***************
         প্রবল রবীন্দ্র ছায়ার বেষ্টনীতে থেকেও এক পরাক্রমী চেতনার শক্তিতে কবি বিষ্ণু দে আপন কাব্য জগত সৃষ্টির তাড়নায় শ্রেণী সমাজ চেতনা,  এলিয়ট ভিত্তিক  নান্দনিকতা ইত্যাদি নানান আত্মিক ও ভাববাচিক দ্বন্দে তিনি হয়ে ঊঠেছিলেন সেই পঞ্চপাণ্ডব কবিদের মধ্যে যেনো সবচাইতে দ্বান্দিক চেতনার কবি ।
                                   কাব্য সমালোচক বীরেন মুখার্জী লিখেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রবিযুক্তির প্রত্যয়ে বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে যে ভাবাদর্শে তার কাব্যসৌধ নির্মাণ করেছেন, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য পশ্চিমা জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং পূর্বসূরি জারিত। তার কবিতার বিমুগ্ধ পাঠে ধরা পড়ে মার্কসীয় মতাদর্শ। সমকালীন যুগযন্ত্রণা এবং আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের সমন্বয় এবং স্বদেশ চিন্তাও তার কবিতার একটি বিশেষ লক্ষণ।
                                বেঁচে থাকার তাগিদে এ পর্বের কবিরা মানুষের মৌলকাক্সক্ষার দাবিতে প্রতিবাদী চেতনা তুলে আনতে সচেষ্ট থেকেছিলেন তাদের কবিতায়। যা বিশ্বসাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত। তবে মার্কসীয় দর্শনতাড়িত হলেও বিষ্ণু দে নিজে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেননি। তিনি সচেতনভাবেই কবিতায় দর্শন ও বিজ্ঞানের মিশেল ঘটিয়েছেন। তার কবিতায় যেমন আছে নিসর্গ চেতনা তেমনি আছে ভক্তিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল উপস্থিতি। আছে মিথ-পুরানের সফল প্রয়োগ। তৎকালীন ভারতবর্ষে সমাজবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে সাংস্কৃতিক ধীমানরা বিদেশী সাহিত্যে নিজেদের মুক্তি খুঁজেছিলেন।
                                    এ ধারায় অগ্রবর্তী কবি বিষ্ণু দের অধিকাংশ কবিতায় মার্কসীয় আদর্শের তাত্ত্বিক ঘোষণা স্পষ্ট হয়। তিনি মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক চেতনা ভিন্ন মানবিক চেতনার বিজয় অসম্ভব। সুতরাং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তার কবিতায় মৃত্যুহীন মানুষের জয়গাঁথা রচিত হয় অনায়াসে-
অমর দেশের মাটিতে মানুষ অজেয় প্রাণ,
মুঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।
হে বন্ধু জেনো, আজ যবে খোলে মুক্তিদ্বার,
দেশে আর দশে ভেদাভেদ শুধু ভীরুতা ছার !
                            বিষ্ণু দের স্বদেশপ্রেম একদিকে ঐতিহ্যবাহী অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী। যা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে আদর্শিক ভিত্তিতে জনগণতন্ত্রবাদী। তিনি ইতিহাসচেতনার পথে বিশ্বযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূটকৌশল, ঔপনিবেশিক শাসন ও বৈশ্ব্যতান্ত্রিক দোদুল্যমান ভারতীয় মধ্যবিত্তের ভূমিকাবিষয়ক বোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে স্থিত হয়েছেন। ফলে তিনি কবিতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন ফ্যাসিস্ট শক্তির নিষ্ঠুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী মানুষের প্রবল প্রতিবাদ। শ্রেণীশোষণ ও ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় আশা করেছেন’।  
                          তেমনি একটি কবিতা তাঁর, মনে হয় প্রত্যেকে লেনিন ! এমন সব লেখা কখনো মনে হয়েছে ভারী একপেশে যেনো। তুলে দিলাম আসরের পাঠকদের জন্যেঃ


মনে হয় প্রত্যেকে লেনিন
***************
তোমাদেরও মনে হয়, মনে হয় তোমরাও প্রত্যেকে লেনিন ?
লাজুক সুকান্ত ওই কথাটাই বলেছিল কৈশোর সংরাগে বহুদিন আগে –
সহজ কিশোর বিনম্র কবি বাংলায় তার কথা শতবর্ষে জাগে |
কারণ লেনিন নন দেবতা বা পুরাণ-নায়ক, তিনি একালের বীর,
স্থির ধীর, ভাবুক, আত্মস্থ, নেতা, মানবিক ; নিজেকে জাহির
কখনোই করেননি ; এমনকি কোন্ এক সভাঘরে স্বয়ং লেনিন
লেনিনিস্ট অত্যুক্তিতে শোনা যায় উঠে যান সংকোচে বিরাগে |
তাই আজ মনে হয় যদি সারা দেশ ভাবে, ভাবেপ্রতিদিন
সাধারণ মানুষেরা, সকলেই, নিত্য ভাবে দীন হই নই কভু হীন,
তাহলে হয়তো প্রতি মাস হবে অক্টোবর, প্রতিদিন প্রত্যেকে লেনিন |
শুনেছি যে লেনিনেরও সাধ ছিল একদিন সকলেই হ’য়ে যাবে
শতায়ু লেনিন ।


                                            (চলবে)