***************
                কবি জীবনানন্দ দাশ ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত লাজুক ও মুখচোরা স্বভাবের ছিলেন, পরবর্তীতে ও তিনি খুবই প্রচার বিমুখই ছিলেন ।  তাঁর মা কুসুমকুমারী ছিলেন তখনকার সময়ে পাঠক সমাদৃতা কবি । তাঁর লেখা সুবিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’ এতবছর পরেও শিশুতোষ কবিতা হিসাবে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে । কবিতাটি এখনো অনেকের মনে থাকতে পারে, এ কবিতার দু’লাইন উল্লেখ করলেই অনেকের মনে পড়ে যাবে নিশ্চিত-
                “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
                 কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে” ।
               কবির মাতামহ চন্দ্রনাথ বাবু ও একজন নন্দিত কবি ছিলেন । সুতরাং বলা যায় যে, তিনি কবি হবার সকল গুণাবলী তাঁর মায়ের দিক হতে পেয়েছিলেন । কবি জীবনানন্দ দাশের ছোটবেলার ডাক নাম ছিলো মিলু । ভোরে তিনি তাঁর বাবার কণ্ঠে উপনিষদের শ্লোকের আবৃত্তি ও মায়ের কাছ থেকে ধর্মীয় গান শুনতেন । এই বয়সেই তাঁর ভবিষ্যতে সুবিখ্যাত কবি হবার সকল রকম রসদ তাঁর জীবনের ঘরে জমা হতে থাকে । ছোটবেলাটায় মায়ের কাছে বাল্যশিক্ষা দিয়ে লেখাপড়া শুরু করে তাঁর আটবছর বয়সে বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে ক্লাশ ফাইভে তাঁকে ভর্তি করানো হয় । তিনি অচিরেই স্কুলে কৃতি ছাত্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন , স্কুল ফাইনাল ও কলেজ ফাইনালে ফার্ষ্টক্লাশ পেয়ে পাশ করে তিনি কোলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি এ কলেজ থেকে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে পাশ করেন ।

                     তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় তখন ব্রাহ্মবাদী পত্রিকায় । তখন তিনি নিজের নাম লিখতেন শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে যে অবিতা লিখেছিলেন তা পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন,‘এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা’।

                    তারপর থেকে ধীরে ধীরে কল্লোল পত্রিকা সহ নানা পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রবন্ধ ছাপা হতে থাকে । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন। কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় ‘বনলতা সেন কবিতা প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পান্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মারা যান ১৯৪২ সালে, সেই বছরেই তাঁর তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয়। বইটি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-ভবন হতে 'এক পয়সায় একটি' সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ষোল।

                 বুদ্ধদেব বসু ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় জীবনানন্দের বহু সংখ্যক কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪৪ সালে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবী প্রকাশিত হয়। এর আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হয়েছিল, তবে মহাপৃথিবীর জন্যে প্রকাশক পান। ক্ষমতার নগ্ন রাজনীতির ফলশ্রুতিতে দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে দু’বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। কবি জীবনানন্দ সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কলকাতায় যখন ১৯৪৬ সালে আবার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে কবি তখন লেখেন হিন্দু- মুসলমান’ কবিতাটি। সেই কবিতাটি আসরের পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম । এই অনন্য কবিতার আবেদন আজো দুই বাংলার জনগোষ্টির জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য বলেই মনে হয়;

কবি জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা


হিন্দু- মুসলমান


_____________


মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে-সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনদের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,
জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা-মিশে গেছে হেথা মসজিদ ,মন্দির!


কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
-মুসলমানের হস্তে - হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী;
আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেম দল,তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্র প্রস্থ ভেঙেছি আমরা, আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
নবীন প্রাণের সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!


রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন, তোমার প্রাণ!
হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ, হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আশান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে-কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো-ভারতের রবি, শশী,
হে ভাই মুসলমান
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!


এ ভারতভূমি নহে কো তোমার, নহে কো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ- মুসলমানের রেখা,
হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।
অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!


এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণিপ্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি
পরশে তাদের জেগেছে আরব উপন্যাসের রাতি!
জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি-লাহোর-ফতেহপুর
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজও উষার আরুণে ‌জাগে!


জেগেছে হেথায় আকবরী আইন-কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে।
সেলিম, সাজাহাঁ- চোখের জলেতে এক্‌শা করিয়া তারা
গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা!
ছড়ায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন-অপলক, অপরূপ!
যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!


মোতিমহলের অযুত রাত্রি, লক্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি-
আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজও বেজে ওঠে কোন্‌ গজল-ইলাহী গান!
পথহারা কোন্‌ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
-নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!
এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের, মোদের বহিন-ভাই;
আমাদের বুকে বক্ষে তাদের ,আমাদের কোলে ঠাঁই
কাফের যবন টুটিয়া গিয়াছে ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোস্‌লেম্‌ বিনা ভারত বিকল, বিফল হিন্দু বিনা
মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান !
                                                                          (চলবে)
সূত্রঃ মুক্তবিশ্বকোষ, বিবিধ অনলাইন ব্লগস ও কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনী


***************