কবিতা (৮)
**********
              কবি বুদ্ধদেব বসু ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সমালোচক, তাঁকে বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে গণ্য করা হয় ।

              ইংরেজী ভাষায় তাঁর বেশ অধিকার ছিল এবং ইংরেজীতেও তিনি অনেক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন । আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য ।

              আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় 'কল্লোল যুগ' সেই অধ্যায়ের তরুণতম ও ক্রমে ক্রমে প্রধানতম কবি হয়ে উঠেছিলেন  কবি বুদ্ধদেব বসু । পরিমার্জিত ও পরিশীলিত  শৈলীতে সিদ্ধ কবি বুদ্ধদেব বসু'র রচনা পাঠকের  কাছে এক উচ্চমাত্রার আসন অধিকার করে আছে ।

               কবি বুদ্ধদেব বসু'র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি' ।কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি অকাতরে লিখেছেন ।

              তাঁর লেখা প্রেমের কবিতাগুলো এক অন্যতম মাধুর্য্যের স্বাদে মনোগ্রাহী ও পাঠক সমাদৃত । আমার প্রিয় তাঁর একটি বহুল  চর্চিত প্রেমের কবিতা - এই কবিতা আসরের কবিতা পাগল কবি-পাঠকদের জন্যে উপস্থাপিত করলাম - বিশেষতঃ যারা আগে পড়েন নি;

কবি বুদ্ধদেব বসু'র কবিতা
'শেষের রাত্রি'
**********
পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।

(তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)

বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।

(আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)

নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা

(তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা

(এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন
হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন, কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)

অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।

(ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সওয়ার-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।

(কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তবু চলে এসো;মোর হাতে হাত দাও তোমার-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)

তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণীতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।

(এসো চলে এসো যেখানে সময় সীমানাহীন,
সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন-কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
                                           (চলবে)