বুকের ভেতর একটা জমাট বেদনার বাস্প কী জমে ঊঠছে এই সমূদ্রতীরে দাঁড়িয়ে । মনে পড়ে যাচ্ছে কি সেই শৈশবের দিন । এই মহা অতলান্তিকের পাড়ে একী ভাব মনে অকস্মাৎ- এ কার সাথে দেখা । একী সত্যিই সেই । যার জন্যে হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা ।


সে-ই হঠাৎ  কোন অবলীলায় তের হাজার মাইল দূরে এসে চোখের সামনে ! না, এই সেই চোখ - ভোলার তো নয় ।


পৃথিবীটা ঠিকই গোল - কখন কোথায় কার সাথে যে দেখা হয়ে যাবে তা কেউ জানে না - কখন কাকে কোথায় কার সাথে মিলিয়ে দেবে-- আবার ছাড়িয়ে নিয়ে লক্ষ যোজন দূরে ঝড়ের বালুকাবেলার  মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে - কেউ তা জানে না ।।


পার্বতীর মতই সে এসে বলেছিল রুদ্ধ কণ্ঠে বিপুল অভিমানে - 'তুমি তোমার ছবি আঁকা নিয়ে থাকো - আমাকে ওরা যে নিয়েই গেল - তুমি কিছু বলবে না' ?


কিছুই বলার উপায় ছিলো না শঙ্খ ত্রিবেদীর । বাবা নেই, অসুস্থ মা ঘরে, আইবুড়ো বোনের বিয়ে হয় নি তখনো । ছবি এঁকে যা রোজগার -তাই দিয়ে চলে সংসার । সে যে ছবি আঁকা  ছাড়া আর কিছু জানে না - আর কিছুই শিখে নি ।


আজ তার ছবি বিশ্ব বাজারে সুনাম কুড়িয়েছে । একনামে চেনে সবাই আজ শঙ্খ ত্রিবেদী'র নাম । হার্ভাডে - কেমব্রিজে - জুলিয়ার্ডে সে ক্লাশ নেয় ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে । কত তার নাম ডাক । তবু যেন তার কিছুই নেই । বুকের ভেতর একটি দোয়েল যেন সারাক্ষণই ডেকে ডেকে যায় । একটি বাসন্তী রঙ শাড়ী হঠাৎ হঠাৎ চোখের আলোয় ভেসে ওঠে  আর হারিয়ে যায় ।


নীলাঞ্জনা, বনলতা, সুরঞ্জনা,  নীরা সবাই মিলে মিশে এক হয়ে যার মধ্যে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেই সুনন্দিতা আজ শঙ্খ'র কেউ নয় । সুনন্দিতা অবলীলায় কোন এক পর পুরুষের হাত ধরে চোখের সামনে মেমসাহেবের মত চলে যায় চোখে এক বিদ্যুতের ঝলক ছড়িয়ে দিয়ে ।


সেই বিদ্যুতের অনলে শুধু একজন শঙ্খ পুড়ে খাঁক হতে থাকে --পুড়ে পুড়ে খাঁক হতে থাকে । শঙ্খ'রা এভাবেই পোড়ে আজীবন । নিয়তির হাতে অসহায়  চিরকাল শঙ্খ'রা শুধু স্মৃতি নিয়েই বাঁচে ।


সুনন্দিতা চলে যায় --  বিমূঢ় শঙ্খ পায়ে পায়ে ফিরে যায় বুকের ভেতর ধরে রাখা সে এক গোপন স্মৃতির ভুবনে ।


মাথার কোষে কোষে জেগে ওঠে কিছু কবিতার ছেঁড়া খোঁড়া পঙতি - শঙ্খ'র ভাঙাচোরা মনের মতোই --- সে আধপাগলের মতোই কবিতায় সমর্পণ করে নিজেকে -- দূরে অতলান্তিক সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় পড়ন্ত সূর্য্যের বিদায়ী বেদনার লাল আভা ঝিলিক দিয়ে শঙ্খ'র মুখ ছুঁইয়ে যায় -- শব্দের সেই আকুল আকুতি বাতাসের তরঙ্গে ভেসে ভেসে যায়, সেই তরঙ্গের কিছু কি পৌঁছায় সুনন্দিতার কানে --? কে জানে !