14T10:16:46-05:002024-01-14T10:16:46-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>চলাে দীপক, আর একবার ধলভূমগড়ে যাই <br />বালিশ দিয়ে চোখ চাপা, শক্তি বলল <br /> ভাস্করটাকে নেবে না? শংকর, শংকর, তুই এবার অন্তত চল, কোনােদিন যাসনি <br />দু'হাত নেড়ে শংকর বলল, ট্রেন আমার সহ্য হয় না<br />শক্তি ওকে লাথি কষিয়ে বলল, দে শালা সিগারেট<br />সন্দীপন মিচকি হাসছে, ও নিজে যা করতে পারে না <br /> শক্তিকে তা করতে দেখলে দুশাে মজা পায়<br />শরৎ চাপড়ে দিল তারাপদ’র কাঁধ, বাদাম ওড়াচ্ছে সমরেন্দ্র <br />পলিমাটির মতন সরল মুখ করে শ্যামল বলল,<br /> তােরা আমায় নিবি না?<br />সবাই জানে, নিতে চাইলেও শ্যামল যাবে না, এক্ষুনি <br />শেষ ট্রেনে পাড়ি দেবে চম্পাহাটি<br /> পেটি বুর্জোয়া রয়ে গেলি, ক্লাস ষ্ট্রাগল<br /> কিছুই বুঝলি না <br />দীপেনের থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বিমল বলল, মান্তু, মান্তু, <br /> আমি ভাই আমার বউকে নিয়ে যেতে পারি?<br />সবাই সমস্বরে বলে উঠল, না, না, না... </p>
<br /><p>আমি সমীর রায়চৌধুরীকে বললাম, আর কেউ না যাক <br /> তুই আর আমি যাচ্ছিই<br />পাশ থেকে ভুস করে মাথা তুলে শক্তি বলল, আমাকে <br /> বাদ দেবে, অ্যাঁ <br /> সব ভুষ্টিনাশ করে দেব<br />ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বলাে তাে, ধলভূম জায়গাটা ঠিক কোথায়? <br />ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে শক্তি বলল, সবাই জানে,<br /> মেঘালয়ের একেবারে বুকের মধ্যে<br />সেখান থেকে ধলভূম পালিয়ে গেল না উত্তর কাশীতে? <br />বিশাখাপত্তনেও একদিন ধলভূমগড়কে দেখেছি<br />কে যেন বলল, ধলভূমগড়ের নাম বদলে এখন<br /> হয়ে গেছে চাঁইবাসা<br />তারপর আবার এফিডেভিট করে হয়েছে দিকশূন্যপুর <br />বিসর্জনের বাজনার সঙ্গে একলা একলা গান গাইছে দীপক <br />দীপেন আর বিমল বেশ অনায়াসে কাঁধ ধরাধরি করে <br /> হাঁটছে কুয়াশার মধ্যে<br />যেখানে জঙ্গল ছিল, সেখানে পাথর ফাটছে, নদীর ধারে <br /> শক্তি বসে আছে জলে পা ডুবিয়ে<br />চমৎকার জ্যোৎস্না ছিল, হঠাৎ নদীটা উত্তাল হয়ে<br />ছাপিয়ে যেতে লাগল দু'তীর <br />আঃ এত অন্ধকার কেন? এটা কি ব্রহ্মপুত্র নাকি?<br />দাঁড়া, শংকর, আমি উঠে এসে আলাে জ্বালছি।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থ- ভোরবেলার উপহার )</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/at-the-top-of-the-hill/পাহাড় চূড়ায় 2022-12-15T15:34:38-05:002024-01-17T17:17:13-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।<br />কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।<br />যদি তার দেখা পেতাম,<br />দামের জন্য আটকাতো না।<br />আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,<br />সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।</p>
<br /><p>কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।<br />পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।<br />তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই<br />কিনতাম।<br />কারণ, আমি ঠকতে চাই।</p>
<br /><p>নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।<br />ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,<br />ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।<br />সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।<br />শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।<br />আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার<br />কাছে মাপে ছোট লাগলো। প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।<br />বন্ধুরা বললো, ঐটুকু<br />একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়<br />একটা নদী পেয়েছিস?<br />খুব জিতেছিস তো মাইরি!<br />তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।<br />তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।<br />নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।<br />যেমন, বলো তো, আজ<br />সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?<br />সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।<br />শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,<br />সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!<br />আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,<br />সে জানতো! সবাই জানে।<br />শৈশবে আর ফেরা যায় না।</p>
<br /><p>এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।<br />সেই পাহাড়ের পায়ের<br />কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ<br />কঠিন পাহাড়।<br />একেবারে চূড়ায়, মাথার<br />খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,<br />চরাচরে তীব্র নির্জনতা।<br />আমার কষ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।<br />আমি ঈশ্বর মানি না, তিনি আমার মাথার কাছে ঝুঁকে দাঁড়াবেন না।<br />আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,<br />প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-<br />এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।<br />এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।<br />হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।<br />আমাকে ক্ষমা করো।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/na-pathano-chitti/না-পাঠানো চিঠি2022-07-14T07:40:25-04:002023-06-27T09:31:27-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>মা, তুমি কেমন আছ?<br />আমার পোষা বেড়াল খুনচু, সে কেমন আছে<br />সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়<br />দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়<br />মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?<br />তুলিকে আমার ড়ুরে শাড়িটা পরতে বলো<br />আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়<br />তুলিকে কত মেরেছি, আর কোনওদিন মারব না<br />আমি ভালো আছি, আমার জন্য চিন্তা করো না<br />মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খড় দিয়েছ?<br />এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব<br />তরফদারবাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে?<br />কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?<br />একবার মেঘের ডাক শুনে কই মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়<br />আমি আমগাছ তলায় দুটো কই মাছ ধরেছিলাম<br />তোমার মনে আছে, মা?<br />মনে আছে, আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল<br />চুরি করে আনিনি, মাটিতে পড়েছিল, কেউ দেখেনি<br />নারকোল বড়ার সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।<br />আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করত<br />বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল আমাকে<br />আমার কী দোষ, কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি?<br />আমার পিঠে এখনও সেই দাগ আছে<br />আলি সাহেবদের বাগানে আর কোনওদিন যাইনি<br />আমি আর কোনও বাগানে যাই না।<br />সেই দাগটায় হাত বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে<br />বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়<br />আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি<br />বাবা যেন আমার জন্য একটুও না ভাবে<br />তুলি কি এখনও ভূতের ভয় পায়?<br />তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলাবউ দেখেছিলাম<br />সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হল<br />দাদা সেই কলাগাছটা কেটে ফেলল<br />আমি কিন্তু ভয় পাইনি, তুলিকে কত ক্ষেপিয়েছি<br />আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলাবউ দেখতে ইচ্ছে করে<br />হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনও কাজ পেয়েছে?<br />নকুড়বাবু যে বলেছিল বহরমপুরে নিয়ে যাবে<br />দাদাকে বলো, ওর ওপর আমি রাগ করিনি<br />রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট<br />আমার শরীরে আর দাগ নেই, আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না<br />মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই<br />হোটেল থেকে দু’ বেলা আমার খাবার এনে দেয়<br />মাংস মুখে দিই আর তুলির কথা, কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে<br />তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না<br />আমি আলু পটলের তরকারি খাই, পটল ভাজাও খাই<br />হোটেলে কিন্তু কক্ষনও শাক রান্না হয় না<br />পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক<br />কী ভালো, কী ভালো, বিনা পয়সায়<br />কোনওদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না<br />জোর হাওয়া দিলে তালগাছের পাতা সরসর করে<br />ঠিক বৃষ্টির মতন শব্দ হয়<br />এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে, ঢিপ ঢিপ করে তাল পড়ে<br />বাড়ির তালগাছ দুটো আছে তো?<br />কালু তালের বড়া বড় ভালোবাসে, একদিন বানিয়ে দিয়ো<br />তেলের খুব দাম জানি, তবু একদিন দিয়ো<br />আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ’ হাজার টাকা পেয়েছিলে<br />তা দিয়ে একটা গোরু কেনা হয়েছে তো?<br />সেই গোরুটা ভালো দুধ দেয়?<br />আমার মতন মেয়ের চেয়ে গোরুও অনেক ভালো<br />গোরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়<br />গোরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়<br />বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা<br />দু’ বেলা ভাত দাও রে, শাড়ি দাও রে, বিয়ের জোগাড় করো রে<br />হাবলু, মিজান, শ্রীধরদের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে<br />আমি কি বুঝি না, সব বুঝি<br />কেন আমায় বিক্রি করে দিলে, তাও তো বুঝি<br />সেই জন্যই তো আমার কোনও রাগ নেই, অভিমান নেই<br />আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পরে আছি<br />তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিয়ো ঠিকঠিক<br />কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিয়ো<br />তুলিকে ব্ৰজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো<br />তুমি একটা শাড়ি কিনো, বাবার জন্য একটা ধুতি<br />দাদার একটা ঘড়ির শখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে?<br />আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, সোনার দুল গড়িয়েছি<br />একদিন কী হল জানো, মা<br />আকাশে খুব মেঘ জমেছিল, দিনের বেলা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার<br />মনটা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠল<br />দুপুরবেলা চুপি চুপি বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম<br />স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিকশা<br />খুব ইচ্ছে হল, একবার বাড়িটা দেখে আসি<br />রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল<br />কে যায়, কে যায়?<br />দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা<br />আমাকে বলল, হারামজাদি, কেন ফিরে এসেছিস?<br />আমি ভয় পেয়ে বললাম, ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি<br />একবার শুধু দেখতে এসেছি<br />হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্যে মাগি<br />কী করে জানল বলো তো, তা কি আমার গায়ে লেখা আছে?<br />আর একটা ছেলে, চিনি না, বলল, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম<br />হাবলু রিকশাঅলাকে চোখ রাঙিয়ে বলল, ফিরে যা<br />আমি বললাম, দাদা, আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি<br />আর তুলির জন্য…<br />দাদা টেনে এক চড় কষাল আমার গালে<br />আমাকে বিক্রির টাকা হক্কের টাকা<br />আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা<br />দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর<br />আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল<br />আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি<br />দাদা তো ঠিকই করেছে, আমি তো আর দাদার বোন নই<br />তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই<br />আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে<br />না, না, আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো<br />গোরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক<br />পুকুরে মাছ হোক, খেতে ধান হোক, ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক<br />আর কোনওদিন ওই গ্রাম অপবিত্র করতে যাব না<br />আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি<br />দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি<br />আলমারি ভর্তি কাচের গেলাস<br />বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি<br />এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে<br />তা হলেই বুঝছ, কেমন আরামে আছি আমি<br />আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা<br />তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে, আমি আর মা পাব কোথায়?<br />সেই জন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা<br />তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে<br />তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল<br />যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা…<br />তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো<br />তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়<br />যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিয়ো<br />ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ<br />আর যদি কোনওরকমেই ওর বিয়ে দিতে না পারো<br />ওকে বলো, গলায় দড়ি দিয়ে মরতে<br />মরলেও ও বেঁচে যাবে!<br />না, না, না, এ কী অলুক্ষণে কথা বলছি আমি<br />তুলি বেঁচে থাকুক, আর সবাই বেঁচে থাকুক<br />তুলির বিয়ে যদি না হয় না হোক<br />হে ভগবান, গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না?<br />বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে?<br />দু’ পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক<br />মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে<br />আরও দূরে, আরও দূরে, যেদিকে দু’ চোখ যায়<br />এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে, কোথাও না কোথাও আছে<br />যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন<br />আঁচড়ে দেয় না, কামড়ে দেয় না, গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না, লাথি মারে না<br />যেখানে একটা মেয়ে, শুধু মেয়ে নয়, মানুষের মতো বাঁচতে পারে<br />মা, তুমি আমার মা, আমি হারিয়ে গেছি<br />তুলিকে তুমি… তুলি যেন… আমার মতন না হয়!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ সেই মুহূর্তে নীরা। প্রকাশকালঃ ১৯৯৭। প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত) এবং কবিতাসমগ্র ৪। প্রকাশকালঃ ২০০৮। প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sthir-shotto/স্থির সত্য2021-12-17T15:49:34-05:002024-03-03T04:17:50-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>বহুদিন আকাশ ভাসানো জ্যোৎস্নায়<br /> হেঁটে যাইনি<br /> নদীর কিনারায়<br />একটি ঘাসফুল ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিইনি স্রোতে<br />বহুদিন, বহুদিন--<br />তবু আমি জানি<br /> এখনো কোনোদিন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় আকাশ<br /> আমার জন্য প্রতীক্ষা করে<br />নদীর কিনারার মাটি প্রতীক্ষা করে আছে<br /> আমার পদস্পর্শের<br />ঘাসফুলটি হাওয়ায় দুলছে প্রতীক্ষায়<br /> আমি তাকে ছিঁড়ে নেবো<br />জলস্রোত ছলচ্ছল শব্দে আমায় ডাক পাঠাবে<br />এই সব স্থির সত্য নিয়ে বেঁচে আছি । </p>
<br /><br />(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/tumi-jei-eshe-darale/তুমি যেই এসে দাঁড়ালে2021-12-17T15:37:34-05:002023-06-27T13:34:41-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে<br /> হাত ছুঁয়ে বলে বন্ধু<br />তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে<br /> মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়<br /> হাসি বিনিময় করে চলে যায়<br /> উত্তরে দক্ষিণে<br />তুমি যেই এসে দাঁড়ালে---<br />কেউ চিনলো না কেউ দেখলো না<br /> সবাই সবার অচেনা !</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/shakkhi/সাক্ষী2021-12-17T15:29:52-05:002023-06-27T15:18:08-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>হাতে লেগেছিল হাত, কেউ তো দেখেনি ?<br />একটি শালিক দেখেছিল<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার ওষ্ঠ ছুঁই<br /> দেখেনি তো কেউ ?<br />কাগজের টুকরো একটা উড়ে যায়</p>
<br /><p>নদীর কিনারে তার চোখে চোখ রেখে<br /> বিনিময় হয়ে যায় সব দুঃখ<br /> আর কেউ জানে না<br />হঠাৎ উঠলো বেজে স্টিমারের ভোঁ ।</p>
<br /><br />(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/bonchona/বঞ্চনা2021-12-17T15:21:45-05:002023-06-27T20:08:03-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সিংহদ্বার খুলে গেছে, ভেতরে দেখি শুধুই শূন্যতা<br />হা হা করছে অন্ধকার<br />কেউ নেই, কোনো রহস্যও না<br />যেন বালক বয়েসের হাওয়া ঘুরে যায়<br />দু' একটা শুকনো পাতার শব্দ---<br />কেউ নেই ? আমি চেঁচিয়ে উঠি<br />প্রতিধ্বনি আসে কেউ নেই, নেই, নেই---<br />আমার তীব্র অভিমান হয়<br />এ কি এক ধরনের বঞ্চনা নয় ?<br />যদি কেউ না থাকবে, তবে দ্বার কেন বন্ধ ছিল ?<br />কেন প্রতীক্ষায় ছিলাম এতদিন !</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/chok-dheke/চোখ ঢেকে2021-12-17T15:14:15-05:002023-06-27T13:33:23-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যে-যেমন জীবন কাটায়<br />তার ঠিক সেই রকম এক-একটি পোশাক রয়েছে<br />আলো ও হাওয়ার মধ্যে লুটোপুটি খেয়ে কে যে<br /> আনন্দ-ভিখারী<br />উড়ুনি ভিজিয়ে সেও বিধ্বংসী নদীর থেকে<br /> শান্তি চেয়েছিল<br />সহসা বিদ্যুত-স্পর্শে চোখ ঢেকে আমিও একদা<br />অচেনা প্রান্তরে একা ছন্নছাড়া, সমূলে দেখেছি<br /> দিগম্বর মৃত্যু স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে ।</p>
<br /><br />(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/shopner-ontorgoto/স্বপ্নের অন্তর্গত2021-12-17T15:07:54-05:002023-06-27T18:13:50-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কারুর আসার কথা ছিল না<br /> কেউ আসেনি<br /> তবু কেন মন খারাপ হয় ?</p>
<br /><p>যে-কোনো শব্দ শুনেই<br /> বাইরে উঠে যাই<br /> কেউ নেই--<br />অদ্ভুত নির্জন হয়ে পৃথিবী<br />শুয়ে আছে<br />ঘুম ভাঙ্গার ঠিক আগের মুহূর্তের<br /> স্বপ্নে<br />আমিও যেন সেই স্বপ্নের <br /> অন্তর্গত ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/shopno-noy/স্বপ্ন নয়2021-12-17T15:02:42-05:002023-06-27T15:18:29-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সুগন্ধ নারীর পাশে শুয়ে থাকা স্বপ্ন নয়<br /> বাইরে বর্ষার কলরোল<br />কানের লতির পাশে ঠোঁট এনে<br /> পুরোনো কাব্যের পঙক্তি বলাবলি হলো<br /> স্বপ্ন নয়<br /> বাইরে ক্ষুধা ও মৃত্যু চোখাচোখি করে<br />হাতের আঙুল নিয়ে খেলা,<br />দুরন্ত আঙুল কভু<br /> ছুঁয়ে দেয় স্তন,<br /> স্বপ্ন নয়<br /> বাইরে দুঃখের মতো মিহিন বাতাস---<br />জীবন এমন ছিল, আজো নেই তোমার আমার ?<br />ভুলে থাকি বহু শোক, ছড়ানো কুন্তলে যত অন্ধকার<br /> স্বপ্ন নয়<br />বাইরে যখনই আসি, বহু মিথ্যে প্রিয় সঙ্গী হয় ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/aporahna/অপরাহ্ণে2021-11-09T13:54:10-05:002023-06-27T13:52:13-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>তোমার মুখের পাশে কাঁটা ঝোপ,একটু সরে এসো<br />এ-পাশে দেওয়াল,এত মাকড়শার জাল!<br />অন্যদিকে নদী,নাকি ঈর্ষা?<br />আসলে ব্যস্ততাময় অপরাহ্ণে ছায়া ফেলে যায়<br /> বাল্য প্রেম<br />মানুষের ভীড়ে কোন মানুষ থাকে না<br />অসম্ভব নির্জনতা চৌরাস্তায় বিহ্বল কৈশোর<br />এলোমেলো পদক্ষেপ, এতদিন পরে তুমি এলে?<br />তোমার মুখের পাশে কাঁটা ঝোপ,একটু সরে এসো!</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sokhi-amar/সখী আমার2021-08-28T03:47:01-04:002023-06-27T09:27:44-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশি, আমায় ভুল বুঝবে?<br />শরীর ছেনে আশ মেটে না, চক্ষু ছুঁয়ে আশ মেটে না<br />তোমার বুকে ওষ্ঠ রেখেও বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়<br />যেন আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার<br /> দিঘির পাড়ে বকের সাথে দেখা হলো না!</p>
<br /><p>সখী, আমার পায়ের তলায় সর্ষে, আমি<br /> বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী<br />আমায় কেউ দ্বার খোলে না, আমার দিকে চোখ তোলে না<br />হাতের তালু জ্বালা ধরায়, শপথগুলি ভুল করেছি<br /> ভুল করেছি<br />মুহুর্মুহু স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্নে আমার ফিরে যাওয়ার<br /> কথা ছিল, স্বপ্নে আমার স্নান হলো না।</p>
<br /><p>সখী, আমার চক্ষুদুটি বর্ণকানা, দিনের আলোয়<br /> জ্যোৎস্না ধাঁধা<br />ভালোবাসায় রক্ত দেখি, রক্ত নেশায় ভ্রমর দেখি<br />সুখের মধ্যে নদীর চড়া, শুকনো বালি হা হা তৃষ্ণা<br /> হা হা তৃষ্ণা<br />কীর্তি ভেবে ঝড়ের মুষ্টি ধরতে গেলাম, যেন আমার<br /> ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার<br /> স্বরূপ দেখা শেষ হলো না।</p>
<br /><p>##<br />কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/mone-mone/মনে মনে2021-08-28T03:41:41-04:002023-06-27T09:28:22-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যে আমায় চোখ রাঙিয়ে এইমাত্র চলে গেল গট্গটিয়ে<br />সে আমায় দিয়ে গেল একটুকরো সুখ<br />শরীরে নতুন করে রক্ত চলাচল টের পাই<br />ইন্দ্রীয় সুতীক্ষ্ম হয়ে ওঠে<br />মৃদু হেসে মনে মনে<br />আমি তার নাম কেটে দিই।<br />সে আর কোথাও নেই,<br />হিম অন্ধকার এক গভীর বরফঘরে<br />নির্বাসিত, আহা সে জানে না!<br />সে তার জুতোর শব্দে মুগ্ধ ছিল<br />প্যান্টের পকেটে হাত<br />স্মৃতিহারা বিভ্রান্ত মানুষ।<br />দাবা খেলুড়ের মতো আমি তাকে<br />এক ঘরে থেকে তুলে<br />অন্য ঘরে বসিয়ে চুপ করে চেয়ে থাকি<br />উপভোগ করি তার ছটফটানি!<br />জালের ফুটোর মধ্যে নাক দিয়ে<br />যেমন বিষন্ন থাকে জেব্রা<br />শুকনো নদীর পাশে যে-রকম দুঃখী ঘাটোয়াল<br />আমার হঠাৎ খুব মায়া হয়<br />আমি তার রমণীকে নরম সান্ত্বনাবাক্য বলি<br />দু‘হাত ছড়িয়ে ফের<br />তছনছ করে দিই খেলা।</p>
<br /><p>##<br />কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/jagoron-hembarno/জাগরণ হেমবর্ণ2021-08-28T03:34:57-04:002023-06-27T09:30:56-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও<br />আরও কাছে যাও<br />ও কেন হিংসার মতো শুয়ে আছে যাখন পৃথিবী খুব<br />শৈশবের মতো প্রিয় হলো<br />জল কনা- মেশা হওয়া এখন এ আশ্বিনের প্রথম সোপানে<br />বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়<br />আরও কাছে যাও<br />জাগরণে হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।<br />মধু-বিহ্বলেরা কাল রাত্রিকে খেলার মাঠ করেছিল<br />ঘাসের শিশিরে তার খণ্ডচিহ্ন<br />ট্রেনের শব্দের মতো দিন এলে সব মুছে যায়<br />নিথর আলো মধ্যে<br />চমশা-পরা গয়লানী হাই তোলে দুধের গুমটিতে<br />নিথর আলোর মধ্যে<br />কাক শালিকের চক্ষু শান<br />রোদ্দুরের বেলা বাড়ে, এত স্বচ্ছ<br />নিজেকে দেখে না<br />আর খেলা নেই<br />ও কেন স্বপ্নের মধ্যে রয়ে যায়<br />শরীরে বৃষ্টির মতো মোহ<br />আরও কাছে যাও</p>
<br /><p>জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।</p>
<br /><p>##<br />কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/amio-chilam/আমিও ছিলাম2021-08-28T03:29:55-04:002023-11-17T06:02:38-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>পাঁচজনে বলে পাঁচ কথা, আমি নিজেকে এখনো চিনি না<br />চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে<br />দশ দিকে চেয়ে আলোর আকাশে আয়নায় মুখ দেখা<br />আমিও ছিলাম, আমিও ছিলম, এই সুখে নিশ্বাস<br />জনি না কোথায় ভূল হয়ে যায়, ছায়া পড়ে ঘোর বনে<br />ঝড়ে বৃষ্টিতে পায়ে পায়ে হেঁটে যাকে মনে করি বন্ধু<br />সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, চোখে অচেনা মতন ভ্রূকুটি<br />নেশায় রক্ত উম্মাদ হয়, তছনছ করি নারীকে<br />অস্তিত্বের সীমানা ছাড়িয়ে জেগে ওঠে সঙহার<br />আঁধার সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে চোখ জ্বালা করে ওঠে।<br />চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে<br />বারবার সব ভুল হয়ে যায় এত বিপরীত স্রোত<br />বুকের মধ্যে প্রবল নিদাঘ, পশ্চিমে হেলে মাথা<br />আমিও ছিলাম, আমিও ছিলাম, কান্নার মতো শোনায়!</p>
<br /><p>##<br />কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/anno-lok/অন্য লোক2021-08-28T03:18:13-04:002023-10-23T01:56:40-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যে লেখে, সে আমি নয়<br />কেন যে আমায় দোষী করো!<br />আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুব্ধ হয়ে ছিঁড়েছি শৃঙ্খল?<br />নদীর কিনারে তার ছেলেবেলা কেটেছিল<br />সে দেখেছে সংসারের গোপন ফাটল<br />মাংসল জলের মধ্যে তার আয়না খুঁজেছে, ভেঙেছে।<br />আমি তো ইস্কুলে গেছি, বই পড়ে প্রকাশ্য রাস্তায়<br />একটা চাবুক পেয়ে হয়ে গেছি শূন্যতায়<br />ঘোড়সওয়ার।<br />যে লেখে সে আমি নয়<br />যে লেখে সে আমি নয়<br />সে এখন নীরার সংশ্রবে আছে পাহাড়-শিখরে<br />চৌকো বাব্যের সঙ্গে হাওয়াকেও<br />হারিয়ে গেয় দুরন্তপনায়<br />কাঙাল হতেও তার লজ্জা নেই<br />এবং ধ্বসের জন্য তার এত উম্মত্ততা<br />দূতাবাস কর্মীকেও খুন করতে ভয় পায় না<br />সে কখনো আমার মতন বসে থাকে<br />টেবিলে মুখ গুঁজে?</p>
<br /><p>##<br />কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/aupekkha/অপেক্ষা2021-08-28T03:13:43-04:002023-06-27T16:23:50-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সকালবেলা এয়ারপোর্টে গেয়েছিলাম একজন বৃদ্ধ আন্তর্জাতিক<br />ফরাসীর সঙ্গে দেখা করার জন্য, যিনি নিজের শৈশবকে ঘৃণা<br />করেন।<br />তিনি তখনো আসেননি, আমি একা বসে রইলাম ভি আই পি<br />লাউঞ্জে। ঠান্ড ঘর, দুটি টাটকা ডালিয়া, বর্তমান রাষ্ট্রপতির<br />বিসদৃশ রকমের বড় ছবি। সিগারেট ধরিয়ে আমি বই খুলি।<br />যে- কোনো বিমানের শব্দে আমার উৎকর্ণ হয়ে ওঠার দরকার<br />নেই। বিশেষ অতিথির ঘর চিনতে ভুল হয় না। সিকিউরিটির<br />লোক একবার এসে আমাকে দেখে যায়। আমি অ্যাশট্রের<br />বদলে ছাই ফেলি সোফার গদিতে-কারণ, এতে বিছু যায়<br />আসে না।<br />সময়ের মুহূর্ত, পল, অনুপল স্তব্ধ হয়ে থকে-এক বন্ধ<br />বিরাট নির্জন ঘর, আমি একা, আমার পা ছড়ানো -আকাশ<br />থেকে মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় স্মৃতি, তার মধ্যে একটা<br />সূর্যমুখী ক্রমশ প্রকাণ্ড থেকে আরও বিশাল, লক্ষ লক্ষ<br />সমান্তরাল আলো, যুদ্ধ-প্রতিরোধের মিছিলের মতন,<br />যেন অজস্র মায়াময় চোখ দংশন করে নির্জনতা, ঘুমের<br />মধ্যে পাশ ফেরার মতন-<br />একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার জন্য নয়, আমার<br />জন্য নয়।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : জাগরণ হেমবর্ণ</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/age/বয়েস2021-08-03T17:31:03-04:002023-06-27T09:28:36-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমার নাকি বয়েস বাড়ছে ? হাসতে হাসতে এই কথাটা<br />স্নানের আগে বাথরুমে যে ক’বার বললুম !<br />এমন ঘোর একলা জায়গায় দু-পাক নাচলেও<br />ক্ষতি নেই তো-<br />হাসতে হাসতে দম ফেটে যায়, বিকেলবেলায়<br />নীরার কাছে<br />বলি, আমার বয়েস বাড়ছে, শুনেছো তো ? ছাপা হয়েছে ?<br />সত্যি সত্যি বুকের লোম, জুলপি, দাড়ি কাঁচায় পাকা-<br />এই যে দ্যাখো, চেয়ে দ্যাখো<br />দেখে সবাই বলবে না কি, ছেলেটা কই, ও তো লোকটা !<br />এ সব খুব শক্ত ম্যাজিক, ছেলে কিভাবে লোক হয়ে যায়<br />লোকেরা ফের বুড় হবেই এবং মরবে<br />আমিও মরবো<br />আরও খানিকটা ভালোবেসে, আরও কয়েকটা পদ্য লিখে<br />আমিও ঠিক মরে যাবো,<br />কী, তাই না ?<br />ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলুম, এ-জায়গাটা আত অচেনা<br />আমার ছিল বিশাল রাজ্য, তার বাইরেও এত অসীম<br />শরীরময় গান-বাজনা, পলক ফেলতেও মায়া জাগে<br />এই ভ্রমণটা বেশ লাগলো, কম কিছু তো দেখা হলো না<br />অন্ধকারও মধুর লাগে, তোমার হাতটা দাও তো<br />সুগন্ধ নিই !<br />নীরা, শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি<br />সময় আজো থেমে আছে ।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/rythym-of-story/গদ্যছন্দে মনোবেদনা2021-08-03T17:17:35-04:002023-06-27T09:30:22-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ভেবেছিলাম নিচু করবো না মাথা, তবুও ভেতরের এক কুত্তার বাচ্চা<br />মাঝে মাঝে মসৃণ পায়ের কাছে ঘষতে চায় মুখ, জানি তো অসীমে<br />ভাসিয়েছি আমার আত্মার শাদা পায়রা দূত, বলেছি মৃত্যুর চেয়েও সাচ্চা<br />মানুষের মতো বেঁচে থঅকা- তবু তার দু’একটা পালক খসে<br />জ্যোস্নায় মনখারাপ হিমে।<br />মাঝে মাঝে গদি মোড়া চেয়ারে বসলেও ব্যথা করে পশ্চাৎদেশে, আমি জানি<br />আচম্বিতে পেয়ালা পিরীচ ভেঙে উঠে দাঁড়ানো উচিত ছিল আমার<br />জানলার বাইরে থেকে নিয়তি চোখ মারে, শীর্ণ হাতে দেয় হাতছানি<br />আমি মনকে চোখ ঠেরে অন্যমনস্ক হই, ইস্ত্রি ঠিক রাখি জামার।<br />এ-সব ইয়ার্কি আর কদ্দিন হে? শুধু বেঁচে থাকতেই হালুয়া<br />টাইট করে দিচ্ছে<br />অথচ কথা ছিল, সব মানুষের জন্য এই পৃথিবী সুসহ দেখে যাবো,<br />ঠিক যে-রকম<br />প্রত্যেক মৌমাছির আছে নিজস্ব খুপরি, কিন্তু যার যখন ইচ্ছে<br />উড়ে যাবার স্বাধীনতা : ফুলের ভেতরে মধু সে জেনেছে, তবু<br />সঙ্গসভ্যতার জন্য তার শ্রম।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/probaser-shese/প্রবাসের শেষে2021-07-12T18:58:01-04:002023-06-27T09:31:22-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যমুনা, আমার হাত ধরো, স্বর্গে যাবো।<br />এসো, মুখে রাখো মুখ, চোখে চোখ, শরীরে শরীর<br />নবীনা পাতার মতো শুদ্ধরূপ, এসো<br />স্বর্গ খুব দুরে নয়, উত্তর সমুদ্র থেকে যে রকম বসন্ত প্রবাসে<br />উড়ে আসে কলস্বর, বাহু থেকে শীতের উত্তাপ<br />যে রকম অপর বুকের কাছে ঋণী হয়; যমুনা, আমার হাত ধরো,<br />স্বর্গে যাবো।</p>
<br /><p>আমার প্রবাস আজ শেষ হলো, এরকম মধুর বিচ্ছেদ<br />মানুষ জানেনি আর। যমুনা আমার সঙ্গী-সহস্র রুমাল<br />স্বর্গের উদ্দেশ্যে ওড়ে; যমুনা তোমায় আমি নক্ষত্রের অতি প্রতিবেশী<br />করে রাখি, আসলে কি স্বাতী নক্ষত্রের সেই প্রবাদ মাখানো অশ্রূ তুমি নও?<br />তুমি নও ফেলে আসা লেবুর পাতার ঘ্রাণে জ্যোৎস্নাময় রাত?<br />তুমি নও ক্ষীণ ধূপ? তুমি কেউ নও<br />তুমিই বিস্মৃতি, তুমি শব্দময়ী, বর্ণ-নারী, স্তন ও জঙ্ঘায় নারী তুমি,<br />ভ্রমণে শয়নে তুমি সকল গ্রনে’র যুক্ত প্রণয় পিপাসা<br />চোখের বিশ্বাসে নারী, স্বেদে চুলে, নোখের ধুলোয়<br />প্রত্যেক অণুতে নারী, নারীর ভিতরে নারী, শূণ্যতায় সহাস্য সুন্দরী,<br />তুমিই গায়ত্রী ভাঙা মণীষার উপহাস, তুমি যৌবনের<br />প্রত্যেক কবির নীরা, দুনিয়ার সব দাপাদাপি ক্রুদ্ধ লোভ<br />ভুল ও ঘুমের মধ্যে তোমার মাধুরী ছুঁয়ে নদীর তরঙ্গ<br />পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী।</p>
<br /><p>তুমি এ রকম? তুমি কেউ নও<br />তুমি শুধু আমার যমুনা।</p>
<br /><p>হাত ধরো, স্বরবৃত্ত পদক্ষেপে নাচ হোক, লজ্জিত জীবন<br />অন্তরীক্ষে বর্ণনাকে দৃশ্য করে, এসো হাত ধরো।<br />পৃথিবীতে বড় বেশী দুঃখ আমি পেয়ে গেছি, অবিশ্বাসে<br />আমি খুনী, আমি পাতাল শহরে জালিয়াৎ, আমি অরণ্যেব<br />পলাতক, মাংসের দোকানে ঋণী, উৎসব ভাঙার ছদ্মবেশী গুপ্তচর।<br />তবুও দ্বিধায় আমি ভুলি নি স্বর্গের পথ, যে রকম প্রাক্তন স্বদেশ।<br />তুমি তো জানো না কিছু, না প্রেম, না নিচু স্বর্গ, না জানাই ভালো<br />তুমিই কিশোরী নদী, বিস্মৃতির স্রোত, বিকালের পুরস্কার……<br />আয় খুকী, স্বর্গের বাগানে আজ ছুটোছুটি করি।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ- বন্দী জেগে আছো</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/bari-fera/বাড়ি ফেরা2021-07-12T18:41:05-04:002023-06-27T09:28:46-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>রাত্তির সাড়ে বারোটায় বৃষ্টি, দুপুরে অত্যন্ত শুক্নো এবং ঝক্ঝকে<br />ছিল পথ, মেঘ থেকে কাদা ঝরেছে, খুবই দুঃখিত মূর্তি একা<br />হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, কালো ভিজে চুপচাপ দ্বিধায়<br />ট্রাম বাস বন্ধ, রিক্সা ট্যাক্সি-পকেটে নেই, পৃথিবী তল্লাসী হয়ে গেছে পরশুদিন<br />পুলিশের হাতে শাস্তি এখন, অথবা নির্জনতাই প্রধান অস্ত্র এই বুধবার রাত্তিরে।<br />অনেক মোটরকারের শব্দ হয় না, ঘুমন্ত হেডলাইট, শুধু পাপ-পূণ্য<br />অত্যন্ত সশব্দে জেগে আছে, কতই তো প্রতিষ্ঠান উঠে যায়, ওরা শুধু<br />ঘাড়হীন অমর-গোঁয়ার।</p>
<br /><p>মশারী ব্যবসায়ীদের মুন্ডুপাত হচ্ছে নর্দমায়, কলকন্ঠে, ঘুমহীন ঘুম<br />শিকে নিয়েছে ট্রাক ড্রাইভার। দু’পাশের আলো-জ্বলা অথবা<br />অন্ধকার ঘরগুলোয়<br />জন্মনিয়ন্ত্রণ জনপ্রিয় হয়নি। অসার্থক যৌন ত্রিয়ার পর<br />বারান্দায় বিড়ি খাচ্ছে বুড়ো লোটা, ঘন ঘন আগুনের চিহ্ন দেখে<br />বোঝা যায় কী তীব্র ওর দুঃখ! মৃত্যুর খুব কাছাকাছি-<br />হয়তো লোকটা<br />গত দশ বছর ধরে মরে গেছে, আমি বেঁচে আছি আঠাশ বছর।</p>
<br /><p>সাত মাইল পদশব্দ শুনে কেউ পাগলামীর সীমা ছুঁয়ে যায় না<br />এ রাস্তা অনন্তে যায়নি, ডাদিকে বেঁকে কামিনী পুকুরে<br />দুই ব্রীজের নিচে জল, পাৎলুন গোটানো হলো, এই ঠান্ডা স্পর্শ<br />একাকী মানুষকে বড় অনুতাপ এনে দেয়-<br />লইট পোস্টে ওঠে বাল্ব চুরি করছে একজন, এই ছোট্ট, তোর পকেটে<br />দেশলই আছে?<br />বহুক্ষণ সিগারেট খাইনি তাই একা লাগছে, দেশলাইটা নিয়ে নিলাম<br />ফেরত পাবি না<br />বল্ব চুরি করেই বাপু খুশি থাক না, দু’রকম আলো বা আগুন<br />এক জীবনে হয় না!….ভাগ শালা…..</p>
<br /><p>ও-পাশে নীরেনবাবুর বাড়ি, থাক। এ-সময় যাওয়া চলে না- ডাকাতের<br />ছদ্মবেশ ছাড়া<br />চায়ের ফরমাস করলে নিশ্চয়ই চা খওয়াতেন, তিনদিন পরে<br />অন্য প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা<br />একটু দূরে রিটায়ার্ড জজসাহেবের সুরম্য হর্ম্যের<br />দেয়াল চকচকে শাদা, কী আশ্চর্য, আজো শাদা! টুকরো কাটকয়লায়<br />লিখে যাবো নাকি, আমি এসেছিলাম, যমদূত, ঘমন্ত দেখে ফিরে গেলম<br />কাল ফের আসবো, ইতিমধ্যে মায়াপাশ ছিন্ন করে রাখবেন নিশ্চই!</p>
<br /><p>কুত্তারা পথ ছাড়! আমি চোর বা জোৎচোর নই, অথবা ভূত প্রেত<br />সমান্য মানুষ একা ফিরে যাচ্ছি নিজের বড়িতে<br />পথ ভুল হয়নি, ঠান্ডা চাবিটা পকেটে, বন্ধ দরজার সামনে থেমে<br />তিনবার নিজের নাম ধরে হাকবো, এবং তৎক্ষাণাৎ সুইচ টিপে<br />এলোমেলো অন্ধকার সরিয়ে<br />আয়নায় নিজের মুখ চিনে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ঢুকবো ঘরে।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ- বন্দী জেগে আছো</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/bhalobasa/ভালোবাসা2021-07-12T18:31:39-04:002023-06-27T10:03:49-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত?<br />ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?<br />ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?<br />ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!</p>
<br /><p>ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা<br />সেতু নেই আকাশে পারাপার<br />ভালাবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া<br />ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদ।</p>
<br /><p>শরীর ফুরোয় ঘামে ভেসে যায় বুক<br />অপর বাহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম<br />ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি<br />ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ- বন্দী জেগে আছো</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sharir-aushariri/শরীর অশরীরী2021-07-12T18:24:38-04:002023-06-27T09:27:59-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কেউ শরীরবাদী বলে আমায় ভর্ৎসনা করলে, তখনই ইচ্ছে হয়<br />অভিমানে অশরীরী হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাই।<br />আবার কেউ ‘অশরীরী’ শব্দটি উচ্চারন করলে আমি কান্নার মতন<br />ভয় পেয়ে তীব্র কন্ঠে বলি, শরীর, তুমি কোথায়? লুকিও না<br />এসো, তোমাকে একটু ছুঁই!<br />এই রকমই জীবন ও মানুষের হাঁটা চলার ভাষা-<br />সুতরাং ‘ভাষা’ শব্দটি কারুর মুখে শুনলে মনে হয় পৃথিবীর<br />যাবতীয় ক্ষত্রিয় গদ্যের<br />বিনাশ করে যেতে হবে।<br />কোথাও ‘ব্রাহ্মণ’ শুনলে মনে পড়ে ভাঙা মৃৎ-শকটের জন্য কান্না<br />এ-সবই তো আকাশের নীচে, তোমার মনে পড়ে না?<br />দেখো,আবার ‘তুমি’ বলছি, অর্থাৎ শরীর<br />এখন আমি শরীরবাদী না অশরীরী?<br />অশরীরী, অশরীরী, তাই তো শরীর ছুঁতে ইচ্ছে হয়,<br />এসো শরীর, তোমায় আদর করি<br />এসো শরীর, তোমায় ছাপার অক্ষরের মতো স্পষ্টভাবে চুম্বন করি<br />তোমায় সমাজ-সংস্কারের মতন আদর্শভাবে আলিঙ্গন করি<br />এসো, ভয় নেই, লজ্জা করো না, কেউ দেখবে না-দেখতে জানে না<br />সত্যবতী, তোমার দ্বীপের চারপাশ আমি ঢেকে দেবো কুয়াশায়<br />তোমার মীনচিহ্নিত দেহে ছড়িয়ে দেবো যোজনব্যাপী গন্ধ-<br />কবিও তো সন্ন্যাসীই, সন্ন্যাসীরই মতন সে হঠাৎ কখনো<br />যোগভ্রষ্ট হয়ে কামমোহিত হয়-<br />সেই বিস্মৃত মুহূর্তের লিপ্সা বড় তীব্র, তাকে অপমান করো না<br />যে যখন জ্যোৎস্নাকে ভোগ করতে চায়, তখন উম্মত্তের মতন<br />লন্ডভন্ড করে রাত্রি, সে যখন পৃথিবীকে দেখে, তখন<br />দশ আঙুলের মতন ভয়াবহ চোখে এই শৌখিন ধরিত্রীর সঙ্গে<br />সঙ্গম করে-যার ডাকনাম ভালোবাসা,-আঃ কেন আবার<br />একথা, আমি অশরীরী এখন, আমি এখন গীর্জার অন্দরের মতন<br />পবিত্র বিশেষণ, সমস্ত প্রতীক অগ্রাহ্য করা শ্রেষ্ঠ প্রতীক, এখন<br />‘সমাজ’ শব্দটি শুনলে পাট ভেজানো জলের গন্ধ মনে পড়ে, কেউ<br />ক্ষিদে পেয়েছে’ বললে মনে হয়, আহা লোকটি বড় নিষ্ঠাবান<br />অর্থাৎ ধ্যান, এখন আমার ধ্যান, আর বিস্মরণ নয়, ধ্যান-<br />কিন্তু যাই বলো, চারপাশে অপ্সরীর নৃত্য না থাকলে চোখ বুঝে<br />ধ্যানও জমে না!</p>
<br /><p>আবার? আস্তে, না, শরীর নয়, আমি এখন আকাশের নিচে<br />চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্ত অন্তরীক্ষ জুড়ে তালগাছের মতন<br />দীর্ঘ কোনো কন্ঠস্বর আমায় বলেছে, দাঁড়াও!<br />আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, আমি এ-রকমও জানি,<br />চোখে জল এলে বুঝতে পারি, এও তো শরীর, পায়ের ধুলোও শরীরবাদী<br />আহা. শরীরের দোষ নেই, সে অশীরীর সামনে হাত জোড়<br />করে দাঁড়িয়ে আছে।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/gohon-auronney/গহন অরণ্যে2021-07-12T18:05:07-04:002023-06-27T18:54:26-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-<br />শুকনো পাতার ভাঙা নিঃশ্বাসের মতো শব্দ<br />তরুলতা, বাঁশের ছায়া, শালের বল্লরী,<br />সরু পথ<br />কালভার্টে, টিলার জঙ্গলে একা বসে থাকা কী-করম নিঝুম বিষন্ন<br />বড় হিংস্র দুঃখময়।<br />অসংখ্য আত্মার মতো লুকোনো পাখী ও প্রাণী, অপার্থিব নির্জনতা<br />ফুলের সুবর্ণরেখা গন্ধ, সামনে ঢেউ উৎরাই-<br />অসহিষ্ণু জুতোর ভিতরে বালি, শিরদাঁড়া ব্যথা পেতে দ্বিধা করে<br />কেননা বুকের মধ্যে চাপা হাওয়া, করতলে মুখ।<br />গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-<br />তবু যেতে হয়<br />বারবার ফিরে যেতে হয়।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ- বন্দী জেগে আছো</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/indragandhir-proti/ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি2021-07-12T17:53:28-04:002023-06-27T09:29:34-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,<br />গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না<br />এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা!<br />ক্রুদ্ধ জলের প্রবল তোলপাড়ের উপড়ে গেছে রেললাইন<br />চৌচির হয়েছে ব্রীজ, মৃত পশুর পেটের কাছে ছন্নছাড়া বালক<br />তরঙ্গে ভেসে যায় বৃদ্ধের চশমা, বৃক্ষের শিখরে মানুষের<br />আপৎকালীন বন্ধুত্ব<br />এইসব টুকরো দৃশ্য- এক ধরনের সত্য, আংশিক, কিন্তু বড় তীব্র<br />বিপর্যয়ের সময় এই সব আংশিক সত্যই প্রধান হয়ে ওঠে<br />ইন্দিরা, লক্ষ্মীমেয়ে, তোমার এ-কথা ভোলা উচিত নয়<br />মেঘের প্রাসাদে বসে তোমার করুণ কন্ঠস্বরেও<br />কোনো সার্বজনীন দুঃখ ধ্বনিত হবে না<br />তোমার শুকনো ঠোঁট, কতদিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি,<br />চোখের নিচে গভীর কালো ক্লান্তি, ব্যর্থ প্রেমিকার মতো চিবুকের রেখা<br />কিন্তু তুমি নিজেই বেছে নিয়েছো এই পথ<br />তোমার আর ফেরার পথ নেই<br />প্রিয়দর্শিনী, তুমি এখন বিমানের জানালায় বসে<br />উড়ে এসো না জলপাইগুড়ি, আসামের আকাশে<br />এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা<br />আমি তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি-<br />উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা<br />প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা<br />নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত-যেন মেঘলা আকাশ উল্টো<br />হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে<br />মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়িও কান্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা<br />ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে<br />বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর!</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/jalonta-jiraf/জ্বলন্ত জিরাফ2021-07-08T08:30:57-04:002023-06-27T09:31:00-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>শেষ কবে নারীহত্যা করেছি আমার ব্যক্তিগত স্বর্গে? বাথরুমে- ছ’মাস আগে, সেই থেকে চোখে ভালো দেখতে পাই না। সাতদিন পর্যন্ত আয়নায় হাসির প্রমাণ লেগেছিল- এছাড়া চোখের জল জমিয়ে রেখেছিলাম বেসিনে। সেই ঠান্ডা চোখের জলে রোজ মুখ ধুতাম ও কুলকুচোঁ করেছি জানালা দিয়ে। প্রতিবেশী এসে বিরাট আপত্তি জানালোঃ এতদিন পেচ্ছাপ করা সহ্য করেছি, তা বলে কি কুলকুচো করাও। তার ছোটো বাড়ির রঙ শাদা ছিল।</p>
<br /><p>পুলিস এসে বলেছিলো, এই নিয়ে সাতটা খুনের জন্য তুমি মোট তেরোটা ছুরি ভেঙেছো। ইস্পাতের এ-রকম অনটনের দিনে তোমার অমন বিলাসিতা। এরপর থেকে তোমার ঐ খামখেয়ালীর জন্য যত খুশী সিল্কের রুমাল বা ধুত্রাফল ব্যবহার করবে। কিন্ত ইস্পাতের অপচয়ের মতো বে-আইনী। দু’বছর অন্তত ঘানি ঘোরাতে।- আমার ঘড়ি ছিল না বলে ক’টা বাজে দেখবার জন্য আমি মণিবন্ধটা কানের কাছে। রক্ত চলাচলের স্পষ্ট শব্দ ও সময়।</p>
<br /><p>টেলিফোন মিস্ত্রী অভিযোগ জানালো, আমার ঘরে রেডিও নেই কেন। সরমা অনুযোগ করেছিল, আমার ঘরে কোনও ছবি নেই। আমি ওকে টেবিলের সম্পূর্ণ খালি সতেরোটা ড্রয়ার দেখিয়েছিলাম। ও দূরের জ্বলন্ত জিরাফ একেবারে লক্ষ্য করেনি। সেই পাপেই ওর মৃত্যু হলো। দাঁতের ডাক্তার আমার পায়ে ঘা কর দিয়েছিলো বলে আমি কখনও আর সে শুয়োরের বাচ্চা জীবানু সমন্বয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাইনি। তার বদলে আমি এখন পেচ্ছাপ ও কান্নার সম্পর্ক নিয়ে বই লিখছি। এখন রাত্রি কি দিন চেনা যায় না।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/dupur/দুপুর2021-07-08T07:55:13-04:002023-06-27T09:31:13-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা<br />এ যেন আলোরই শস্য, দুপুরের অস্থির কুহক<br />অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু’চক্ষুর সীমা<br />পথ চলতে থম্কে গেলো অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক।<br />ভিজে চুল খুলেছে সে সুকুমার, উদাস আঙুলে<br />স্তনের বৃন্তের কাছে উদ্বেলিত গ্রীষ্মের বাতাস<br />কি যেন দেখলো মিলে এক সঙ্গে নিল দীর্ঘশ্বাস।</p>
<br /><p>একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে<br />সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো<br />সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুণে গুণে দেখলো সস্নেহে<br />এ মাসেই চাকবি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো<br />অলিন্দের আলো।</p>
<br /><p>এর চেয়ে রাত্রি ভালো, নির্লিপ্তের মতো চেয়ে বললো মনে মনে<br />কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শেষবার ফিরে দেখলো তাকে<br />রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে<br />এ যেন নদীর মতো, নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে।<br />এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার<br />রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : একা এবং কয়েকজন</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/prarthana/প্রার্থনা2021-07-08T07:50:22-04:002023-06-27T09:31:19-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ঋজু শাল অশ্বত্থের শিকড়ে শিকড়ে যত ক্ষুধা<br />সব তুমি সয়েছ, বসুধা।<br />স্তব্ধ নীল আকাশের দৃশ্য অন্তহীন পটভূমি<br />চক্ষুর সীমানা-প্রান্তে বেঁধে দিয়ে তুমি<br />এঁকে দিলে মাঠ বন বৃষ্টি-মগ্ন নদী-তার দুরাভাস তীর<br />আমাকে নিঃশেষে দিলে তোমার একান্ত মৃদু মাটির শরীর।<br />আমার জন্মের ভোর সূর্য-শরে আহত মাটিতে<br />প্রত্যহকে ধরে থাকা অবাধ্য মুঠিতে।<br />নিবির ঘুমের মৌন জীবনের অস্পষ্ট আভাসে<br />নিস্পন্দ অন্ধকারে মিশে যায়,-বর্ণ ভেসে আসে,<br />লাগে স্পর্শ-উষ্ণ হাওয়া, দেখি চক্ষু ভ’রে<br />সূর্যমুখীর মতো মেলে আছো সেই এক অপরূপ ভোরে।</p>
<br /><p>আমারও আকাঙ্খা ছিল সূর্যের দোসর হবো তিমির শিকারে<br />সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে।<br />অথচ সময়াহত আপাত-বস’র দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত মনে<br />বর্তমান ভীত-চক্ষু মাটিতে ঢেকেছি সঙ্গোপনে।</p>
<br /><p>দাঁড়াও ক্ষণিক তুমি স্তব্ধ করে কালচিহ্ন ভবিষ্যত অপার<br />হৃৎস্পন্দে দাও আলো-উৎসের ঝংকার।<br />নির্মম মুহূর্ত ছুঁয়ে বাঁচার বঞ্চনা স’য়ে স’য়ে<br />আমাকে স্বাক্ষর দাও নবীন যৌবন, সমারোহে।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ :একা এবং কয়েকজন</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sohoj/সহজ2021-07-08T07:05:48-04:002023-06-27T09:27:20-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কেমন সহজ আমি ফোটালাম একলক্ষ ফুল<br />হঠাৎ দিলাম জ্বেলে কয়েকটা সুর্য চাঁদ তারা<br />আবার খেয়াল হলে এক ফুঁয়ে নেভালাম সেই জ্যোৎস্না<br />(মনে পড়ে কোন্ জ্যোৎস্না?) নেভালাম সেই রোদ (তাও মনে পড়ে?)</p>
<br /><p>নিন্দুকে নানান কথা আমাকে দেখিয়ে বলবে, বিশ্বাস করো না।<br />হয়তো বলবে শিশু কংবা নির্বোধ অথবা<br />ম্যাজিকওয়ালা- ছেঁড়া তাঁবু ফাটা বজনা, নানান সেলাই<br />করা কালো কোর্তা গায়ে লোকটা কি মরণ খেলা<br />খেলাচ্ছে আহা রে ঐ মেয়েটার চোখে,<br />দর্শক ভুলছে না, হাসছে; আহা, শুধু অবঝ মেয়েটা<br />মায়ার অসুখে ভুগছে; বিশ্বাস করো না।</p>
<br /><p>দেখরে নিন্দুক দেখ, বামহাতে কনিষ্ঠ আঙুলে<br />ত্রিজগৎ ধরে আছি কেমন সহজে,<br />আমাকে অবাক চোখে দেখছে চেয়ে অন্ধকার, সমুদ্র, পাহাড়<br />শুধু কি তোরাই ভুললি বিস্ময়ের ভাষা!<br />আমার বাড়িতে আসবি, দেখবি সে কি আজব বাড়ি?<br />মাথার উপরে ছাদ-চেয়ে দেখ, চারদিকে, দেয়াল রাখিনি,<br />তোরাই দেয়াল ঘেরা, বুকে স্বপ্ন, শ্লেষ্মা নিয়ে চিরকাল থাকবি<br />সাবধানে আঙুলে বয়স গুণে-শখ করে সে দেয়ালে নানা ছবি এঁকে<br />আমার বাড়িতে দেখ অনুগত ভৃত্যের মতন<br />নানান জাতের হাওয়া ঘুরছে ফিরছে, ঝুল ঝাড়ছে ছাতের কার্নিসে।<br />নানান রঙের টান দিয়ে দেখছে, ব্যস্ত দিন রাত।<br />আমি বসে ছবি আঁকছি দেয়ালবিহীন ঘরে মেয়েটির চোখে<br />বাইরের ছবির চেয়ে চোখের মণিতে ছবি কেমন সহজ!</p>
<br /><p>তোরাই নির্বোধ শিশু, ফিরে যা নিন্দুক-<br />আমাকে ম্যাজিকওয়ালা বললে তুমি বিশ্বাস করো না।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : একা এবং কয়েকজন</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/nirbason/নির্বাসন2021-06-08T14:42:20-04:002023-06-27T18:09:05-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমি ও নিখিলেশ, অর্থাৎ নিখিলেশ ও আমি, অর্থাৎ আমরা চারজন<br />একসঙ্গে সন্ধেবেলা কার্জন<br />পার্কের মধ্য দিয়ে,- চতুর্দিকে রাজকুমারীর মত আলো-<br />হেঁটে যাই, ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ঘড়ি ভয় দেখালো<br />উল্টো দিকে কাঁটা ঘুরে, আমাদের ঘাড় হেট<br />করা মূর্তি, আমরা চারজন হেটে যাই, মুখে সিগারেট<br />বদল হয়, আমরা কথা বলি না, রেড রোডের দু’পাশের<br />রঙিন ফুলবাগান থেকে নানা রঙের হাওয়া আসে, তাসের<br />ম্যাজিকের মতো গাড়িগুলো আসে ও যায়, আমরা এক ভাঙা কারখানায়<br />শিকল কিনতে গিয়েছিলাম, ফিরে যাচ্ছি, আমি বাকি তিনজনকে<br />চেয়ে দেখলুম, ওরাও আমাকে আড়চোখে…..<br />ছোট-বড়ো আলোয় বড়ো ছোট ছায়া সমান দুরত্বে<br />আমাদের, চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মাঠে ইঁদুর বা কেঁচোর গর্তে<br />পা মচকে আমি পিছিয়ে পড়ি, ওরা দেখে না, এগিয়ে যায়<br />কখনো ওরা আলোয়, কখনো গাছের নিচে ছায়ায়<br />ওরা পিছনে ফেরে না, থামে না, ওরা যায়-<br />আমি নাস্তিকের গলায় নিজের ছায়াকে ডাকি, একশো মেয়ের চিৎকার<br />মেমোরিয়ালের পাশ থেকে হাসি-সমেত তিনবার<br />জেগে উঠে আড়াল করে, এবার আমি নিজের নাম<br />চেচাঁই খুব জোরে, কেউ সাড়া দেবার আগেই একটা নিলাম-<br />ওয়ালা ‘কানাকড়ি’, ‘কানাকড়ি’ হাতুড়ি ঠোকে, একটা ঢিল<br />তুলে ছুঁড়তে যেতেই কে যেন বললো, ‘সুনীল,<br />এখানে কী করছিস? আমি হাঁটু ও কপালের<br />রক্ত ঘাসে মুছে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার সুবজ ও লালের<br />শিহরণ দেখি, দু’হাত উপরে তুলে বিচারক সপ্তর্ষিমন্ডল<br />আড়াল করতে ইচ্ছে হয়, ‘ওঠ্ বাড়ি চল্, কিংবা বল্<br />কোথায় লুকিয়েছিস নীরাকে? গলার স্বর শুনে মানুষকে<br />চেনা যায় না, একটি অন্ধ মেয়ে আমাকে বলেছিল, দু’চোখ উস্কে<br />আমি লোকটাকে তদন্ত করি; পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন<br />পায়ে চলা পথ ধরে কারা আসে। যেন গহন বন<br />পেরিয়ে শিকারী এলো, জীবনের তীব্রতম প্রশ্ন মুখে তুলে<br />দাঁড়িয়ে রইলো, যেন ছুঁয়ে দিল বেদান্তের মন্দিরচূড়ার মতো আঙুলে<br />নীলিমার মতো নিঃস্বতা,- যেন কত চেনা, অথচ মুখ চিনি না, চোখ<br />চিনি না, ছায়া নেই, লোকটার এমন নির্মম, এক-জীবনের শোক<br />বুকে এলো, ‘কোথায় লুকিয়েছিস?’ ‘জানি না’ এ-কথা<br />কপালে রক্তের মতো, তবু বোঝে না রক্তের ভাষা, তৃষ্ণা ও ব্যর্থতা<br />বার বার প্রশ্ন করে, জানি না কোথঅয় লুকিয়েছি নীরাকে, অথবা নীরা কোথায়<br />লুকিয়ে রেখেছে আমা! কোথায় হারালো নিখিলেশ, বিদ্যমানতায়<br />পরস্পর ছায়া ও মূর্তি, ‘…. আবার একা হাঁটতে লাগলুম, বহুক্ষণ<br />কেউ এলো না সঙ্গে, না প্রশ্ন, না ছায়া, না নিখিলেশ, না ভালোবাসা<br />শুধু নির্বাসন।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/nira-o-zero-oure/নীরা ও জীরো আওয়ার2021-06-08T14:07:30-04:002023-06-27T09:23:17-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে-<br />পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে<br />জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ<br />দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো<br />ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা<br />আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়।</p>
<br /><p>প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের<br />শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো<br />গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে<br />উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও<br />হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার<br />বাড়ির সামনে, নীরা থুক্ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে<br />বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে<br />এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের<br />উৎস। আমি<br />ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন<br />আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।</p>
<br /><p>কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার<br />আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় :<br /> নীরা, তোমায় একটি রঙিন<br /> সাবান উপহার<br /> দিয়েছি শেষবার;<br />আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে।<br /> বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে<br /> আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে<br /> ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন<br /> অমর না হয়…</p>
<br /><p>অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে<br />চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে<br />ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার<br />মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা<br />নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট<br />শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়!</p>
<br /><p>এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন<br />বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন<br />আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি<br />জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের<br />সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর<br />পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ<br />সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি<br />দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার<br />নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে<br />১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে<br />উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে,<br /> সোনার রজ্জুতে<br />বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা<br />পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে<br />এসে স্তব্ধ অসময়, উল্টো দিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য,<br />সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার<br />প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে?<br />কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু<br />ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি :<br />ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ<br />তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ<br />অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত<br />পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/nira-tomar-kache/নীরা তোমার কাছে2021-06-08T12:06:06-04:002023-06-27T10:28:37-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সিঁড়ির মুখে কারা অমন শান্তভাবে কথা বললো?<br />বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে, তবু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে সিঁড়িতে<br />রেলিং-এ দুই হাত ও থুত্নি, তোমায় দেখে বলবে না কেউ থির বিজুরি<br />তোমার রঙ একটু ময়লা, পদ্মপাতার থেকে যেন একটু চুরি,<br />দাঁড়িয়ে রইলে<br />নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।</p>
<br /><p>নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন<br />দোল ও সরস্বতী পূজোয়–দুটোই খুব রঙের মধ্যে<br />রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন–<br />ও দুটো দিন তুমি আলাদা, ও দুটো দিন তুমি যেন অন্য নীরা<br />বাকি তিনশো তেষট্টি বার তোমায় ঘিরে থাকে অন্য প্রহরীরা।<br />তুমি আমার মুখ দেখোনি একলা ঘরে, আমি আমার দস্যুতা<br />তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, আমরা কেউ বুকের কাছে কখনো<br />কথা বলিনি পরস্পর, চোখের সঙ্গে করিনি চোখ প্রদক্ষিণ–<br /> আমি আমার দস্যুতা<br />তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, নীরা তোমায় দেখা আমার মাত্র দু’দিন।</p>
<br /><p>নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।<br />আমি তোমায় লোভ করিনি, আমি তোমায় টান মারিনি সুতোয়<br />আমি তোমার মন্দিরের মতো শরীরে ঢুকিনি ছল ছুতোয়<br />রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি;<br />দোল ও সরস্বতী পূজোয় তোমার সঙ্গে দেখা আমার–সিঁড়ির কাছে<br /> আজকে এমন দাঁড়িয়ে রইলে<br />নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ami-o-kolkata/আমি ও কলকাতা2021-06-07T13:02:32-04:002023-06-27T09:17:37-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে<br />আমি এর সর্বনাশ করে যাবো-<br />আমি একে ফুসলিয়ে নিয়ে যাবো হলদিয়া বন্দরে<br />নারকোল নাডুর সঙ্গে সেঁকো বিষ মিশিয়ে খাওয়াবো-<br />কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে।</p>
<br /><p>কলকাতা চাঁদের আলো জাল করে, চুম্বনে শিয়াল কাঁটা<br />অথবা কাঁকর<br />আজ মেশাতে শিখেছে,<br />চোখের জলের মতো চায়ে তুমি চিনি দিতে ভুলে যাও এত<br />উপপতি<br />তোমার দিনে দুপুরে, ঊরুতে সম্মতি!<br />দিল্লির সুপ্রিমকোর্টে, সুন্দরী, তোমাকে আমি এমন সহজে<br />যেতে দিতে পারি? তার বদলে হৃদয়ে সুগন্ধ মেখে সন্ধেবেলা<br />প্রখর গরজে<br />তোমার দু’বাহু চেপে ট্যাক্সিতে বাতাস খেতে নিয়ে যাবো-<br />হোটেলে টুইস্ট নাচবে, হিল্লোলে আঁচল খুলে বুকে রাখবে দু’দুটো<br />ক্যামেরা<br />যদু….মধু এবং শ্যামেরা তুড়ি দেবে;<br />শরীরে অমন বাজনা, আয়নার ভিতরে অতি মহার্ঘ আলোর মতো<br />তুমি, তোমার চরণে<br />বিশুদ্ধ কবিতাময় স্তাবকতা দক্ষিণ শহর থেকে এনে দিতে পারি<br />সোনার থালায় স্থলপদ্ম চাও দুই হাতে?<br />তুমি খুন হবে মধ্যরাতে।<br />কলকাতা আমার হাত ছাড়িয়ে কোথায় যাবে, তুমি<br />বিছুতে ক্যানিং স্ট্রীটে লুকোতে পারবে না-<br />চীনে-পাড়া-ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটলে, আমিও বাঘের মতো<br />ছুটে যাবো তোমার পিছনে<br />ডিঙিয়ে ট্রাফিক বাতি, দুঃখের বড়বাজার, রোগীর পথ্যের মতো<br />চৌরঙ্গি পেরিয়ে<br />আমার অনুসরণ, বায়ুভুক নিরালম্ব আত্মার মতন ভঙ্গি<br />কাতর ভালোবাসার, প্রতিশোধে-<br />কোথায় পালাবে তুমি? গঙ্গা থেকে সব ক’টা জাহাজের মুখগুলো ফিরিয়ে<br />অন্ধকার ময়দানে প্রচন্ড সার্চলাইট ফেলে<br />টুঁটি চেপে ধরবো তোমার- তোমার শরীর ভরা পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে বারুদ ছড়িয়ে<br />আমার গোপন যাত্রা, একদিন শ্রোণীযুগে জ্বালবো দেশলাই-<br />উড়ে যাবে হর্ম্যসারি, ছেটকাবে ইঁটকাঠ, ধ্বংস হবে<br />সব লাস্য, অলংকার, চিৎপুরের অমর ভুবন<br />আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলে যদি, তোমার সহমরণ তবে কে বাঁচবে?</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/anarthak-noy/অনর্থক নয়2021-06-07T12:58:19-04:002023-06-27T09:28:59-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>বেয়ারা পাঠিয়ে কারা টাকা তোলে ব্যাঙ্ক থেকে?<br />আমি তো নিজের সইটা এখনো চিনি না<br />বিষম টাকার অভাব! নেই। শুধু হৃৎপিন্ড হাওয়া টেনে নিয়ে<br />হাসি কুলকুচো করি। মাথায় মুকুট নেই বলে<br />কেউ ধার দিতেও চায় না।<br />কিছু টাকা জমা আছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। সামান্য।<br />কাঁটা ছাড়ানো মাছের মতন<br />গদ্য লিখলে ক্যাশ আসে। পারি না। কবিতায় দশ টাকা<br />তাই বা মন্দ কি, কত দীর্ঘ দিন বন্ধুদের টেবিলে বসিনি।<br />কতই তো দিলে বিধি- চোখ, নাক, হাত, গ্রীবা, জিভ, ঘোরাঘুরি<br />কয়েকখানা বড় সাইজ উপন্যাস শেষ করার সামর্থ দিলে না?<br />শিল্পের জননী নাকি দুঃখ? সর্বনাশ, আমার তো কোনো দুঃখ নেই।<br />খুব গোপনে জানাচ্ছি<br />(একমাত্র টাকা কিংবা দুঃখ না-থাকার-দুঃখ যদি গণ্য হয়!)<br />কে কোথায় পায়নি প্রেম, এর সঙ্গী ভোগ করছে ওর সন্ধ্যেবেলা<br />এসব চমৎকার লাগে।</p>
<br /><p>কে যেন আমায় কথা দিয়েছিল! কথা সাঁতরে গেছে অন্ধকারে-<br />ভয়ঙ্কর জানলা খুলে রাত দুটোয় এক ঝলক আলো এসে পড়ে<br />মাঝে মাঝে চোখে মুখে। অমনি চেঁচিয়ে উঠি উল্লাসে মুখ তুলেঃ<br />বিশ্বাসঘাতিনী ভাগ্যে হয়েছিলে নারী, তাই বেঁচে থাকা এত রোমাঞ্চের<br />নেশাফেশা কিছু নেই, দুঃখ নেই, গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চাই<br />তাও কত শক্ত দেখেছি, চারবেলা অদ্ভুত চাকরি, ঘুমহীন চোখে<br />কবিতার আরাধনা<br />কেন এই আরাধনা? ওভারটাইম দশ টাকা?</p>
<br /><p>ছোট ছোট ঝাল লঙ্কা কিংবা ঠিক টিনের চিরুনির মতো রোদে<br />পঞ্চাশটা কাবুলিকে স্বপ্ন দেখে আজ দুপুরে চমকে গেছি ট্রামে।<br />কোর্বন স্ট্রীটের মোড়ে বুড়ো দরবেশ চাইলো অমরত্ব খুবই আন্তরিক<br />কপালে কুষ্ঠের কাদা। তিনটে নয়া পয়সা দিয়ে মানুষের মতো অভিমান<br />সংকেতবিহীন কন্ঠে জানালুমঃ<br />যদি রাস্তা চিনতে পারো, যাও হে অনন্তধামে সন্ধের আগেই<br />ঈশ্বরের পাশে একটি তোমার জন্যেই খালি আসন রয়েছে আমি জানি<br />পরমহূর্তেই আমি পাশের পাগলীর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে-<br />তিনটে পয়সা দাও ভাই আজ আমাকে<br />গাড়ি ভাড়া নেই বহুদূরে যেতে হবে।</p>
<br /><p>মায়ের তোরঙ্গ থেকে সিঁদুরের গুড়ো ঝেড়ে আজও<br />সম্রাট পঞ্চম জর্জ কাটামুন্ডে সহাস্য বয়ান<br />যাও মাছের বাজারে ইয়োর ম্যাজিস্টি , পুঁইশাক, সিগারেট, কুমড়োয়<br />দেখি কতো তোমার মুরোদ! সব ম্যাজিক ভুলে গেছি-<br />একত্রিশ তারিখে দেখছি অ্যালয়ের কুশব্দ ইয়ার্কি<br />এখানে ওখানে নদী- কালো জল, প্রত্যহ স্নান সেরে বহু পবিত্র গন্ডার<br />চৌরঙ্গীর চতুর্দিকে হুটোপুটি করে- হাসে, মেয়েদের খোলা তলপেটে<br />সুড়সুড়ি দেয় কিংবা ঠোঁট চাটে, নুন ঝাল মিশিয়ে<br />প্রথম শীতের এই মনোরম সন্ধ্যাগুলি কাঁটা চামচে দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে<br />সুস্বাদে চিবিয়ে খায়। সমস্ত রাস্তাই আজ ভিড়ে ভর্তি ভিড়ে<br />ভর্তি, অসম্ভব, আমি হঠাৎ কোথায় আজ হারালুম আমার নিজস্ব<br />গোপন প্রস্থান পথ- এ দুর্দিনে ফটকার বাজারে!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/aupoman-abong-nirake-uttar/অপমান এবং নীরাকে উত্তর2021-06-07T12:51:53-04:002023-06-27T09:16:43-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন<br />সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?<br />সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন!</p>
<br /><p>একবার হাত ছুঁয়েছি সাত কি এগারো মাস পরে ঐ হাত<br />কিছু কৃশ, ঠাণ্ডা বা গরম নয়, অতীতের চেয়ে অলৌকিক<br />হাসির শব্দের মতো রক্তস্রোত, অত্যন্ত আপন ঐ হাত<br />সিগারেট না-থাকলে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিতুম<br />সিগারেট না-থাকলে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিতুম<br />মুখ বা চুলের নয়, ঐ হাত ছুঁয়ে আমি সব বুঝি, আমি<br />দুনিয়ার সব ডাক্তারের চেয়ে বড়, আমি হাত ছুঁয়ে দূরে<br />ভ্রমর পেয়েছি শব্দে, প্রতিধ্বনি ফুলের শূন্যতা–</p>
<br /><p>ফুলের? না ফসলের? বারান্দার নিচে ট্রেন সিটি মারে,<br /> যেন ইয়ার্কির<br />টিকিট হয়েছে কেনা, আবার বিদেশে যাবো সমুদ্রে বা নদী…<br /> আবার বিদেশে,<br />ট্রেনের জানালায় বসে ঐ হাত রুমাল ওড়াবে।<br />রাস্তায় এলুম আর শীত নেই, নিশ্বাস শরীরহীন, দ্রুত<br />ট্যাক্সি ছুটে যায় স্বর্গে, হো-হো অট্টহাস ভাসে ম্যাজিক নিশীথে<br />মাথায় একছিটে নেই বাষ্প, চোখে চমৎকার আধো-জাগা ঘুম,<br />ঘুম! মনে পড়ে ঘুম, তুমি, ঘুম তুমি, ঘুম, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন ঘুম<br />ঘুমোবার আগে তুমি স্নান করো? নীরা তুমি, স্বপ্নে যেন এরকম ছিল…</p>
<br /><p>কিংবা গান? বাথরুমে আয়না খুব সাঙ্ঘাতিক স্মৃতির মতন,<br />মনে পড়ে বাস স্টপে? স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্নে–স্বপ্নে, বাস-স্টপে<br />কোনোদিন দেখা হয়নি, ও সব কবিতা! আজ যে রকম ঘোর<br />দুঃখ পাওয়া গেল, অথচ কোথায় দুঃখ, দুঃখের প্রভূত দুঃখ, আহা<br />মানুষকে ভূতের মতো দুঃখে ধরে, চৌরাস্তায় কোনো দুঃখ নেই, নীরা<br />বুকের সিন্দুক খুলে আমাকে কিছুটা দুঃখ বুকের সিন্দুক খুলে, যদি হাত ছুঁয়ে<br />পাওয়া যেত, হাত ছুঁয়ে, ধূসর খাতায় তবে আরেকটি কবিতা<br />কিংবা দুঃখ-না-থাকার-দুঃখ…। ভালোবাসা তার চেয়ে বড় নয়!</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ausukhey-chora/অসুখের ছড়া2021-06-07T12:48:54-04:002023-06-27T14:07:13-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>একলা ঘরে শুয়ে রইলে কারুর মুখ মনে পড়ে না<br />মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না<br />চিঠি লিখবো কোথায়, কোন মুন্ডহীন নারীর কাছে?<br />প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে না চোখের আলো মনে পড়ে না<br />ব্লেকের মতো জানলা খুলে মুখ দেখবো ঈশ্বরের?</p>
<br /><p>বৃষ্টি ছিল রৌদ্র ছায়ায়, বাতাস ছিল বিখ্যাত<br />করমচার সবুজ ঝোপে পূর্বকালের গন্ধ ছিল<br />কত পাখির ডাক থামেনি, কত চাঁদের ঢেউ থামেনি<br />আলিঙ্গনের মতো শব্দ চোখ ছাড়েনি বুক ছাড়েনি<br />একলা ছিলুম বিকেলবেলা, বিকেল তবু একা ছিল না<br />একটা মুখ মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না।</p>
<br /><p>এত মানুষ ঘুমোয় তবু আমার ঘুমে স্বপ্ন নেই<br />স্বপ্ন না হয় স্মৃতি না হয় লোভ কিংবা প্রতিহিংসা<br />যেমন ফুল প্রতিশোধের স্পৃহায় আনে বুকের গন্ধ<br />রমণী তার বুক দেখায়, ভালোবাসায় বুক ভরে না<br />শরীর নাকি শরীর চায়, আমার কিছু মনে পড়ে না<br />মনে পড়ে না মনে পড়ে না- মেঘলা মতো বিস্মরণ<br />যেমন পথ মুখ লূকিয়ে ভিখারিণীর কোলে ঘুমোয়।</p>
<br /><p>বৃক্ষ তোমার মুখ দেখাও, দেখি আকাশ তোমার মুখ<br />এসো আমার গত জন্ম তোমায় চেনা যায় কিনা<br />কোথাও নেই মুখচ্ছবি এ কী অসম্ভব দৈন্য-<br />আমার জানলা বন্ধ ছিল উঠেও ছিটকিনি খুলিনি<br />জানলা ভেঙে ঢোকার বুদ্ধি ঈশ্বরেরও মনে এলো না?<br />আমায় কেউ মনে রাখেনি, না ঈশ্বর না প্রতিমা…….</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/amar-koyekti-nijossya-shabda/আমার কয়েকটি নিজস্ব শব্দ2021-06-07T12:43:56-04:002023-06-27T17:53:19-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>পরিত্রাণ, তুমি শ্বেত, একটুও ধূসর নও, জোনাকির পিছনে বিদ্যুৎ,<br /> যেমন তোমার চিরকাল<br />জোনাকির চিরকাল; স্বর্গ থেকে পতনের পর<br />তোমার অসুখ হলে ভয় পাই, বহু রাত্রি জাগরণ- প্রাচীন মাটিতে<br />তুমি শেষ উত্তরাধিকার। একাদশী পার হলে-তোমার নিশ্চিত <br /> পথ্য হবে।<br />আমার সঙ্গম নয় কুয়াশায় সমুদ্র ও নদী ;<br />ঐ শব্দ চতুষ্পদ, দ্বিধা, কিছুটা উপরে, সার্থকতা যদি উদাসীন ;<br />বিপুল তীর্থের পূণ্য---নয়? সর্বগ্রাস<br /> যেমন জীবন আর জীবনী লেখক।</p>
<br /><p>প্লেনের ভিতরে কান্না এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়িয়ে আনি<br /> একই বুকের মধ্যে।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/choturer-bhumika/চতুরের ভূমিকা2021-06-07T07:42:23-04:002023-06-27T14:58:56-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কিছু উপমার ফুল নিতে হবে নিরুপমা দেবী<br />যদিও নামের মধ্যে রেখেছেন আসল উপমা<br />ক্ষণিক প্রশ্রয়-তুষ্টি চায় আজ সামান্য এ কবি,<br />রবীন্দ্রনাথেরও আপনি চপলতা করেছেন ক্ষমা ।</p>
<br /><p>যদিও প্রত্যহ আসে অগণিত সুঠাম যুবক<br />নানা উপহার আনে সময়-সাগর থেকে তুলে<br />আমি তো আনি নি কিছু চম্পা কিংবা কুর্চি কুরুবক<br />সাজাতে চেয়েছি শুধু স্পর্শহীন উপমার ফুলে ।</p>
<br /><p>আকাশে অনেক সজ্জা, তবু স্থির আকাশের নীল<br />সামান্য এ সত্যটুকু, শোনাতে চেয়েছি আপনাকে<br />শব্দ আর অলঙ্কারে খুঁজে খুঁজে জীবনের মিল<br />দেখেছি সমস্ত সাধ অন্য এক বুকে সুপ্ত থাকে ।<br />আশা করি এতক্ষণে এঁকেছি আমার পটভূমি ।<br />যদি অনুমতি হয় আজ থেকে শুরু হোক, তুমি ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থ : একা এবং কয়েকজন</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ekhon/এখন2021-05-10T18:12:39-04:002023-06-27T17:54:22-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমার একটু একটু<br /> কান্না আসে<br />এমন আগে হতো না,<br />আগে ছিল দুরন্ত উল্লাস<br />আগে এই পৃথিবীকে জয় করে নেবার বাসনা ছিল<br />এখন মনে হয় আমার এই পৃথিবীটা<br /> বিলিয়ে দেই সকলকে<br />পরশুরামের মত রক্তস্নান সেরে<br /> চলে যাই দিগন্ত কিনারে<br />যত সব মানুষকে চিনেছি, তাদের ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়<br /> নাও, যার যা খুশি নাও,<br />শিশির ভেজা মাঠে শুয়ে থাক কিছু সুখী মাথা ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ek-ekdin-udashin/এক একদিন উদাসীন2021-05-10T17:59:49-04:002023-06-27T15:56:36-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>এমনও তো হয় কোনোদিন<br /> পৃথিবী বান্ধবহীন<br /> তুমি যাও রেলব্রীজে একা_<br />ধূসর সন্ধ্যায় নামে ছায়া<br /> নদীটিও স্থিরকায়া<br /> বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।<br />ইস্টিশানে অতি ক্ষীণ আলো<br /> তাও কে বেসেছে ভালো<br /> এত প্রিয় এখন দ্যুলোক<br />হে মানুষ, বিস্মৃত নিমেষে<br /> তুমিও বলেছো হেসে<br /> বেঁচে থাকা স্বপ্নভাঙা শোক !<br />মনে পড়ে সেই মিথ্যে নেশা ?<br /> দাপটে উল্লাসে মেশা<br /> অহঙ্কারী হাতে তরবারি<br />লোভী দুই চক্ষু চেয়েছিল<br /> সোনার রূপোর ধুলো<br /> প্রভুত্বের বেদী কিংবা নারী !<br />আজ সবকিছু ফেলে এলে<br /> সূর্য রক্তে ডুবে গেলে<br /> রেলব্রীজে একা কার হাসি ?<br />হাহাকার মেশা উচ্চারণে<br /> কে বলে আপন মনে<br /> আমি পরিত্রাণ ভালোবাসি !</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ আমার স্বপ্ন)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/tumi-jekhanei-jao/তুমি যেখানেই যাও2021-01-27T16:28:43-05:002023-06-27T18:33:09-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>তুমি যেখানেই যাও<br /> আমি সঙ্গে আছি<br />মন্দিরের পাশে তুমি শোনোনি নিঃশ্বাস ?<br />লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়<br /> জ্যোৎস্না রাতে<br />নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়<br />ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি গেলে কার্শিয়াং<br /> অন্য এক পদশব্দ <br /> পেছনে শোনোনি ?<br />তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে<br /> চুর্ণ অলক?</p>
<br /><p>তুমি সাহসিনী,<br /> তুমি সব জানলা খুলে রাখো<br />মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি--<br /> এক হাতে চিরুনি<br />রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র<br />যে-রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন ;<br />ঝিল্লির আড়াল থেকে<br /> আমি দেখি<br />তোমার সুঠাম তনু<br />ওষ্ঠের উদাস-লেখা<br /> স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা<br />ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়<br /> সারা রাত<br />আমি থাকি তোমার প্রহরী।<br />তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি<br /> যখন দেখি না<br />শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়<br /> সে এসেছে<br />চড়ুই পাখিরা জানে<br /> আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি<br />এলাচের দানা জানে<br /> কার ঠোঁট গন্ধময় হবে--<br />তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো<br />সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি<br /> দেখা দাও, দেখা দাও<br />পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি,<br /> হেসে বলি,<br />তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ । প্রকাশকালঃ ২৫ বৈশাখ, ১৩৮১। উৎসর্গঃ বুদ্ধদেব বসু স্মরণে। প্রকাশকঃ সিগনেট বুকশপ।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/bibriti/বিবৃতি2020-12-06T11:10:39-05:002023-06-27T09:57:38-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উন্তিরিশে এসে<br />গর্ভবতী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ<br />কাঁপালো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতাসের কুটিল সন্দেহ<br />সমস্ত শরীরে মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্তে অবশেষে<br />যন্ত্রণার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,<br />এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক ।</p>
<br /><p>দিবসার্ধ পায়ে হেঁটে ফিরি আমি জীবিকার দাসত্ব-ভিখারী<br />ক্লান্তি লাগে সারারাত, ক্লান্তি যেন অন্ধকার নারী ।<br />একদা অসহ্য হলে বাহুর বন্ধনে পড়ে ধরা<br />যন্ত্রণায় জর্জরিতা দুঃখিনী সে আলোর স্বরূপে<br />মাংসের শরীর তার শুভক্ষণে সব ক্লান্তিহরা<br />মন্ডূকের মতো আমি মগ্ন হই সে কন্দর্প-কূপে</p>
<br /><p>তার সব ব্যর্থ হলো, দীর্ঘশ্বাসে ভরালো পৃথিবী<br />যদিও নিয়ম নিষ্ঠা, স্বামী নামে স্বল্প চেনা লোকটির ছবি<br />শিয়রেতে ত্রুটিহীন, তবু তার দুই শঙ্খ স্তনে<br />পূজার বন্দনা বাজে আদিগন্ত রাত্রির নির্জনে ।</p>
<br /><p>সে তার শরীর থেকে ঝরিয়েছে কান্নার সাগর<br />আমার নির্মম হাতে সঁপেছে বুকের উপকূল,<br />তারপর শান্ত হলে সুখে দুঃখে কামনার ঝড়<br />গর্ভের প্রাণের বৃন্তে ফুটে উঠলো সর্বনাশ-ফুল ।</p>
<br /><p>বাঁচাতে পারবে না তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বীরসিংহ শিশু<br />হবিষ্যান্ন পুষ্ট দেহ ভবিষ্যের ভারে হলো মরণসম্ভবা<br />আফিম, ঘুমের দ্রব্য, বেছে নেবে আগুন, অথবা<br />দোষ নেই দায়ে পড়ে যদি বা ভজনা করে যীশু ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ একা এবং কয়েকজন)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/minoti/মিনতি2020-12-06T10:48:10-05:002023-06-27T09:28:19-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ঝড় দিসনে, আকাশ, সেই সুন্দরীর ঘরে</p>
<br /><p>থিরথিরিয়ে কাঁপতে থাকুক ভীরু দীপের শিখা<br />আঁচল পেতে মাটিতে বুক চেপে থাক সে শুয়ে,<br />একা ঘরের প্রতীক্ষিতা, আকাশ-কনীনিকা ।</p>
<br /><p>দিঘির মতো শরীর তার নরম জলে ভরা<br />ব্যথার দাগ যদিও আঁকে প্রেমিক কাপুরুষ<br />সওদাগর ভৃত্য এক বাঁচার ভয়ে মরা ।</p>
<br /><p>ঝড় দিসনে, আকাশ, তবু বিরহিণীর ঘরে</p>
<br /><p>আঁচল পেতে মাটিতে বুক চেপে থাকুক শুয়ে<br />ঝিকমিকিয়ে উঠুক কেঁপে ভীরু দীপের শিখা<br />প্রেমিক যেন নেভায় এসে একটি দ্রুত ফুঁয়ে ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ একা এবং কয়েকজন)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ei-drishsho/এই দৃশ্য2020-10-23T05:04:59-04:002023-06-27T13:17:45-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো<br />নীল ডুরে শাড়ী, স্বপ্নে পিঠের ওপরে চুল খোলা<br />বাতাসে অসংখ্য প্রজাপতি কিংবা সবই অভ্রফুল?<br />হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো<br />চোখ দুটি বিখ্যাত সুদূর, পায়ের আঙুলে লাল আভা।<br />ডান হাতে, তর্জনীতে সামান্য কালির দাগ<br /> একটু আগেই লিখছিলে<br />বাতাসে সুগন্ধ, কোথা যেন শুরু হলো সন্ধ্যারতি<br />অন্যদেশ থেকে আসে রাত্রি, আজ কিছু দেরি হবে<br />হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো<br />শিল্পের শিরায় আসে উত্তেজনা, শিল্পের দু’চোখে<br /> পোড়ে বাজি</p>
<br /><p>মোহময় মিথ্যেগুলি চঞ্চল দৃষ্টির মতো, জোনাকির মতো উড়ে যায়<br />কোনোদিন দুঃখ ছিল, সেই কথা মনেও পড়ে না<br />হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো<br />সময় থামে না, জানি, একদিন তুমি আমি সময়ে জড়াবো<br />সময় থামে না, একদিন মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে<br />অতৃপ্ত বাসনা, ছোট ছোট সুখ, চলে যাবে<br /> দিগন্ত পেরিয়ে<br />নতুন মানুষ এসে গড়ে দেবে নতুন সমাজ<br />নতুন বাতাস এসে মুছে দেবে পুরোনো নিঃশ্বাস,<br /> তবু আজ<br />হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো<br />এই বসে থাকা, এই পিঠের ওপরে খোলা চুল,<br /> আঙুলে কালির দাগ<br />এই দৃশ্য চিরকাল, এর সঙ্গে অমরতা সখ্য করে নেবে<br />হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো…</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ এসেছি দৈব পিকনিকে।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ekbari-jibone/একবারই জীবনে2020-10-23T04:48:25-04:002023-06-27T17:53:42-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>দুই হাতে মৃত্যু নিয়ে ছেলেখেলা করার বিলাস<br />প্রথম যৌবনে ছিল ।<br />ভাবতাম,<br /> নদীর আকাশে লঘু মাছরাঙা পাখির মতন<br />মৃত্যুর দু’ধারে ঘেঁষে ছুটোছুটি<br /> জীবনকে রূপরস দেয় ।<br />বারবার<br /> আমি কি যাইনি সেই মৃত্যুমুখী দক্ষিণের ঘরে ?<br />বাঁধের কিনার থেকে গড়ানো বন্ধুর হাত ধরে থাকা<br /> আন্তরিক মুঠি<br /> যমদন্ড দেখেছিল ।<br />যৌবনে এসবই খেলা ।<br />যখন মানুষ মরে, একবারই জীবনে মরে,<br /> তারপর আর কোন খেলা নেই ।<br />আর কোন অস্পষ্টতা, নদীর কিনারে বসে থাকা নেই ।<br />হঠাৎ বিমান থেকে বাচাল মেশিনগান ফুঁড়ে যায় দেহ<br /> এখন যা শকুন ও কুকুরের ভোগ্য<br /> আর কোনো খেলা নেই ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/those-dreams/সেই সব স্বপ্ন2020-10-12T01:23:17-04:002024-03-24T08:35:53-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কারাগারের ভিতরে পড়েছিল জোছনা<br />বাইরে হাওয়া, বিষম হাওয়া<br />সেই হাওয়ায় নশ্বরতার গন্ধ<br />তবু ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত চিঠি লিখেছিল তার বৌদিকে,<br />“আমি অমর, আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারও নাই।”</p>
<br /><p>মধ্যরাত্রির আর বেশি দেরি নেই<br />প্রহরের ঘণ্টা বাজে, সান্ত্রীও ক্লান্ত হয়<br />শিয়রের কাছে এসে মৃত্যুও বিমর্ষ বোধ করে।<br />কনডেমড সেলে বসে প্রদ্যুত ভট্টাচার্য লিখছেন,<br />“মা, তোমার প্রদ্যুত কি কখনো মরতে পারে ?<br />আজ চারিদিকে চেয়ে দেখ,<br />লক্ষ প্রদ্যুত তোমার দিকে চেয়ে হাসছে,<br />আমি বেঁচেই রইলাম মা, অক্ষয়”</p>
<br /><p>কেউ জানত না সে কোথায়,<br />বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ছেলেটি আর ফেরেনি<br />জানা গেল দেশকে ভালোবাসার জন্য সে পেয়েছে মৃত্যুদন্ড<br />শেষ মুহূর্তের আগে ভবানী ভট্টাচার্য<br />পোস্ট কার্ডে অতি দ্রুত লিখেছিল তার ছোট ভাইকে,<br />“অমাবস্যার শ্মশানে ভীরু ভয় পায়,<br />সাধক সেখানে সিদ্ধি লাভ করে,<br />আজ আমি বেশি কথা লিখব না<br />শুধু ভাববো মৃত্যু কত সুন্দর।”</p>
<br /><p>লোহার শিকের ওপর হাত,<br />তিনি তাকিয়ে আছেন অন্ধকারের দিকে<br />দৃষ্টি ভেদ করে যায় দেয়াল, অন্ধকারও বাঙময় হয়<br />সূর্য সেন পাঠালেন তার শেষ বাণী,<br />“আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম ?<br />শুধু একটি মাত্র জিনিস,<br />আমার স্বপ্ন একটি সোনালি স্বপ্ন,<br />এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম এই স্বপ্ন দেখেছিলাম ।”</p>
<br /><p>সেই সব স্বপ্ন এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায়<br />শোনা যায় নিঃশ্বাসের শব্দ<br />আর সব মরে স্বপ্ন মরে না<br />অমরত্বের অন্য নাম হয়<br />কানু, সন্তোষ, অসীম রা…<br />জেলখানার নির্মম অন্ধকারে বসে<br />এখনও সেরকম স্বপ্ন দেখছে</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/late/আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায় 2020-10-12T01:15:53-04:002023-10-23T01:52:45-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যে পান্থনিবাসে যাই দ্বার বন্ধ, বলে, ‘ঐ যে রুগ্ন ফুলগুলি<br />বাগানে রয়েছে শুধু, এখন বসবেন?’ কেউ মুমূর্ষু অঙ্গুলি<br />আপন উরসে রেখে হেসে ওঠে, পাতা ঝরানোর হাসি, ‘এই অবেলায়<br />কেন এসেছেন আপনি, কী আছে এখন? গত বসন্তমেলায়<br />সব ফুরিয়েছে, আর আলো নেই, দেখুন না তার ছিঁড়ে গেছে, সব ঘরে <br />ধুলো, তালা খুলবে না এ জন্মে; পরিচারিকার হাতে কুষ্ঠ!’ ভগ্ন কণ্ঠস্বরে<br />নেবানো চুল্লীর জন্য কারো খেদ, কেউ আসবাববিহীন<br />বুকের শীতের মধ্যে শুয়ে আছে, মৃত্যু বহুদূর জেনে, চৈত্র রুক্ষ দিন<br />চিবুক ত্রিভাঁজ করে, প্রতিটি সরাইখানা উচ্ছিষ্ট পাঁজর ও রক্তে ক্লিন্ন হয়ে আছে<br />বাগানে কুসুমগুলি মৃত, গন্ধহীন, ওরা বাতাসে প্রেতের মতো নাচে।<br />আমার আগের যাত্রী রূপচোর, তাতার দস্যুর মতো বেপরোয়া, কব্জি শক্তিধর<br />অমোঘ মৃত্যুর চেয়ে কিছু ছোটো, জীবনের প্রশাখার মতো ভয়ঙ্কর<br />সেই গুপ্তচর পান্থ আগে এসে ছেঁচে নিল শেষ রূপ রস-<br />ক্ষণিক সরাইগুলি, হায়! এখন গ্রীবায় ছিন্ন ইতিহাস, ওষ্ঠে, চোখে, মসীলিপ্ত পুঁথির বয়স।<br />আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, জুতোয় পেরেক ছিল, পথে বড় কষ্ট, তবু ছুটে<br />এসেও পারি না ধরতে, ততক্ষণে লুট শেষ, দাঁড়িয়ে রয়েছে সব ম্লান ওষ্ঠপুটে।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/littleunder/আরও নিচে 2020-10-12T01:14:05-04:002023-06-27T09:18:10-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সিংহাসন থেকে একটু নিচে নেমে, পাথরের<br />সিঁড়ির উপর বসে থাকি<br />একা, চিবুক নির্ভরশীল<br />চোখ লোকচক্ষু থেকে দূরে।<br />‘সম্রাটের চেয়ে কিছু কম সম্রাটত্ব’ থেকে ছুটি নিয়ে আজ<br />হলুদ দিনাবসানে পরিকীর্ণ শব্দটির মোহে<br />মাটির মানুষ হতে সাধ হয়। এক-একদিন একরকম হয়।<br />আমার চোখের নীচে কালো দাগ <br />ব্যান্ডেজের মধ্যে একটা পোকা ঢুকলে যে-রকম জাদুদন্ডসম কোনো<br />মহিলার মতো<br />নিয়তি বদল করে, আলো-ছায়া-আলো ঘোরে নিভৃত সানুদেশে<br />দপ করে জ্বলে ওঠে হৃদয়ের পুরনো বারুদ<br />তেমনিই দিনাবসান<br />তেমনিই মোহের থেকে মুক্ত নিচু চাঁদ-<br />সিংহাসন থেকে নেমে, হাত ভরা পশমের মতো<br />রোমশ স্তব্ধতা।</p>
<br /><p>পাথরের মতো মসৃণ বেদির নিচে রুক্ষ মাটি, একটু দূরে পায়ে চলা পথ।<br />সম্রাটের শেষ বৃত্য চিরতরে যেখানে শয়ান<br />তার চেয়ে দূরে, সীমার যেখানে শেষ<br />সেখানে উদ্ভিদ, জল মেতে আছে পাংশু ঈর্ষায়<br />যেখানে বিশীর্ণ হাত কাদার ভেতর খোঁজ বলির ফসল<br />তার চেয়ে দূরে<br />যেখানে শামুক তার খাদ্য পায়, নিজেও সে খাদ্য হয়<br />ভেসে যায় সাপের খোলস, সেখানেও<br />আমার অতৃপ্তি বড় দীর্ঘশ্বাস বিষদৃষ্টি নিয়ে জেগে রয়-<br />মুকুট খোলার পর আমি আরও বহুদূরে নেমে যেতে চাই।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/teashop/চায়ের দোকানে2020-10-12T01:10:54-04:002023-06-27T18:41:12-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,<br />রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস<br />দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল<br />এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ<br />তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক; </p>
<br /><p>আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল<br />সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!<br />কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ<br />সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে –<br />এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ<br />দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?</p>
<br /><p>গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই<br />একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম<br />এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই<br />আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/nashshar/নশ্বর2020-10-10T18:14:36-04:002023-06-27T09:31:31-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কখনো কখনো মনে হয়, নীরা, তুমি আমার<br />জন্মদিনের চেয়েও দূরে--<br />তুমি পাতা-ঝরা অরণ্যে একা একা হেঁটে চলো<br />তোমার মসৃণ পায়ের নিচে পাতা ভাঙার শব্দ<br />দিগন্তের কাছে মিশে আছে মোষের পিঠের মতন<br /> পাহাড়<br />জয়ডঙ্কা বাজিয়ে তার আড়ালে ডুবে গেল সূর্য<br />এসবই আমার জন্মদিনের চেয়েও দূরের মনে হয় ।</p>
<br /><p>কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে<br />নক্ষত্রের মৃত্যু<br />মনের মধ্যে একটা শিহরন হয়<br />চোখ নেমে আসে ভূ-প্রকৃতির কাছে ;<br />সেই সব মুহূর্তে, নীরা, মনে হয়<br />নশ্বরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেমে পড়ি<br />তোমার বাদামী মুষ্টিতে গুঁজে দিই স্বর্গের পতাকা<br />পৃথিবীময় ঘোষণা করে দিই, তোমার চিবুকে<br /> ঐ অলৌকিক আলো<br /> চিরকাল থমকে থাকবে !</p>
<br /><p>তখন বহুদূর পাতা-ঝরা অরণ্যে দেখতে পাই<br /> তোমার রহস্যময় হাসি-<br />তুমি জানো, সন্ধেবেলার আকাশে খেলা করে সাদা পায়রা<br />তারাও অন্ধকারে মুছে যায়, যেমন চোখের জ্যোতি--এবং পৃথিবীতে<br /> এত দুঃখ<br />মানুষের দুঃখই শুধু তার জন্মকালও ছাড়িয়ে যায় ।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ আমার স্বপ্ন।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ekti-kotha/একটি কথা2020-10-10T17:53:26-04:002023-06-27T09:29:53-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>একটি কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে<br />মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া<br />আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী<br /> দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।</p>
<br /><p>ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাসা<br />বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছুই না<br />রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া<br />রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা।</p>
<br /><p>বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছু না<br />একটি কথা বাকি রইল, থেকেই যাবে।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর।)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sritir-shohor-choddo/স্মৃতির শহর ১৪2020-07-21T00:30:44-04:002023-06-27T09:37:25-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যদি কবিতা লিখে মাঠ-ভর্তি ধান ফলানো যেত<br />আমি রক্ত দিয়ে লিখতুম সেই কবিতা<br />যদি কবিতার ছন্দে তৃষ্ণার্ত ভূমিতে ধারা-বর্ষণ হতো<br />আমি আমার হাড় মজ্জার নির্যাস মিশিয়ে<br />রচনা করতুম বৃষ্টির বন্দনা স্তোত্র<br />যদি কবিতা লিখে…<br />হায়, যদি কবিতা লিখে…<br />অনেকক্ষণ কান্নার পর ঘুমিয়ে পড়েছে যে শিশু<br />তার মতন দুঃখ-ছবি আমি আর কিছু দেখিনি জীবনে<br />যদি কবিতা লিখে…<br />নিভে যাওয়া উনুনের সামনে কেউ বসে আছে পেটের আগুন জ্বেলে<br />যদি কবিতা লিখে…<br />তিল ফুলের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে শোঁয়াপোকার ঝাঁক<br />যদি কবিতা লিখে…<br />ম্লান ছায়ায় উড়ে যাচ্ছে যার যার নিজস্ব পৃথিবী<br />শহর ছেড়ে যখনই যাই পল্লী আঘ্রাণ নিতে<br />মনে হয় আমি অন্য গ্রহের মানুষ<br />তোমার কষ্টে আমি গোপন রোদন করতে পারি<br />কিন্তু তা কবিতা হবে না<br />তোমার দুর্দশায় আমি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাগে গর্জে উঠতে পারি<br />কিন্তু তা কবিতা হবে না<br />এ এক মায়া-দর্পণ, কবিতা, এই নিয়ে বিরলে কিছু খেলা<br />আমায় ক্ষমা ক’রো !</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ স্মৃতির শহর)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sritir-shohor-tero/স্মৃতির শহর ১৩2020-07-21T00:23:34-04:002023-06-27T09:37:29-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>সীমান্ত এলাকার মানুষ গদ্যে কথা বলে<br />বস্তি ও কলকারখানার মানুষ গদ্যে কথা বলে<br />দিনের বেলায় শহর গদ্যে কথা বলে<br />সমস্ত সমসাময়িক দুঃখ গদ্যে কথা বলে<br />শুকনো মাঠ ও রুখু দাড়িওয়ালা মানুষটি গদ্যে কথা বলে<br />গোটা ছুরি-কাচির সভ্যতা গদ্যে কথা বলে<br />তা হলে কী নিয়ে কবিতা লেখা হবে?</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ স্মৃতির শহর)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sritir-shohor-ek/স্মৃতির শহর ১2020-07-21T00:09:43-04:002023-06-27T07:45:39-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী<br />আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার<br />আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়<br />মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।</p>
<br /><p>বাতাসে ছেঁড়া মেঘ, চাঁদের চারপাশে<br />সহসা দানা বাঁধে নীল সময়<br />বাইরে এসে দেখি পৃথিবী শুন্-শান্<br />রাস্তাগুলি যেন আকাশময়।</p>
<br /><p>প্রথম ডেকেছিল মধ্য কৈশোরে<br />পাগল করা এক ব্যথার দিন<br />শরীরে বেজেছিল সমর বিউগল<br />প্রথম স্বপ্নেরা হলো স্বাধীন।</p>
<br /><p>চক্ষে কেউ নেই তবুও বিচ্ছেদ<br />পাইনি কেন তাকে চিনি না যাকে<br />তখন মনে পড়ে নিশীথ-সংকেত<br />দুরাশা ঘুরে ফেরে নদীর বাঁকে।</p>
<br /><p>শাসন বন্ধন তুচ্ছ হয়ে গেল<br />আমার চেনা পথ গোলক ধাঁধা<br />দৃষ্টি বিভ্রম সীমানা ছুঁয়ে যায়<br />খড়্গে কেটে দিই অলীক বাধা।</p>
<br /><p>এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝন্ ঝন<br />পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা<br />নতুন ঘ্রাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে<br />পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা।</p>
<br /><p>এখন জেগে ওঠে কীট ও কুসুমেরা<br />আঁধার শুষে নেয় দিনের তাপ<br />জ্যোৎস্না রেণু ওড়ে, ধুলোয় হীরেকুচি<br />এখন ছুটি নেয় পুণ্য পাপ।</p>
<br /><p>দু’পাশে গলি ঘুঁজি হোঁচট লাগে পায়<br />পল্কা সংসার এখানে কার?<br />জন্ম মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুকে<br />হাসি ও কান্নার সারাৎসার।</p>
<br /><p>এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি<br />এ যেন কুহকের অজানা বীজ<br />এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়<br />হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।</p>
<br /><p>আমাকে যেতে হবে এখনো যেতে হবে<br />রয়েছে অশরীরী অপেক্ষায়<br />যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দোলে<br />যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।</p>
<br /><p>পথের রাজা এক নগ্ন মহাকাল<br />ধরেছে মুদারায় ডাগর গান <br />হেঁতাল দণ্ডটি আকাশে তুলে ধ'রে<br />সে যেন নিতে চায় সাগর-ঘ্রাণ।</p>
<br /><p>একটু নিচু হয়ে দিয়েছি সম্মান<br />আবার সরে গেছি অপর দিকে<br />পারিয়া কুকুরেরা অবাক চোখে দেখে<br />গাছের মতো এই মানুষটিকে।</p>
<br /><p>দুদিকে মন্দির, গরাদে ভীমতালা<br />কালীর স্তনঘেরা পিঁপড়ে রাশি<br />প্রদীপে মৃদু আলো, সিঁড়িতে বেজে ওঠে<br />কুষ্ঠরোগিণীর শুকনো কাশি।</p>
<br /><p>একলা শালপাতা আপন মনে ওড়ে<br />পুজোর গাঁদা ফুল ধুলোয় মাখা<br />একটি ঘুমচোখ বালক হিসি করে<br />দেয়ালে রমণীর শরীর আঁকা।</p>
<br /><p>এবারে দেখা যায় শ্মশানে উৎসব<br />আগুন জবা রং, গুঞ্জরণ<br />ছায়ার কোলাহল, ছায়ার ঘোরাফেরা<br />ব্যস্ত নিরাকার মানুষজন।</p>
<br /><p>এখানে রাত নেই, এখানে দিন নেই<br />থেমেছে চুম্বকে আয়ুর ঘড়ি<br />মৃতেরা হেসে ওঠে, জীবিত উদাসীরা<br />হেলায় ছুঁড়ে দেয় পারের কড়ি।</p>
<br /><p>গাঁজার বীজ ফাটে, শিবের শিষ্যেরা<br />বৃত্তে বসে আছে ছবির প্রায়<br />যমজ ত্রিভূজের চূড়ায় লাল আলো<br />জোনাকি ফুটে ওঠে নদীর গায়।</p>
<br /><p>চোখের চেয়ে আরও অনেক বড় দেখা<br />দৃশ্য ঘুরে যায়, ঘোরে বাতাস<br />ধোঁয়ার মৃদু জ্বালা শোকের রলরোল<br />বাষ্প-অশ্রুতে রুদ্ধশ্বাস।</p>
<br /><p>জলের কাছে যাই, সেখানে কেউ নেই<br />সেখানে শুয়ে আছে নদীর কায়া<br />আমাকে ডেকেছিল স্বপ্ন ছেঁড়া এক<br />পাহাড়-কুন্তলা গভীর ছায়া।</p>
<br /><p>ছায়াও জেগে ওঠে জলের সশরীর<br />শহর বিস্মৃত আকাশলীনা<br />আমার করতল দেয় ও নেয় কিছু<br />জীবন কেটে যায় তাকে ভুলি না।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ স্মৃতির শহর)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/raagi-lok/রাগী লোক2020-07-20T23:16:36-04:002023-06-27T09:28:08-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>রাগী লোকেরা কবিতা লিখতে পারে না<br />তারা বড্ড চ্যাঁচায়<br />গহন সংসারের ম্লান ছায়ায় রাগী লোকরা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ<br />তারা নিজের কন্ঠস্বর শুনতে ভালোবাসে।<br />পাহাড়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়া জলপ্রপাতের পাশে<br />আমি একজন রাগী লোককে দেখেছিলাম<br />তার বাঁকা ভুরু ও উদ্ধত ভঙ্গিমার মধ্যেও কি অসহায়<br /> একজন মানুষ---<br />নদীর গতিপথ কেন খালের মতন সরল নয়<br />এই নিয়ে লোকটি খুব রাগারাগি করছিল !<br />হাতে এক গোছা চাবি<br />তবু তালা খোলার বদলে সে পৃথিবীর সব<br /> দরজা ভেঙে ফেলতে চায়---<br />ঐ লোকটি কোনোদিন কবিতা লিখতে পারবে না<br />এই ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব !<br />পাহাড় ও জলপ্রপাতের পাশে সেই<br /> বিশাল সুমহান প্রকৃতির মধ্যে<br />বাজে পোড়া শুকনো গাছের মতোন দাঁড়িয়ে রইলো<br /> একজন রাগী মানুষ ।</p>
<br /><br />(কাব্যগ্রন্থঃ আমার স্বপ্ন)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ebar-kobita-likhe/এবার কবিতা লিখে2020-07-20T22:52:58-04:002023-06-27T14:46:36-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো<br />এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি<br />এবার কবিতা লিখে আমি ঠিক রাষ্ট্রপতি না হলেও<br /> ত্রিপাদ ভূমির জন্য রাখবো পা উঁচিয়ে---<br />মেষপালকের গানে এ পৃথিবী বহুদিন ঋণী!<br />কবিতা লিখেছি আমি চাই স্কচ, সাদা ঘোড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক<br /> মুরগীর দু'ঠ্যাং শুধু, বাকি মাংস নয়---<br />কবিতা লিখেছি তাই আমার সহস্র ক্রীতদাসী চাই---<br />অথবা একটি নারী অগোপন, যাকে আমি প্রকাশ্যে রাস্তায় জানু ধরে...<br /> দয়া চাইতে পারি।</p>
<br /><p>লেভেল ক্রসিংয়ে আমি দাঁড়ালেই শুনতে চাই তোপধ্বনি<br />এবার কবিতা লিখে আমি আর দাবি ছাড়বো না<br />নেড়ি কুত্তা হয়ে আমি পায়ের ধুলোর থেকে গড়াগড়ি দিয়ে আসি<br />হাড় থেকে রক্ত নিংড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছি, ভিক্ষে চেয়ে মানুষের<br /> চোখ থেকে মনুষ্যত্ব খুলে---<br />কপালের জ্বর, থুতু শ্লেষ্মা থেকে কবিতার জন্য উঠে এসে<br />মাতাল চন্ডাল হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফের ছাই থেকে উঠে এসে<br />আমরা একলা ঘরে অসহায়তার মতো হা-হা স্বর থেকে উঠে এসে<br />কবিতা লেখার সব প্রতিশোধ নিতে দাঁড়িয়েছি।</p>
<br /><p>(কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি)</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/shottobodho-oviman/সত্যবদ্ধ অভিমান2020-07-07T12:10:05-04:002023-06-27T19:18:59-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ<br />আমি কি এ হাতে কোনাে পাপ করতে পারি?<br />শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়<br /> তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো<br />যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে<br /> নীরার সুষমা<br />চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু?<br />তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--<br />আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে<br /> মনে মনে বলি,<br /> যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--<br /> ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক<br />এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ<br /> আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন<br /> পাপ করতে পারি ?</p>
<br /><p>এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--<br />এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?<br /> সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী <br /> কথাটাই বলা হয়নি<br />লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস<br />আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙে যাবে সবগুলো সিঁড়ি<br />থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে--<br />ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ<br />সত্যবদ্ধ অভিমান----চোখ জ্বালা করে ওঠে,<br /> সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে<br />এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি<br />এই ওষ্ঠে আর কোনাে মিথ্যে কি মানায় ?</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/amar-koishoree/আমার কৈশোরে2020-06-19T11:11:09-04:002023-06-27T09:17:23-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>শিউলি ফুলের রাশি শিশিরের আঘাতও সয় না<br />অন্তত আমার কৈশোরে তারা এরকমই ছিল<br />এখন শিউলি ফুলের খবরও রাখি না অবশ্য<br />জানি না তারা স্বভাব বদলেছে কি না<br />আমার কৈশোরে শিউলির বোঁটার রঙ ছিল শুধু<br />শিউলি বোঁটারই মতন<br />কোনো কিছুর সঙ্গেই তার তুলনা চলতো না<br />আমার কৈশোরে পথের ওপর ঝরে পড়ে থাকা<br />শিশিরমাখা শিউলির উপর পা ফেললে পাপ হতো<br />আমরা পাপ কাটাবার জন্য প্রণাম করতাম।<br />আমার কৈশোরে শিউলির সম্মানে সরে যেতো বৃষ্টিময় মেঘ<br />তখন রোদ্দুর ছিল তাপহীন উজ্জ্বল<br />দু’হাত ভরা শিউলির ঘ্রাণ নিতে নিতে মনে হতো<br />আমার কোনো গোপন দুঃখ নেই<br />আমার হৃদয়ে কোনো দাগ নেই<br />পৃথিবীর সব আকাশ থেকে আকাশে <br />বেজে উঠছে উৎসবের বাজনা<br />সাদা শিউলির রাশি বড় শুদ্ধ, প্রয়োজনহীন<br />দেখলেই বলতে ইচ্ছে করতো<br />আমি কারোকে কখনো দুঃখ দেবো না<br />অন্তত এরকমই ছিল আমার কৈশোরে<br /> এখন অবশ্য শিউলি ফুলের খবরও রাখি না।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/batashe-totur-biz/বাতাসে তুলোর বীজ2020-06-19T10:50:34-04:002023-06-27T09:24:31-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার?<br />এই দিক শূন্য ওড়াউড়ি, এ যেন শিল্পের রূপ-<br />আচমকা আলোর রশ্মি পপি ফুল ছুঁয়ে গেলে<br />যে রকম মিহি মায়াজাল<br />বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?<br />পাহাড়ী জঙ্গল থেকে উড়ে এলে<br />খোলা জানলা পাঁচকোণা ঘরে<br />আমার শব্দের রেশ উড়ে যায়<br />নামহীন নদীটির ধারে<br />স্বপ্নের ভিতর ফোটে স্নেহের মতন জোৎস্না<br />বৃদ্ধ কৃষকের ছায়া<br />আলপথে দাঁড়িয়ে ধানের গন্ধ নেয়<br />ঘুমে আঠা হয়ে আসে দূরে কোনো অচেনা নারীর চোখ<br /> এ যেন শিল্পের রূপ<br />এই দিক শূন্য ওড়াউড়ি<br />বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার?</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/hason-rajar-bari/হাসন্ রাজার বাড়ি2020-06-18T16:19:38-04:002023-06-27T09:37:19-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>গাঁয়েতে এয়েছে এক কেরামতি সাহেব কোম্পানি<br />কত তার ঢ্যাঁড়াক্যাড়া-মানুষ না পিপীলিকা, যা রে ছুটে যা<br />যা রে যা দ্যাখ গা খেলা হুরীর নাচন আর<br /> ভাঁড়ের কেরদানি<br />এখেনে এখন শুধু মুখোমুখি বসে রবো আমি আর হাসন্ রাজা।</p>
<br /><p>আলাভোলা হাওয়া ঘোরে, তিলফুলে বসেছে ভোমর<br />উদলা নদীটি আজ বড়ই ছেনালি<br />বিষয় বুঝলে দাদা, ভুলাতে এয়েছে ও যে দুলায়ে কোমর<br />যা বেটী হারামজাদী, ফাঁকা মাঠে দিব তোর মুখে চুনকালি!</p>
<br /><p>কও তো হাসন্ রাজা, কি বৃত্তান্তে বানাইলে হে মনোহর বাড়ি?<br />শিয়রে শমন, তুমি ছয় ঘরে বসাইলে জানালা-<br />চৌখুপ্পি বাগানে এত বাঞ্ছাকল্পতরু কেয়ারি<br />দুনিয়া আন্ধার তবু তোমার নিবাসে কত পিদ্দিমের মালা!</p>
<br /><p>জানুতে ঠেকায়ে থুতনি হাসন্ চিন্তায় বসে<br /> মুখে তার মিটিমিটি হাসি<br />কড়ি কড়ি চক্ষু দুটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে দেখে জমিন আশমান<br />ফিসফিসায়ে কয়, বড় আমোদে আছি রে ভাই, ছয়টি ঘরেতে ঐ যে<br /> ছয় দাসদাসী<br />শমন আসিলে বলে, তিলেক দাড়াও, আগে দেখে লই<br /> পঙ্খের নকশায় পইড়লো কিনা শেষ টান।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/dekha-holo-bhalobasa-bedonai/দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায় 2019-03-23T01:30:05-04:002023-12-15T08:52:00-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>শব্দ মোহ বন্ধনে কবে প্রথম ধরা পড়েছিলুম আজ মনে নেই<br />কোনো এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জলস্রোতের পাশে<br />অকস্মাৎ দেখা যেন ঠিক আর এক স্রোত<br />সমস্ত ধ্বনির পাশাপাশি অন্য এক ধ্বনি<br />জীবন যাপনের পাশাপাশি এক অদেখা জীবন যাপন…<br />এক একদিন মনে হয়, প্রত্যেক পথেরই বুকের মধ্যে রয়েছে<br />দিক-হারাবার ব্যাকুলতা<br />চেনা বাড়ির রাস্তা দুঃখে কাতরায় নিরুদ্দেশের জন্য<br />প্রত্যেক স্বপ্নের ভিতরে আর একটি স্বপ্ন, তার ভিতরে, তারভিতরে, তার ভিতরে…</p>
<br /><p>নৌকোর গলুইতে পা ঝুলিয়ে বসার মতন প্রিয়<br />বালাকাল ছেড়ে একদিন এসেছি কৈশোরে<br />বাবার হাত শক্ত করে চেয়ে ধরে নিজের চোখের চেয়েও<br />অনেক বড় চোখ মেলে<br />পা দিয়েছিলাম এই শহরের বাঁধানো রাস্তায়<br />ছোট ছোট স্টিমারের মতো ট্রাম, মুখ-না-চেনা এত মানুষ<br />আর এত সাইনবোর্ড, এত হরফ, দেয়ালের এত পোশাক, ভোরের<br />কুয়াশার মধ্যেও যেন সব কিছুর জ্যোতি ঠিকরে আসে<br />আমার চোখে<br />ঘোড়াগাড়ির জানলা দিয়ে দেখা মুহুর্মুহু ব্যাকুল উন্মোচন<br />কেউ জানে না আমি এসেছি, তবু চতুর্দিকে এত সমারোহ<br />মায়ের গা ঘেঁষে বসা উষ্ণ আসনটি থেকে যেন আমি ছিটকে<br />পড়ে যাবো বাইরে, বাবা হাত বাড়িয়ে দিলেন<br />বাঁক ঘোরবার মুখেই হঠাৎ কে চেঁচিয়ে উঠলো, গুলাবি রেউড়ি, গুলাবি রেউড়ি<br />কেউ বললো, পাথরে নাম লেখাবেন, কেউ বললো, জয় হোক<br />তার সঙ্গে মিশে গেল হ্রেষা ও লৌহ শব্দ<br />সদ্য কাটা রক্তাক্ত মাংসের মতন টাটকা স্মৃতির সেই বয়েস…</p>
<br /><p>তারপর<br />একদিন আমি নিজেই ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বাবার হাত<br />বাবা আমাকে ধরতে এসেছেন,<br />আমি আড়ালে লুকিয়েছি<br />বাবা আমাকে রাস্তা চেনাতে গেলে<br />আমি ইচ্ছে করে গেছি ভুল রাস্তায়<br />তাঁর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে আমার ভয় ভাঙা<br />তাঁর বাৎসল্যকে ঠকিয়েছে আমার সব অজানা অঙ্কুর<br />তিনি বারবার আমায় কঠিন শাস্তি দিলে আমি তাঁকে<br />শাস্তি দিয়েছি কঠিনতর<br />আমি অনেক দূরে সরে গেছি…</p>
<br /><p>প্রথম প্রথম এই শহর আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল তার<br />শিহরন জাগানো গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ<br />ছেলেভোলানো দৃশ্যের মতন আমি দেখেছিলাম রঙিন ময়দান<br />গঙ্গার ধারের বিখ্যাত সূর্যাস্তে দারুণ জমকালো সব<br />সারবন্দী জাহাজ<br />ইডেন বাগানে প্যাগোডার চূড়ায় ক্যালেণ্ডারে ছবির মতন রোদ<br />পরেশনাথ মন্দিরের দিঘিতে নিরামিষ মাছেদের খেলা<br />বাসের জানলায় কাঠের হাত, দোকানের কাচে সাজানো<br />কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের বই<br />প্রভাত ফেরীর সরল গান, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে বাঁদরদের সঙ্গে পিকনিক<br />দুমাসে একবার মামাবাড়িতে বেড়াতে যাবার উৎসব…<br />ক্রমশ আমি নিজেই খুঁজে বার করি গোপন সব<br />ছোট ছোট নরক<br />কলাবাগান, গোয়াবাগান, পঞ্চাননতলা, রাজাবাজার<br />চিৎপুরের সুড়ঙ্গ, চীনে পাড়ার গোলোকধাম, সোনাগাছি, ওয়াটগঞ্জ, মেটেবুরুজ<br />একটু বেশি রাতে দেখা অজস্র ফুটপাথের সংসার<br />হাওড়া ব্রীজের ওপর দাঁড়ানো বলিষ্ঠ উলঙ্গ পাগলের<br />প্রাণখোলা বুককাঁপানো হাসি<br />চীনাবাদাম-ভাঙা গড়ের মাঠের গল্পের শেষে হঠাৎ কোনো<br />হিজড়ের অনুনয় করা কর্কশ কণ্ঠস্বর<br />আমায় তাড়া করে ফেরে বহুদিন<br />দশকর্ম ভাণ্ডারের পাশেগাড়িবারান্দার নীচে তিনটে কুকুর ছানার সঙ্গে<br />লাফালাফি করে একটি শিশু<br />কুকুরগুলোর চেয়ে শিশুটিই আগে দৌড়ে যায় ঝড়ের মতন লরির তলায়<br />সে তো যাবেই, যাবার জন্যই সে এসেছিল, আশ্চর্য কিছু না<br />কিন্তু পরের বছর তার মা অবিকল সেই শিশুটিকেই আবার<br />স্তন্য দেয় সেখানে<br />এইসব দেখে, শুনে, দৌড়িয়ে, জিরিয়ে।<br />আমার কণ্ঠস্বর ভাঙে, হাফ প্যান্টের নীচে বেরিয়ে থাকে<br />এক জোড়া বিসদৃশ ঠ্যাঙ<br />গান্ধী হত্যার বিকট টেলিগ্রাম যখন কাঁপিয়ে দেয় পাড়া<br />তখন আমি বাটখারা নিয়ে পাশের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে<br />ছিপি খেলছিলাম…</p>
<br /><p>ভেবেছিলাম আসবো, দেখবো, বেড়াবো, ফিরে যাবো, আবার আসবো<br />ভেবেছিলাম দূরত্বের অপরিচয় ঘুচবে না কখনো<br />ভেবেছিলাম এই বিশাল মহান, গম্ভীর সুদূর শহর<br />গা ছমছমে অচেনা হয়েই থাকবে<br />জেলেরা যেমন সমুদ্রকে, শেরপারা যেমন পাহাড়কে, তেমন ভারে<br />এই শহরকে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে চাইনি<br />এক সময় দুপুর ছিল দিকহীন চিলের ছায়ার সঙ্গে ছুটে যাওয়া<br />শৈশব মেশানো আলপথ, পুকুরের ধারে ঝুঁকে থাকা খেজুর গাছ<br />এক সময় ভোর ছিল শিউলির গন্ধ মাখা, চোখে স্থলপদ্মের স্নেহ<br />এক সময় বিকেল ছিল গাব গাছে লাল পিপড়ের কামড়<br />অথবা মন্দিরের দূরাগত টুংটাং<br />অথবা পাটক্ষেতে কচি অসভ্যতা<br />এক সময় সকাল ছিল নদীর ধারে স্কুল-নৌকোর প্রতীক্ষায়<br />বসে থাকা<br />অথবা জারুল বাগানে হঠাৎ ভয় দেখানো গোসাপের হাঁ<br />এক সময় সন্ধ্যা ছিল বাঁশ ঝাড়ে শাকচুন্নীদের<br />নাকিসুর শুনে আপ্রাণ দৌড়<br />অথবা বঞ্চিত রাজপুত্রদের কাহিনী<br />জামরুল গাছের নীচে<br />চিকন বৃষ্টিতে ভেজা<br />এক সময় রাত্রি ছিল প্রগাঢ় অকৃত্রিম নিস্তব্ধতা<br />মৃত্যুর কাছাকাছি ঘুম, অথবা প্রশান্ত মহাসমুদ্রে<br />আস্তে আস্তে ড়ুবে যাওয়া এক জাহাজ<br />গন্ধলেবুর বাগানে শিশিরপাতেরও কোনো শব্দ নেই<br />কোনো শব্দ নেই দিঘির জলে একা একা চাঁদের<br />অবিশ্রান্ত লুটোপুটির<br />চরাচর জুড়ে এক শান্ত ছবি, গ্রাম বাংলায়<br />মেয়েলি আমেজ মাখা সুখ<br />তার মধ্যে একদিন সব নৈঃশব্দ খান খান করে ভেঙে<br />সমস্ত সুখের নিলাম করা সুরে<br />জেগে উঠতো নিশির ডাক :<br />সস্তা না মূল? সস্তা না মূল…</p>
<br /><p>কৈশোর ভেঙেছে তার একমাত্র গোপন কার্নিস<br />কৈশোরই ভেঙেছে<br />ভেঙে গেছে যত ঢেউ ছিল দূর আকাশগঙ্গায়<br />শত টুকরো হয়ে গেছে সোনালী পীরিচ<br />সে ভেঙেছে, সে নিজে ভেঙেছে<br />পাথরকুচির আঠা দুই চোখে লেগেছিল তার<br />রক্ত ঝরে পড়েছিল হাতে<br />তবুও সমস্ত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে এসে<br />পা সেঁকে নিয়েছে গাঢ় আগুনের আঁচে<br />কৈশোর ভেঙেছে সব ফেরার নিয়ম<br />যেরকম জলস্তম্ভ ভাঙে<br />কৈশোর ভেঙেছে তার নীল মখমলে ঢাকা অতিপ্রিয় পুতুলের দেশ<br />সে ভেঙেছে অনুপম তাঁত<br />চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন প্রতিষ্ঠান, চুন, সুরকি, ধুলো<br />মৃত পাখিদের কলকণ্ঠস্বর উড়ে গেছে হাওয়ার ঝাপটে<br />যেখানে বরফ ছিল সেখানেই জলছে মশাল<br />যেখানে কুহক ছিল সেখানে কান্নার শুকনো দাগ<br />এখনো স্নেহের পাশে লেগে আছে ক্ষীণ অভিমান<br />আয়নায় যাকে দেখা, তাকেই সে ভেঙেছিল বেশি<br />কৈশোর ভেঙেছে সব, কৈশোরই ভেঙেছে<br />যখন সবাই তাকে সমস্বরে বলে উঠেছিল, মা নিষাদ<br />সেইক্ষণে সে ভেঙেছে, তার নিজ হাতে গড়া ঈশ্বরের মুখ<br />আমরা যারা এই শহরে হুড়মুড় করে বেড়ে উঠেছি<br />আমরা যারা ইট চাপা হলুদ ঘাসের মতন একদিন ইট ঠেলে<br />মাথা তুলেছি আকাশের দিকে<br />আমরা যারা চৌকোকে করেছি গোল আর গোলকে করেছি জলের মতন<br />সমতল<br />আমরা যারা রোদ্দুর মিশিয়েছি জ্যোৎস্নায় আর<br />নদীর কাছে বসে থেকেছি গাঢ় তমসায়<br />আমরা যারা চালের বদলে খেয়েছি কাঁকর, চিনির বদলে কাচ<br />আর তেলের বদলে শিয়ালকাঁটা<br />আমরা যারা রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা<br />মৃতদেহগুলিকে দেখেছি<br />আস্তে আস্তে উঠে বসতে<br />আমরা যারা লাঠি, টিয়ার গ্যাস ও গুলির মাঝখান দিয়ে<br />ছুটে গেছি এঁকেবেঁকে<br />আমরা যারা হৃদয়ে ও জঠরে জ্বালিয়েছি আগুন<br />সেই আমরাই এক একদিন ইতিহাস বিস্মৃত সন্ধ্যায়<br />আচমকা হুল্লোড়ে বলে উঠেছি, আঃ,<br />বেঁচে থাকা কি সুন্দর!<br />আমরা ধুসরকে বলেছি রক্তিম হতে, হেমন্তের আকাশে<br />এনেছি বিদ্যুৎ<br />আমরা ঠনঠননের রাস্তায় হাঁটুসমান জল ভেঙে ভেঙে<br />পৌঁছে গেছি স্বর্গের দরজায়<br />আমরা নাচের তাণ্ডব তুলে ভাঙিয়ে ডেকে তুলেছি মধ্যরাত্রিকে<br />আমরা নিঃসঙ্গ কুষ্ঠরোগীকে, পথভ্রান্ত জন্মান্ধকে, হাড়কাটার<br />বাতিল বেশ্যাকে বলেছি, বেঁচে থাকো<br />বেঁচে থাকো<br />হে ধর্মঘটী, হে অনশনী, হে চণ্ডাল, হে কবরখানার ফুলচোর<br />বেঁচে থাকো<br />হে সন্তানহীনা ধাইমা, তুমিও বেঁচে থাকো, হে ব্যর্থ কবি, তুমিও<br />বাঁচো, বাঁচো, হে আতুর, হে বিরহী, হে আগুনে পোড়া সর্বস্বান্ত, বাঁচো<br />বাঁচো জেলখানায় তোমরা সবাই বাঁচো হাসপাতালে তোমরা<br />বাঁচো, বাঁচো, বেঁচে থাকো, উড়তে থাক নিশান, জ্বলুক বাতিস্তম্ভ<br />হাড় পাঁজরায় লেপটে থাক শেষ মুহূর্ত ভূমিকম্প<br />অথবা বজ্রপাতের মতন আমরা তুলেছি বেঁচে থাকার তুমুল হুঙ্কার<br />ধ্বংসের নেশায়, ধ্বংসকে ভালোবেসে আমরা চেয়েছি জন্মজয়ের প্রবল।<br />উখান।</p>
<br /><p>যারা অপমান দিয়ে চকিতে মিলিয়ে গেছে পথের বাঁকে, তারা।<br />হয়তো ভুলে গেছে, আমি ভুলিনি<br />স্মৃতির মধ্যে ঢুকেছিল বীজ, একদিন তা মহীরুহ হয়েছে<br />সমস্ত গভীরতার চেয়ে গভীর পাতালতম প্রদেশে তার শিকড়<br />সমস্ত উচ্চতার চেয়ে উঁচুতে অভ্রংলিহ তার শিখর<br />তার হিরণ্য ডালপালায় বসেছে এক পাখি যার হীরে কুচি চোখ<br />বহুদিনের অতীত ভেদ করে সে বলেছে, প্রতীক্ষায় আছি<br />আমার সারা শরীরে ঝাঁকুনি লাগে, কার জন্য প্রতীক্ষা?<br />কিসের জন্য প্রতীক্ষা?<br />আমি বিহ্বল হয়ে আকাশের দিকে তাকাই, আকাশকে মনে হয়<br />বারুদখানা<br />আমি বৃষ্টির মধ্যে সরু হয়ে হেঁটে যাই, বৃষ্টিকে মনে হয়<br />তেজস্ক্রিয়<br />আমি জানলার গরাদের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার প্রাণ-প্রতিমাকে<br />প্রশ্ন করি, জানো, কার জন্য প্রতীক্ষা?<br />কিসের প্রতীক্ষা?<br />এ তো প্রতিশোধ নয়, প্রতিশোধের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক মনোরাজ্য<br />যার কামারশালায় বিচ্ছুরিত শব্দের ফুলকি সর্বক্ষণ<br />ঘিরে রাখে আমার<br />একলা সময়<br />আসলে আমার একাকিত্ব নেই, আমার নির্জনতা নেই, মুক্তি নেই<br />এক একদিন এই শহর স্তব্ধ হয়ে যায়<br />এক একদিন এই চোখে দেখা জগতে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়<br />সমস্ত জনপ্রাণী<br />সেই মাতৃগর্ভের মতন নিবাত নিষ্কম্প অস্তিত্বের মধ্যেও<br />জেগে থাকে আদিম শব্দ<br />সমস্ত জাগরণের পাশে সেই এক মহা জাগরণ<br />সমস্ত ধ্বনির চেয়ে সেই এক আলাদা ধ্বনি<br />তখন সমস্ত অন্ধকারের পাশে এসে দাঁড়ায়।<br />এক অন্য অন্ধকার<br />স্পষ্ট চেনা যায় এক একবার, আবার চেনা যায় না<br />গভীর অতলের মধ্যে ড়ুবে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকড়ে ধরি<br />ভাসমান তৃণ<br />এই নিমজ্জন ও ভেসে ওঠা, বারবার, যেন শরীরের মধ্যেই<br />শরীরকে খোঁজাখুঁজি<br />যেমন নারীর ভিতরে নারীকে, তার ভিতরে এক অন্য নারী, যেমন<br />স্তন ও কোমরের খাঁজে অন্য এক<br />রূপের চোখ ফাটানো বিভা,<br />তার ভিতরে অন্য এক, তার<br />ভিতরে, তার ভিতরে,<br />যেমন স্বপ্নের মধ্যে<br />স্বপ্ন…</p>
<br /><p>এমনকি যেখানে সুন্দর অতি প্রথাসিদ্ধ, অরণ্যে বা পাহাড় চূড়ায়<br />যেখানে মেঘ ও রৌদ্রের খেলায় মেতে থাকে মেঘ ও রৌদ্রের প্রভুরা<br />সেখানে সমস্ত আলোর পাশে উড়তে থাকে আরও একটি আলোর পর্দা<br />সমস্ত বৃক্ষের মাথা ছাড়িয়ে উঠে আসে আর একটি বৃক্ষ, তার<br />হিরণ্য ডালপালা নিয়ে<br />সেখানে বসে থাকে একটি পাখি, যার হীরে কুচি চোখ<br />অচেনাতম কণ্ঠস্বরে সে বলে ওঠে, মনে আছে? প্রতীক্ষায় আছি!<br />তখনই শৃঙ্খলের মতন ঝনঝনিয়ে ওঠে নাদব্রহ্ম, তখনই<br />ছ’ নম্বরের দিকে ব্যাকুলভাবে চায় পাঁচটি ইন্দ্রিয়<br />কার প্রতীক্ষা? কিসের জন্য প্রতীক্ষা? উত্তর পাই না<br />যদিও জানি, এই নীলিমার পরপারে নেই আর অন্য নীলিমা<br />মৃত্যুর ওপারে জীবন!</p>
<br /><p>ছায়ার ভিতর থেকে বের হয়ে আসে ছায়া, সমান দূরত্ব রেখে<br />যমজের মতো ছুটে যায়<br />অথবা হ্রদের পাশে খুব শান্তভাবে বসে থাকা, যেন দু’রকম জলের কিনারে<br />দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়,দেখা হলো, দেখা হলো<br />রোদ্দুরের মধ্যে ওড়ে কার্পাস তুলোর বীজ,<br />এত মায়া, এত বেশি মায়া<br />সব কিছু এক জীবনের নর্ম সহচর, দেখা হলো, আরক্ত সন্ধ্যায়<br />দেখা হলো<br />দেখা হলো নারী ও নৈরাজ্য, কয়েক ফোঁটা ছন্নছাড়া কান্না বিন্দু<br />পড়ে রইলো ঘাসে<br />এদিকে ওদিকে জাগে আকস্মিক হাতছানি, যে-কোনো নদীর বাঁকে<br />চোখের ইশারা<br />দেখা হলো, পাথরের বুকে ঘুম, নদীর দর্পণে লুপ্ত সভ্যতার সঙ্গে<br />দেখা হলো<br />জননী-চুম্বক ছেড়ে আরও দূরে দেখা হলো নিভৃত শিল্পের বড়<br />মর্মভেদী টান<br />দেখা হলো, দেখা হলো, দেখা…</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/mon-bhalo-nei/মন ভালো নেই 2019-03-23T01:23:56-04:002023-06-27T09:25:16-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই<br />কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই<br />চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি<br />প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়<br />আশায় আশায় আশায় আশায়<br />এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ<br />এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী<br />এমনকি সুরা এমনকি ভাষা<br />মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই<br />বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে<br />একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে<br />কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি<br />কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না<br />আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল<br />আমার কী আছে অথবা কী ছিল<br />ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে<br />যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন<br />মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই<br />তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়<br />আশায় আশায় আশায় আশায় ..</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/jodi-nibasan-dao/যদি নির্বাসন দাও2018-11-14T06:49:32-05:002023-06-27T09:28:16-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো<br /> আমি বিষপান করে মরে যাবো!<br />বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ<br /> নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ<br /> প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-<br /> এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি<br />যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো<br /> আমি বিষপান করে মরে যাবো।</p>
<br /><p>ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত<br /> এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম<br />এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম<br />এখনো নদীর বুকে<br /> মোচার খোলায় ঘোরে<br /> লুঠেরা, ফেরারী!<br />শহরে বন্দরে এত অগ্নি বৃষ্টি<br /> বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর<br />বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা<br /> বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা<br />বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা<br /> বুলেট ও বিস্ফোরণ<br /> শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ<br /> রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল-<br /> এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি<br />যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো<br /> আমি বিষপান করে মরে যাবো।</p>
<br /><p>কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে<br />নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক<br />আমি কি ভুলেছি সব<br /> স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?<br />আমি কি দেখিনি কোনো মন্থর বিকেলে<br /> শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি?<br />মোষের ঘাড়ের মত পরিশ্রমী মানুষের পাশে<br /> শিউলি ফুলের মত বালিকার হাসি<br />নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ<br />শুনিনি কি দুপুরে চিলের<br /> তীক্ষ স্বর?<br />বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…<br /> এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি<br />যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো<br /> আমি বিষপান করে মরে যাবো।<br /> =======<br />জুলাই ১৯৭১ : গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/nirar/নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা2018-04-23T05:50:58-04:002023-06-27T18:10:50-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা<br />এ-কবিতা মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে<br />ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের<br />থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে একমুহূর্ত ভাববে<br />কে তোমার কথা মনে করছে এত রাত্রে–তখন আমার <br />এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কম ড্যাস রেফ্<br />ও রয়ের ফুট্কি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার<br />আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও<br />বিছানায় আমার নিশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলি<br />এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু<br />তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে</p>
<br /><p>তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি<br />আমার ভয়ংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে<br />আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও<br />চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না–আমার সম্পূর্ণ আবেগ<br />শুধু মোমবাতির আলোর মাতো ভদ্র হিম,<br /> শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়<br />তোমার শিয়রের কাছে যাবে–এরা তোমাকে চুম্বন করলে<br />তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে<br />এক বিছানায়–তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের<br />কাছে মরা প্রজাপতির মতো এরা লুটোবে। এদের আত্মা মিশে<br />থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো</p>
<br /><p>বহুদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো<br />হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে। নীরা, আমি তোমার অমন<br />সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো। আমি অন্য কথা<br />বলার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে মনে<br />ঘরভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে<br /> নিজস্ব চোখে তাকাবো।<br />তুমি জানতে পারবে না–তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে<br />আমার একটি অতি-ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/rakhal/রাখাল2018-01-13T07:09:14-05:002023-06-27T09:28:12-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>লাল ও সবুজ আলোর মধ্যে অন্তকাল<br />আমি ডাইনে তাকাই পিছনে ফিরে অন্ধকার গলিতে<br />অনন্তকাল পিছনে নয়, ডাকদিকে নয়, সবুজ ও লাল-<br />সুখের মতো ভূবিস্তৃত, ঊরুদ্বয়ে শোকের মতো, দৃষ্টি থেকে ঘুমের মতো<br />পেরিয়ে যাই, কুসুম এবং ফলের কাছে বীজের মতো<br />দীক্ষা নিতে,<br />মৃত্যু থেকে সঙ্গোপনে শুন্য ঘরে, দ্রাক্ষাবনের<br />ছঅই বাতাস, জ্ঞানী মাথার খুলী, নদীর ভাঙ্গা পাড়ের শুকনো পাতা-<br />পেরিয়ে যাই মাঝরাতের পাঠশালার হাজার চোখ, ধূসর খাতা,<br />পেরিয়ে যাই ভূমিকম্প, সূচের সরুগর্ত দিয়ে অনন্তকাল<br />রেশমী প্যান্ট, কোমরবন্ধ, হাতে চুরুট; তবু আমায় বলো, ‘রাখাল’।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sobddo-2/শব্দ ২2018-01-13T07:08:22-05:002023-06-27T09:28:03-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমায় অনুসরণ করে আঠাশ বছর পেরিয়ে আসা শব্দ<br />যেন তাকায় অতিকুসীদ, যেন হরণ দাবি করে<br />যেন আমার বুকের মধ্যে তুঁত পোকার মতো নড়ে<br />অনুসরণ অনুসরণ শব্দ শব্দ ওঁ শব্দ</p>
<br /><p>অতিক্ষিদেয় খেয়েছিলাম সাতশো বিবেক, শব্দ বললো, ‘আমি আছি’<br />শব্দ আমায় ট্রাম ভাড়া দেয়, বায়োস্কোপে টিকিট কাটে<br />খুনের রক্তে চোখ ভেসে যায়, দৈবে ঘুরি ঘোর ললাটে<br />অন্ধকারে মুখ দেখি না মুখের ভয়ে, শব্দ বললো, ‘আমি আছি!’ ওঁ শব্দ<br />আঠাশ বছর পবিত্রতার তুক শেখালো, বিনা সুদে আগাম লগ্নী<br />ওঁ স্বর্ণ ওঁ প্রেম ওঁ বেশ্যা ওঁ মধু ওঁ ভুঃ ওঁ দুঃখ<br />ওঁ ছায়া ওঁ কাম ওঁ মায়া ওঁ স্বর্গ ওঁ পাপ ওঁ অগ্নি</p>
<br /><p>আঠাশ বছর শিল্প ভেবে হাতে রইলো সবুজ খড়ি<br />এখন এলাম ঋণের ভয়ে ইস্টিশনে তড়িঘড়ি<br />কেউ দেখেনি শরীর আমার শরীরীভূত, জ্বলে উঠলো তবু হঠাৎ<br />নাদ অগ্নি। ওঁ অগ্নি<br />আঠাশ বছর অনুসরণ যেন হরণ দাবী করে<br />যেন আমার বুকের মধ্যে তুঁত পোকার মতো নড়ে<br />অনুসরণ অনুসরণ শব্দ শব্দ মৃত্যুশব্দ। ওঁ শব্দ।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/kabitar-jonno/শুধু কবিতার জন্য2018-01-13T07:07:15-05:002023-06-27T09:27:52-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার<br />জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা<br />ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য<br />অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;<br />শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু<br />কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত<br />শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।<br />মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু<br />কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/gaytri/সকল ছন্দের মধ্যে আমিই গায়ত্রী2018-01-13T07:05:59-05:002023-06-27T09:27:49-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ছিলাম বাসনা-লঘু, ছন্দ এসে আমাকে সুসি’র হতে বলে<br />প্রিয় বয়স্যের মতো তার দন্তপঙ্ক্তি<br />আমি তাকে দূর হয়ে যেতে বলি নতুন বন্ধুর খোঁজে<br />আমি ছন্দহীন হতে হতে ক্রমশ ধর্মদ্রোহী আগোপন<br />পাষন্ড হয়ে যাই।<br />তবু সে দরজার কাছে মুখ চুন, আমি তাকে পালঙ্কের নিচ থেকে<br />জুতো মুখে করে আনতে হুকুম করেছি!<br />দ্বিধা নেই, সে এনেছে, সমালোচকের কানে মেরেছে চপ্পল।</p>
<br /><p>সে আমার হাত ধরে স্ফটিকবর্ণের এক নারীর সান্নিধ্যে<br />টেনে আনে, মাত্রাহীন আঙুল তুলে নারীকে দেখিয়ে বলে,<br />সকল ছন্দের মধ্যে এই যে গায়ত্রী, তুমি নাও,<br />গায়ত্রীর মতো নারী শুয়ে আছে, বিশাল জঘন মেলে,<br />পর্ব ভেঙে ইশারায় আমাকে উপুড় হতে বলে<br />আমি তার শরীর বিস্তৃত করি, দুই বক্ষোদেশ ছিঁড়ে ক্রমশ পয়ারে<br />নিয়ে আসি, ঊরুদ্বয়ে কিছু কথ্য অশ্লীলতা মিশিয়ে চকিতে<br />খুলে ফেলি আরবের অলঙ্কার, যদিও নিশ্চিত<br />কাঙাল কুকুর হয়ে মাঝে মাঝে আমি বড় মিলন প্রত্যাশী।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/sabdhan/সাবধান2018-01-13T07:04:31-05:002023-06-27T09:27:11-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমি সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো<br />আমি ফিরে এসেছি<br />আমার কপালে রক্ত;<br />বাষ্প-জমা গলায় বাস-ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে<br />ফিরে এলাম-<br />আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি<br />আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে<br />আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ<br />আমার নিশ্বাস-।</p>
<br /><p>রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করলো<br />আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী-<br />পিছনের দরজায় বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা<br />আমি তার হত্যার জন্য দায়ী-<br />আমি পুলিশের বোকামি দেখে প্রকাশ্যে হাসাহাসি করবো<br />আমি নেহেরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি<br />কম্যুনিষ্টদের শ্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;<br />আমি ভয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে জেগে উঠবো মমতায়<br />আমি মেয়েটির কাছে গিয়ে নিঃশব্দে মুখ চুম্বন করবো<br />সশরীরে বিছানায় শুয়ে দু’জনে কাঁদবো নানা ধরনে<br />পরদিন ঠিকঠাক বেঁচে উঠতে হবে, এই জেনে।</p>
<br /><p>আমার গলা পরিস্কার, আমি স্পষ্ট করে কথা বলবো<br />সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ<br />ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে শুদ্ধভাবে<br />আমি<br />আজ উচ্চারণ করবো সেই পরম মন্ত্র<br />আমাকে চাঁচাতে না দিলে এ পৃথিবীও আর বাঁচবে না।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/narir-jonno/হঠাৎ নীরার জন্য2018-01-09T15:25:53-05:002023-06-27T09:37:23-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল<br /> স্বপ্নে বহুক্ষণ<br />দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–<br />বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে<br />তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের<br />নীল দুঃসময়ে।</p>
<br /><p>দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি<br />আজই কি ফিরেছো?<br />স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন<br />তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে<br />তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,<br />অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।</p>
<br /><p>এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম<br />ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়<br />বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা<br />নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি<br />এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে<br />বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে<br />পুণ্যবান হবো।</p>
<br /><p>বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,<br /> বাড়িতে আসবেন!’</p>
<br /><p>রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।<br />‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে<br />কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে<br />সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন<br />ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে<br />পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়।</p>
<br /><p>বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ-আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/himzug/হিমযুগ2018-01-09T15:21:04-05:002023-06-27T09:26:28-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে<br />কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-<br />শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি<br />মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি<br />কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-</p>
<br /><p>আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি<br />কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।<br />নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা<br />ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে<br />অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর<br />তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী<br />কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।</p>
<br /><p>মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,<br />স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে<br />মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে<br />ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী<br />তুমি কথা দিয়েছিলে…..<br />এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু<br />কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা<br />ঊরুর শীৎকার<br />মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য<br />নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার<br />পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি<br />উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/onirdishto-nayeeka/অনির্দিষ্ট নায়িকা2018-01-05T15:30:58-05:002023-06-27T18:49:59-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ফিরে যাবো, শীত শেষে অবিশ্বাসী মরালের মতো<br />অন্ধকার শুভ্ৰ হলে, ফিরে যাবো, হে সখি নিরালা,<br />উরসে চন্দন গন্ধ, বিন্দু বিন্দু রক্ত ইতস্তত<br />তোমার শিশির-স্বাদ মুখ আর দৃষ্টিপাত মালা—<br />ফেলে আমি চলে যাবো, নির্বাসনে, হে সখি নিরালা।</p>
<br /><p>যৌবন আশ্রিত বুঝি দীর্ঘ ঋজুরাত্রির শরীরে ;<br />দিনের আলোয় তুমি, ভীরু প্ৰাণ পতঙ্গের মতো ।<br />আমাকে ডেকেছো তাই স্রোতস্বিনী তমসার তীরে<br />অসহিষ্ণু বাসনায় নিজেকে ঢেকেছো অবিরত !<br />দিনের আলোয় তুমি মৃত্যুমুখী পতঙ্গের মতো।</p>
<br /><p>করুণ শয্যায় লগ্ন ঘন নীল তোমার বসন–<br />সমুদ্র, আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল,<br />তুলে নাও নতমুখে, লজ্জা ঢাকো, বিচ্ছেদের ক্ষণ<br />বিষাদের নীল শিখা চক্ষে জ্বলো, তারো সঙ্গে মিল<br />সমুদ্র আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল।</p>
<br /><p>ফিরে যাবো সব ফেলে দুঃখে, সুখে, হে সখি নিরালা,<br />শরীরে স্পর্শের স্বাস মুছে নেবে দিবসের চোখ<br />জনারণ্য উপহার দেবে শুধু অতৃপ্তির জ্বালা<br />আবার উষসী এলে ফিরে পাবো বিচ্ছেদের শোক ।<br />চতুর্দিকে রবে শুধু দিবসের শত তীক্ষ্ণ চোখ ।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/joyee-noi-porajito-noi/জয়ী নই, পরাজিত নই2018-01-05T15:11:22-05:002023-06-27T09:30:51-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল<br />আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি<br />এই আক্ষরিক সত্যের কছে যুক্তি মূর্ছা যায়।<br />শিহরিত নির্জনতার মধ্যে বুক টন্টন করে ওঠে<br />হাল্কা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন<br />সবুজকে ধূসর হতে ডাকে<br />আ-দিগন্ত প্রান্তের ও টুকরো ছড়ানো টিলার উপর দিয়ে<br />ভেসে যায় অনৈতিহাসিক হাওয়া<br />অরণ্য আনে না কোনো কস্তুরীর ঘ্রাণ<br />কিছু নিচে ছুটন্ত মহিলার গোলাপি রুমাল উড়ে গিয়ে পড়ে<br />ফণমনসার ঝোপে<br />নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় খরগোশ আর রোদ্দুর।</p>
<br /><p>এই যে মুহূর্তে, এই যে দাঁড়িয়ে থাকা–এর কোনো অর্থ নেই<br />ঝর্নার জলে ভেসে যায় সম্রাটের শিরস্ত্রাণ<br />কমলার কোয়া থেকে খসে পড়া বীজ ঢুকে পড়ে পাতাল গর্ভে<br />পোল্কা ডট্ দুটি প্রজাপতি তাদের আপন আপন কাজে ব্যস্ত<br />বাব্লা গাছের শুক্নো কাঁটাও দাবী করেছে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব।<br />সব দৃশ্যই এমন নিরপেক্ষ<br />আমি জয়ী নই, আমি পরাজিত নই, আমি এমনই একজন মানুষ<br />পাহাড় চূড়ায় পৃথিবীকে পদতলে রেখে, আমার নাভিমূল<br />থেকে উঠে আসে বিষণ্ন, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস<br />এই নির্জনতাই আমার ক্ষমাপ্রার্থী অশ্রুমোচনের মুহূর্ত।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/icche/ইচ্ছে2018-01-05T15:06:36-05:002023-06-27T17:53:32-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে<br />দুটো চারটে নিয়মকানুন ভেঙে ফেলি<br />পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট<br />যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি<br />কাচের চুড়ি ভাঙার মতই ইচ্ছে করে অবহেলায়<br />ধর্মতলায় দিন দুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি।<br />ইচ্ছে করে দুপুর রোদে ব্ল্যাক আউটের হুকুম দেবার<br />ইচ্ছে করে বিবৃতি দিই ভাঁওতা মেরে জনসেবার<br />ইচ্ছে করে ভাঁওতাবাজ নেতার মুখে চুনকালি দিই।<br />ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মঠে<br />ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মূর্গিহাটায়<br />বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাচের চুড়ি দেখলে ভাঙি<br />ইচ্ছে করে লন্ডভন্ড করি এবার পৃথিবীটাকে<br />মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি<br />আমার কিছু ভাল্লাগে না।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/aami-kirokom-bhabe-benche-achi/আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি2018-01-05T14:52:48-05:002023-11-10T11:39:44-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ<br />এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ<br />পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা<br />আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা<br />করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে<br />থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে<br />হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি, <br />মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি<br />অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-<br />(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)<br />আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে<br />সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক<br />ঘামে ছিল না এমন গন্ধক<br />যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে<br />কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে<br />বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;<br />আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।<br />আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।<br />আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,<br />আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।<br />নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে<br />জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে<br />ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো<br />কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত<br />দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,<br />আমার ঘরের<br />দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের<br />হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে<br />দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে<br />হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার<br />একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়অর;<br />ইচ্ছে ছিল না জানাবার<br />এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে<br />এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্ড়ে<br />টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়<br />আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়<br />কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে<br />বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে<br />তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার<br />নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য<br />পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/byartho-prem/ব্যর্থ প্রেম2018-01-05T14:42:17-05:002023-06-27T09:24:53-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়<br />আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি<br />দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত<br />ছড়িয়ে যায়<br />আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক<br />অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে<br />হেঁটে যাই <br />সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না<br />আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই<br />রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট<br />অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে<br />খসে পড়ে<br />আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ<br />ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে<br />মনে হয় খুব আপন<br />আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা<br />প্যান্ট শার্ট পরে<br />আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে<br />আমি নিজেই আদর করি<br />খুব গোপনে<br />আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ<br />আমার সর্বাঙ্গে কোথাও<br />একটুও ময়লা নেই<br />অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার<br />মাথার পেছনে<br />আর কেউ দেখুক বা না দেখুক<br />আমি ঠিক টের পাই<br />অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য<br />আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও<br />আঘাত না লাগে<br />আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/uttoradhikar/উত্তরাধিকার2018-01-05T14:40:49-05:002023-06-27T18:27:34-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ<br />তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর<br />ফুসফুস-ভরা হাসি<br />দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা<br />এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা<br />আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ <br />নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ<br />জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে<br />বালিকার প্রতি বারবার ভুল<br />পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক<br />অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর<br />বুক চিরে দেখা<br />আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত<br />একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী —<br />এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে<br />আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর<br />তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও<br />অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার<br />তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/jonmo-hoy-na-mrityu-hoy-n/জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না2018-01-05T14:39:13-05:002023-06-27T17:47:09-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না<br />মৃত্যু হয় না –<br />কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না<br />শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।<br />আমার কেউ নাম রাখেনি, তিনটে-চারটে ছদ্মনামে<br />আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে,<br />আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার<br />হাত পুড়ে যায়<br />অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমায়ায়<br />অন্ধকারে মিশে থেকেছি<br />কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি<br />তবুও আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভেলোবেসেছি<br />আমার কোনো ভয় হয় না,<br />আমার ভালোবাসার কোন জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ekush/স্বপ্ন, একুশে ভাদ্র2018-01-05T14:28:43-05:002023-06-27T09:37:33-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কোন্ দিকে? কোন্ দিকে? আমি চিৎকার করলাম<br />অমনি ভিড়ের ভিতরে<br />একটা মোহর এসে ছিট্কে পড়লো। তৎক্ষণাৎ নৈঋত বাদ দিয়ে<br />সাতদিকে সাতটা রাস্তা খুলে গেল জ্যোৎস্নায়<br />বড় চিত্তহারী সেই পথগুলি এবং জ্যোৎস্নায়<br />ভিড়ের প্রতিটি টুকরো শত শত হুইস্ল বাজিলে ছুটে গেল<br />ব্যক্তিগত পথে পথে। কোন্ দিকে? কোন্ দিকে?<br />আমি তীব্র ধাবমান<br />কয়েকটি কলার চেপে হেঁকে উঠি, কী-করে জানলেন এইটা ঠিক<br />পথ? নাকি যে-কোন রাস্তায়?<br />তাদের উত্তরঃ পথ ও রাস্তার মধ্যে বহু ভেদ আছে, ইডিয়ট!<br />পথ কিংবা রাস্তা আমি কোন্টায় নামবো বহু ভেবে শেষটায়<br />পথেই নামলুম। কেননা ‘পথিক’ এই সুদূর শব্দটি<br />বড়ই রোমাঞ্চকর। তার বদলে ‘রাস্তার লোকটা’?<br />পরমুহূর্তেই হায়, কয়েকশত প্রেমিক ও<br />কবিদের স’তি, উপমার<br />ভয়ংকর নেকড়েগুলি ছিঁড়ে চুষে খেয়ে ফেললো<br />আমার শরীর রক্ত দু’চোখের মণি।।</p>
<br /><p>কাব্যগ্রন্থঃ-আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/che/চে গুয়েভারার প্রতি2018-01-04T12:26:35-05:002023-06-27T13:18:33-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়<br />আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা<br />আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ<br />শৈশব থেকে বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস<br />চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-<br />বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা<br />তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর<br />তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে<br />নেমে গেছে<br />শুকনো রক্তের রেখা<br />চোখ দুটি চেয়ে আছে<br />সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে<br />চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।<br />শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-<br />আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার<br />আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়<br />লুকিয়ে থেকে<br />সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার<br />আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে<br />ছুটে যাওয়ার<br />আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে<br />বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-<br />কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!</p>
<br /><p>এতকাল আমি একা, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি<br />কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি<br />আমি ট্রেনের জানালার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা<br />মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়<br />আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা<br />ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে<br />আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি<br />সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো<br />আমি আবার ফিরে আসবো<br />আমার হাতিয়ারহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,<br />মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!<br />চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-<br />আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত<br />দেরি হয়ে যাচ্ছে<br />আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,<br />আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে<br />চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/kbir-mtityu/কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে 2018-01-04T12:21:50-05:002023-08-31T05:04:51-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>দু’জন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী<br />কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে<br />কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছ কেন?<br />সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না;<br />সিপাহী দু’জনেরই জিভ কাটা।<br />অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ<br />তাদের মুখে কঠোর বিষণ্নতা<br />তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা।<br />মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পাড় দিয়ে<br />ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে-<br />ফসল কাটা মাঠে এখন<br />সদ্যকৃত বধ্যভূমি।<br />সেখানে আরও চারজন সিপাহী রাইফেল হাতে প্রস্তুত<br />তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ<br />কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে<br />কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে<br />কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে<br />কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে<br />কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে<br />জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি<br />যুবক এনেছে তার যুবতীকে<br />বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরের কাঁধ<br />সবাই এসেছে একজন কবির<br />হত্যাদৃশ্য<br />প্রত্যক্ষ করতে।<br /> <br />খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে,<br />তিনি দেখতে লাগলেন<br />তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো-<br />কনিষ্ঠায় একটি তিল, অনামিকা অলঙ্কারহীন<br />মধ্যমায় ঈষৎ টনটনে ব্যথা, তর্জনী সঙ্কেতময়<br />বৃদ্ধাঙ্গুলি বীভৎস, বিকৃত-<br />কবি সামান্য হাসলেন,<br />একজন সিপাহীকে বললেন, আঙুলে<br />রক্ত জমে যাচ্ছে হে,<br />হাতের শিকল খুলে দাও!<br />সহস্র জনতার চিৎকারে সিপাহীর কান<br />সেই মুহূর্তে বধির হয়ে গেল।<br /> <br />জনতার মধ্য থেকে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন একজন কসাইকে,<br />পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, ততই মুর্গী কমে যাচ্ছে।<br />একজন আদার ব্যাপারী জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে বললেন,<br />কাঁচা লঙ্কাতেও আজকাল তেমন ঝাল নেই!<br />একজন সংশয়বাদী উচ্চারণ করলেন আপন মনে,<br />বাপের জন্মেও এক সঙ্গে এত বেজম্মা দেখিনি, শালা!<br />পরাজিত এম এল এ বললেন একজন ব্যায়ামবীরকে,<br />কুঁচকিতে বড় আমবাত হচ্ছে হে আজকাল!<br />একজন ভিখিরি খুচরো পয়সা ভাঙিয়ে দেয় বাদামওয়ালাকে<br />একজন পকেটমারের হাত আকস্মাৎ অবশ হয়ে যায়<br />একজন ঘাটোয়াল বন্যার চিন্তায় আকুল হয়ে পড়ে<br />একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী তাঁর ছাত্রীদের জানালেন<br />প্লেটো বলেছিলেন…<br />একজন ছাত্র একটি লম্বা লোককে বললো,<br />মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা!<br />এক নারী অপর নারীকে বললো,<br />এখানে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিলে পারতো…<br />একজন চাষী একজন জনমজুরকে পরামর্শ দেয়,<br />বৌটার মুখে ফোলিডল ঢেলে দিতে পারো না?<br />একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে,<br />রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না।<br />তবু একজন সম্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, এ তো ভুল লোককে<br />এনেছে। ভুল মানুষ, ভুল মানুষ।<br /> <br />রক্ত গোধূলির পশ্চিমে জ্যোৎস্না, দক্ষিণে মেঘ<br />বাঁশবনে ডেকে উঠলো বিপন্ন শেয়াল<br />নারীর অভিমানের মতন পাতলা ছায়া ভাসে<br />পুকুরের জলে<br />ঝুমঝুমির মতন একটা বকুল গাছে কয়েকশো পাখির ডাক<br />কবি তাঁর হাতের আঙুল থেকে চোখ তুলে তাকালেন,<br />জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে<br />রেখা ও অক্ষর থেকে রক্তমাংসের সমাহার<br />তাঁকে নিয়ে গেল অরণ্যের দিকে<br />ছেলেবেলার বাতাবি লেবু গাছের সঙ্গে মিশে গেল<br />হেমন্ত দিনের শেষ আলো<br />তিনি দেখলেন সেতুর নিচে ঘনায়মান অন্ধকারে<br />একগুচ্ছ জোনাকি<br />দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল, তিনি বুঝতে পারলেন<br />সমুদ্র থেকে আসছে বৃষ্টিময় মেঘ<br />তিনি বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে আবার<br />দেখতে পেলেন অরণ্য<br />অরণের প্রতিটি বৃক্ষের স্বাধীনতা-<br />গাব গাছ বেয়ে মন্থরভাবে নেমে এলো একটি তক্ষক<br />ঠিক ঘড়ির মতন সে সাত বার ডাকলো :<br />সঙ্গে সঙ্গে ছয় রিপুর মতন ছ’জন<br />বোবা কালা সিপাহী<br />উঁচিয়ে ধরলো রাইফেল-<br />যেন মাঝখানে রয়েছে একজন ছেলেধরা<br />এমন ভাবে জনতা ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো<br />ইনকিলাব জিন্দাবাদ!<br />কবির স্বতঃপ্রবৃত্ত ঠোঁট নড়ে উঠলো<br />তিনি অস্ফুট হৃষ্টতায় বললেন :<br />বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!<br />মানুষের মুক্তি আসুক!<br />আমার শিকল খুলে দাও!<br />কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ<br />নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী<br />তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন<br />কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,<br />বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও<br />প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!<br /> <br />প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-<br />যেমন যায়,<br />কবি নিঃশব্দে হাসলেন<br />দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল<br />কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে<br />তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ<br />কবি শান্ত ভাবে বললেন,<br />আমি মরবো না!<br />মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।<br />চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল<br />পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি<br />ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত<br />ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল<br />কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে<br />জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-<br />কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না<br />কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্কে পড়া মাত্রই<br />আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে<br />শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার<br />নড়ে উঠলো কি উঠলো না<br />কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।<br /> <br />আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো<br />মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,<br />বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/keu-katha-rakheni/কেউ কথা রাখেনি2018-01-04T09:44:55-05:002024-02-22T23:19:26-05:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি<br />ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল<br />শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে<br />তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী <br />আর এলোনা<br />পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।</p>
<br /><p>মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর<br />তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো<br />সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর <br />খেলা করে!<br />নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ <br />ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় <br />তিন প্রহরের বিল দেখাবে?</p>
<br /><p>একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো<br />লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা<br />ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি<br />ভিতরে রাস-উৎসব<br />অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা<br />কত রকম আমোদে হেসেছে<br />আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!<br />বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…<br />বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই<br />সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব<br />আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!</p>
<br /><p>বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,<br />যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে<br />সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!<br />ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি<br />দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়<br />বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম<br />তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ<br />এখনো সে যে-কোনো নারী।<br />কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/tumi/তুমি2018-01-04T07:14:39-05:002023-06-27T18:35:11-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে<br />তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।<br />রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে<br />ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।</p>
<br /><p>বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর<br />অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না<br />তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর<br />আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।</p>
<br /><p>সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন<br />দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,<br />তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-<br />জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা</p>
<br /><p>তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান<br />রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর<br />তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ<br />অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।</p>
<br /><p>যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে<br />অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে<br />দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে<br />বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/ghum-vangar-por/ঘুম ভাঙার পর 2018-01-04T07:12:33-05:002023-06-27T18:29:35-04:00সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়https://www.bangla-kobita.com/sunilgangopadhyay/<p>ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।<br />হলুদ-তেল মাখা একটি সকাল,<br />ঝর্নার জলে বৃষ্টিপাতের মতন শব্দ<br />ঝুল বারান্দার সামনের বাগানে কেউ হাসছে<br />শীতের রোদ্দুরের মতন।</p>
<br /><p>কিছু ভাঙছে, কিছু খসে যাচ্ছে<br />বইয়ের পাতায় কার আঙুল, এখুনি যাবে অন্য পাতায়।<br />দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের সুর<br />ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।</p>@ 2024 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়