************
                কবি বিনয় মজুমদারও একজন বিবরবাসী কবি ছিলেন বলা যায়, তিনি প্রচারের আলো পছন্দ করতেন না ।  শব্দনীড়-এ কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কবি রিয়া দাশগুপ্ত লিখছেন যে, ‘আমাদের এই কবিতার রাজ্যে এক আশ্চর্য নক্ষত্র হলেন কবি বিনয় মজুমদার। যদিও আমরা জানি কবিরা কেউ আকাশচারী নন, তারা এই পৃথিবীরই মানুষ, তাই স্বাভাবিক কারণেই তারা সবার সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত। আর দশজন আধুনিকের মতো বিনয় মজুমদারও হেঁটেছেন বোদলেয়ার নির্দেশিত এই স্বপ্ন-সম্ভব পথেই, কিন্তু পৌঁছেছেন এক ভিন্ন গন্তব্যে।তবে বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে ফার্নান্দো পাসোয়ার মতো বিনয় মজুমদারের কবিতাও তাঁর আত্মজীবনীরই অংশ। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে ৭৩ বছরের যে জীবন, তা জীবাশ্ম হয়ে আছে তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে। বিরহের জীবনকে বিনয় মজুমদার গাণিতিক সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছিলেন। এজন্যে বারবারই বাস্তব আর বিরহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্য দর্শন বোঝার চেষ্টা করেছেন, গণিতের সূত্রে জীবনের মর্মার্থ অন্বেষণে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে কবিতায় ব্যক্তিক অভিনবত্ব,প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। প্রেম পর্বে তিনি নির্নিমেষ জ্যোৎস্নার সন্ধানে ব্যাস্ত থেকেছেন, শোকের ছায়াকে দেখেছেন প্রজ্ঞার অভাবিত স্বাতন্ত্র্য মূল্যায়নের সপক্ষে। প্রেম ও অ-প্রেমের মত তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণায় কবিমানস নির্বিবাদে ঘুরপাক খায় কবিতার বেলা ভূমে। আমরা জানি যে কাঙ্ক্ষিত নারী হৃদয়ের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন বিনয় মজুমদার’।


                    ‘সামাজিকতার বন্ধুবৎসল অভিজ্ঞানে বিনয় মজুমদারও ব্যতিক্রমী নন। এরপরও তার নির্জন স্বেচ্ছাবাস, যাপিত অভিজ্ঞতার নানা মাত্রি
কতা উঠে আসে বিরহ-কাতরতার আদলে। সমসাময়িকদের কাছে অপমানিত এবং প্রেমে ব্যর্থতা বিনয়ের মানবীয় উপলব্ধিতে সজোরে আঘাত করে। তার নিজস্ব-দর্শন শ্রেণীসংগ্রামের দ্যোতকতা নিয়ে মানসলোক বিলড়িত করে। যার সুস্পষ্ট শৈলী কবিতায় উপস্থাপিত হতে দেখি বিচ্ছেদের নিরিখে। বস্তুত প্রেম-বিরহ বিষয়ক ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন রাখে। সঙ্গত দৃষ্টিতে কাব্য-সাহিত্যের বিশ্ববীক্ষায় বিনয় প্রেমের মধু-বিস্বাদ প্রতিতুলনার দাবি করে। পস্নাটোনিক প্রেমকে সংজ্ঞায় এনে কবির অভিজ্ঞান বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষিত হতে পারে। কবিতায় অস্তিত্ববাদ, রিয়ালিজম, স্যুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম কিংবা প্রাচ্যবাদের ধারণায় বর্তমান প্রেক্ষিতে বিনয় মজুমদারের কবিতা বিশ্লেষণ বা বিস্তারিত পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে। কিংবা, পাশ্চাত্য সাহিত্যের যে কোন প্রেম বিষয়ক দ্বান্দ্বিকতা ডিসকোর্সের উপজীব্য হতে পারে। কবি বিনয় মজুমদারের কবিতায় প্রেম-বিরহের এ ক্ষুদ্রায়তনের ডিসকোর্সটি তার ব্যক্তির সৃষ্টি কুশলতা থেকে সামষ্টিক গভীরতার দিকে বেগবান কি-না সেটি বিবেচ্য। তার কবিতার তাত্ত্বিক গুরুত্ব বহনের পাশাপাশি দর্শনের গুরুত্বও অর্থবহ’।


               কবি বিনয় মজুমদার এর কবিতায় এক গভীর যন্ত্রণাবোধের ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলে বিস্তার নিচ্ছে এমনটি দেখা যায় খুব । তাঁর একটি কবিতা ‘কবিতা বুঝি নি আমি ’ । – সেই কবিতা না বোঝা কবি ও কবিতা যে কী মাত্রা ছুঁয়েছে তা’ পাঠকই বিচার করেছেন ।


বিনয় মজুমদারের কবিতা
কবিতা বুঝিনি আমি
----------------
কবিতা বুঝিনি আমি ;অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়,নিরুত্তাপ,কোমল আলোক |
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে—
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা,জোনাকি—সব ;লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ;প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ;যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ;তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের,অন্তরের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়,রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো,প্রশান্তির আহ্বানের মতো।


      ----///////----