*************
              কবি জীবনানন্দ দাশ কে সারাজীবন বললেও বোধ হয় তাঁর সম্পূর্ণ ব্যাখা করা যাবে না – তাঁকে সম্যক উচ্চারণ করা সম্ভব হবে না -তিনি এমনই এক মহাসাগর । তাঁ কবিতার দৃশ্যকল্প আমাদের অন্য এক ভুবনের বাসিন্দা করে দেয় ।সাহিত্য সমালোচক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ তাঁর  ‘জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্পঃ সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ’ প্রবন্ধে  বলেন  “‘আটবছর আগের একদিন’ একটি রহস্যময কবিতা। রহস্যটা—বোধের দিক থেকে, না কি প্রকাশের দিক থেকে? যাপিত জীবনের প্রতি ব্যক্তির বিবমিষা জন্মে, তাই কোনো কার্যকারণ সম্পর্কে পারম্পর্য রক্ষা না করেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে শ্রেয় জ্ঞান করে কবিতার নায়ক। বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈরাশ্যই তাকে জীবনের সমস্ত প্রাচুর্য উপেক্ষা করে আত্মহননের দিকে প্ররোচিত করে— যে রকম ঘুম একজন মানুষের কাম্য হতে পারে না, সে ঘুমই তার জোটে। তার মনে হয়, জেগে থাকাই যেন গাঢ় বেদনা ভরা। সে বেদনার ভার তাকে আর সহ্য করতে হবে না। শেষোক্তি শোনায় ‘চাঁদ ডুবে চলে গেলে-অদ্ভুত আঁধারে/যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।’ শেষ পঙিক্তর উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে ফুটে ওঠে একটি বিশেষ বিষণ্ন সময়ের ভয়াবহ চিত্র। যাপিত জীবনের ক্লেদজ অভিজ্ঞতার ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কাছে লাশ কাটা ঘরের স্পন্দনহীন হিম ঘুমই শ্রেয় মনে হয়। আবার ‘রাত্রি’ কবিতায় ‘হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল’ বলে যে বিশেষ মুহূর্ত ও মানসিক অবস্থার বিবরণ পেশ করা হয়েছে, তার শেষ টেনেছেন ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়/লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।/তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব—অতিবৈতনিক/বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবত’ দিয়ে। নগরের ক্লেদজ ও মমতাহীন যাপিত জীবনের নির্মম বহুরৈখিকতায় ঋদ্ধ এ চিত্র।


জীবনানন্দ দাশে রূপকধর্মী চিত্রকল্প তেমন স্পষ্ট নয়। প্রতীকধর্মীও নয়। সর্বত্রই উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্পের প্রাচুর্য। ‘হায় চিল’ থেকে শুরু করে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুচ্ছ। ‘হায় চিল’ কবিতার ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে’ পঙিক্তও মানবমনের জটিল ঘূর্ণাবর্তের তীরে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত সত্যের নাম। ‘ক্যাম্পে’ নামক সে জটিল চিন্তাশ্রয়ী কবিতা, সেখানেও উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্প। ‘মৃত পশুদের মত আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি’ পঙিক্তও উপমাকে আশ্রয় করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চিত্রকল্প। ‘শ্যামলী’ কবিতায় সমকালের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে চিরকালীন দিগ্বলয় স্পষ্ট। জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্বে উপমা, উৎপ্রেক্ষার প্রাচুর্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চিত্রকল্পের অমোঘ স্বাক্ষরও। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাত’— এ পরিপূর্ণ জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্ব।

ইংরেজ কবি শেলী ছিলেন চিত্রকল্প সৃষ্টিতে অনন্য। জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্প গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির সমন্বয়ে নির্মিত। চিত্রকল্পের সঙ্গে থাকে প্রতীক। জীবনানন্দ প্রাকৃতিক প্রতীক ব্যবহার করে তার কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। আকাশের তারা আর নদীর জলের ওপর ভাসমান ফুল তার কবিতায় অপূর্ব সাদৃশ্য সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার প্রতিবেশে শ্রবণ ইন্দ্রিয়, ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণকারী মন প্রবলভাবে সৌন্দর্যের স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আলোকিত জীবনে আমরা অন্ধকারের, রোমান্সের স্বাদ পাই কি? তাই কবি মৃত্যুকে বেছে নেন জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসার জন্য। তীব্রভাবে উপলব্ধি করার জন্য। এমনকি জীবনকে আবিষ্কার করার জন্য। মৃত্যুর আক্রমণ থেকে জীবন আমাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে থাকে। শিশুকে স্পর্শ করে কবি তার শৈশবে ফিরে যেতে চান। কারণ, সহজবোধ্য, শৈশব থেকে মৃত্যু বেশ দূরে অবস্থান করে।
মানুষ সব সময় বস্তুকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে চায়। ইতিহাসের ঘটনাপরম্পরাকে সে তার স্মরণের মধ্যে চিত্র-রূপে উপস্থিত রাখে, ভালোবাসার অনুভূতিকেও সে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে চায়। তাই কবিতায় প্রধানতঃ আমরা লক্ষ্য করি যে, কবি একটি ছবি এঁকে ঘটনাকে এবং অনুভূতিকে পাঠকের দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করছেন। বাংলা কবিতায় এই দৃষ্টির অনুভূতিটা স্বয়ম্প্রভ এবং কবিতার মধ্যে একটি অনুভূতিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবির সব চেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সমস্ত অবস্থাকে দৃষ্টিপাতের মধ্যে নিয়ে আসা। দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্প সহজেই উপমার সাহায্যে গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যধারায় এই দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্পের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। কিন্তু স্পর্শের অনুভূতি, গন্ধের অনুভূতি, শ্রবণের অনুভূতি এবং স্বাদের অনুভূতি, শব্দে তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন, এবং রবীন্দ্রনাথের সময়ে ব্যাপকভাবে তার পরীক্ষাও হয়নি। জীবনানন্দ দাশের কাব্যে আমরা বাংলা কবিতার সর্ব প্রথম এই অনুভূতিগুলোকে শব্দে তুলে ধরার আকুলতা লক্ষ্য করলাম। প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দ দাশ জীবন-বিমুখ কবি নন, বরঞ্চ জীবনকে জানেন বলেই প্রকৃতির আদিমতা এবং সজলতার মধ্যে তিনি তাঁর অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন।

তাঁর সেই অস্তিত্ব সন্ধানের যাত্রায় তিনি আমাদেরও সামিল করেছেন এক অনন্য যাদু প্রতিভায় । আজ একটি তাঁর একেবারে অন্যরকম কবিতা দিচ্ছি আসরে, যেন এটি কোন কবিতা নয়, একটি ডায়েরীর পাতা, সেই ডায়েরীর মত লিখা কি করে এক মোহন কবিতা হয়ে ওঠে তা’ না পড়লে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় । কবিতাটির নাম ‘লোকেন বোসের জর্নাল” । যাঁরা আগে পড়ার সুযোগ পাননি তাঁরা নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন ।

কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা
________________
লোকেন বোসের জর্নাল
________________
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।
পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
       সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
       ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
              নাড়বো না আমি
              নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
       সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —
       কিন্তু কথাটা থাক;
       কিন্তু তবুও —
       আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
       নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে
       এখন কি করে মন কারভান হবে।
প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৼ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সৼ নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
       অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
       ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
       এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
       ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
       কখন সময় হবে।
হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —
       হৃদয় কেন যে কাঁপে,
‘ভালোবাসতাম’ — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে
       তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
       আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে
এর উত্তর হবে?
সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
       অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
       তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।
     -----------------------
         এই লেখাটির মধ্যে দিয়েই শেষ করছি বাঙলার আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ যাদের হাতে শুরু হয়ে এক গভীর পূর্ণতাও পেয়েছে সেই পঞ্চপাণ্ডবের গল্প । চেষ্টা করেছি আলোচনা তথ্যসমৃদ্ধ করতে । কতটা সফল বা অসফল জানিনে  - তবু কবিতার প্রতি গভীর ভালবাসার দায়ে এই লিখা ।  এতে মুক্ত বিশ্বকোষ সহ বিভিন্ন সাহিত্য সমালোচকদের তথ্যের সহায়তা নিয়েছি, নিয়েছি উদ্ধৃতিও । এই লেখায় এই আসরের যে সকল সম্মানিত পাঠকদের আন্তরিকতা ও প্রেরণা পেয়েছি -তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ।