*************
          কবি জীবনানন্দ দাশ এর প্রায় সব কবিতাতেই যেন একটা রূপচিত্র অনুপম লাবণ্যে ভেসে উঠেছে । সে প্রকৃতি হোক বা নারী, সে সময়ের হোক বা সমাজের – সব কবিতাতেই কবিতার ভাবময় চিত্রকল্প এক অনন্য সৌন্দর্য্যে ও স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়েছে ।

             সাহিত্য সমালোচক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ তাঁর  ‘জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্পঃ সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জীবনানন্দ দাশকে অধ্যয়ন করে দেখি, — তিনি বাংলা কবিতার একেবারে স্বতন্ত্র বিভা। ঔজ্জ্বল্য ও লাবণ্যে অনন্য; শব্দগঠন, প্রয়োগ এবং বাক্যগঠনে স্বতন্ত্র অনন্য কবিতার শরীর তৈরীতে। তার ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ দেখে কবি নিজেও প্রস্তর যুগ থেকে আধুনিক যুগের দিকে যাত্রা করেছিলেন। অথচ এ চিত্রকল্পের ভেতরই শাশ্বত হয়ে উঠেছিল ‘নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোত্স্নাকে ছুঁয়ে’ যাওয়া অশেষ যুগের বাস্তবতা। ‘ঘোড়া’ কবিতার চিত্রকল্পগুলো কালচেতনায় উদ্ভাসিত বলে কবি সমকালের হয়েও মহাকালের বাণীবাহক হয়ে উঠেছিলেন। আর ‘আকাশলীনা’ কবিতায় স্বার্থপর প্রেমিকের আকর্ষণ থেকে কোনো এক ‘সুরঞ্জনা’কে ফেরানোর তাগিদে যে সময়ের ছবি আঁকলেন, তা-ও ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে’র।


       ‘আকাশলীনা’ কবিতায় যে কবিকে পাই, সে কবি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাধীন রুচির প্রতি প্রতিবন্ধক— যা আধুনিকসম্পন্ন মানুষের দীক্ষিত মন গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু ভিন্নার্থে চিন্তা করলে বিষয়টি ভিন্ন রকমের তাৎপর্যও বহন করে। ‘সুরঞ্জনা’ যদি সাধারণ কোনো এক সরলার ভূমিকায় কল্পনা করা যায়— যার সারল্যভরা মনে কোনো প্রবঞ্চনা ধরা পড়ে না, সে সরলার যে-কোনো ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করার ব্রত নিজে গ্রহণ করেছেন। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ আপাতজীবিকাজটিল জীবনের অভিজ্ঞান। এ কবিতারও চতুর্থ পঙিক্ততে ‘হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙ্গা’ হয়ে ওঠার পর পরই একটি স্পেসসহ পঞ্চম পঙিক্ততে ‘চুপ-চুপে ডুবে যায়— জ্যোৎস্নায়’ ভিন্ন রকম স্বাদ এনে দেয়। কল্পনাবিলাসিতার জন্য কল্পনাবিলাসীদের বারণ করতে পারেন না। তবু যারা ‘টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে/বিনষ্ট হতেছে সাংহাই’ তারা নিশ্চয় মেনে নেবেন, জীবনানন্দ দাশকে কোনোভাবেই রাজনীতিবিমুখ কবি বলা যায় না। জীবনানন্দ দাশ নির্জনতাপ্রিয় কবি সত্য; কিন্তু বিশ্বচরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে ভাবিত করেনি— এ কথা সত্য নয়। অন্তর্মুখীন হওয়ার কারণে উচ্চকণ্ঠে চেঁচামেচিতে তার অনীহা ছিল ‘রূপার ডিমের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা’র মতো। দূর থেকে দেখেছেন, যা কিছু পৃথিবীতে অকল্যাণ ডেকে আনে। যুদ্ধের ভয়াবহতা দূর থেকে অনুভব করেছেন, প্রতিকারের কোনো ব্যর্থতম চেষ্টা করেননি; কিন্তু রাজনীতিবিদ, সমাজবিদদের প্রেরণা যুগিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদের।

              সময়ের অগ্রগামী ছিলেন বলে তাৎক্ষণিক তার কাব্যভাষা সমকালের যুগমানস উপলব্ধি করতে পারেনি। এ ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ একটি খণ্ড কবিতা হয়েও হয়ে উঠেছে সমকালের যুগসন্ধিক্ষণের যোগসূত্র।  আবেগের তারল্যে ভেসে গেলে এ কবিতটিও ‘বনলতা সেন’-এর মতো পাঠকপ্রিয় হতে পারত। কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি যে অর্থে ইতিহাস-আশ্রিত ভৌগোলিক সীমা ও অসীমের সঞ্চয়, সে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’কে অভিব্যঞ্জিত করা যায় না। দু’টি কবিতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অনুভব ভিন্ন। ভিন্ন দু’টি কবিতার অবয়ব ও কালচেতনাও। চিত্রকল্প নির্মাণে ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র। উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে এমন চিত্রকল্প ঝলসে উঠতে দেখা যায় না। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’-এর মতো উপমা-আশ্রিত এমন অমোঘ চিত্রকল্প উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে কোথায়? কোথায় এমন ভারমুক্ত আশ্রয়? ‘পাখির নীড়ের’ সঙ্গে তুলনীয় আশ্রয় কেবল নাতিশীতোষ্ণ বাংলায়ই সম্ভব। আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে কল্পনারও অতীত। তাই ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে যতই অ্যাডগার অ্যালান পো’র কিংবা ইয়েটসের কবিতার মিল দেখানো হোক, ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র শিল্পই”।

          অনন্ত জীবন কেউই পায় না এই ধরাতে, কবি জীবনানন্দও পাননি, বরং তিনি পেয়েছেন এক দু;সহ অনাকাঙ্খিত মৃত্যু, তবুও তাঁর মনের কোণে ভাবনা ছিল- কেমন হয় অনন্ত জীবন পেলে ? তাই নিয়ে লিখেছেন কবিতা, ‘অনন্ত জীবন যদি পাই আমি; কবিতাটি পাঠকের মনের ভিতরে এক অন্যরকম চিত্রকল্প সৃজন করে । কবিতাটি তুলে দিলাম যাঁরা কবি জীবনানন্দের যাদুময় চিত্রকল্পের মায়ায় ভাসতে ভালোবাসেন – শুধু তাঁদেরই জন্যে ।


অনন্ত জীবন যদি পাই আমি
*************************
অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অনন্তকাল একা
পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিব সবুজ ঘাস
ফুটে উঠে—দেখিব হলুদ ঘাস ঝরে যায়—দেখিব আকাশ
শাদা হয়ে উঠে ভোরে—ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত রেখা
লেগে থাকে বুকে তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা
পাব আমি; দেখিব অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস
খুলে ফেলে চলে যায়—মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।
অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা
পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো
দেখিব অনেক আমি—দেখিব অনেকগুলো
বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী
মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা
তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।
         যতবারই পড়ি কবিতাটি কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি - অনন্তকাল পেলে একা এ পৃথিবীর পথে দেখা হবে সবুজ ঘাসের ফুটে ওঠা, হলুদ ঘাসের ঝরে যাওয়া, অচেনা নারীর গোধূলির নরম আভাস বিহীন মুখ, ট্রাম বাসের ধূলো, আরো কত কি দেখা হবে, শুধু দেখা হবে না তারই সাথে । – কে সে ? সে কথা থেকে যায় কবিতার গহন গভীরে – পাঠকই বুঝে নিক – কে সে !!
                                                                           --   (চলবে)