-          কবি সমর সেন বাঙ্গলা ভাষার একজন উজ্জ্বল পথিকৃৎ কবি । তাঁর কবিতা নিয়ে খুব একটা আলোচনা বা প্রচারণা হয়নি যদিও -কিন্তু তাঁর কবিতা আজো সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে খুব প্রিয় ।
      
          কবি সমর সেন এক বিখ্যাত পরিবারের সন্তান । তাঁর ঠাকুর দাদা ছিলেন সুবিখ্যাত লোকগীতি সংগ্রাহক ও ময়মনসিংহের গীতিকা'র জন্যে প্রখ্যাত গবেষক শ্রীদীনেশ চন্দ্র সেন ।


           তিনি অনেকদিন কবিতা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। নগর জীবনের ক্লেদ ও ক্লান্তি, মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি অবজ্ঞা এবং সংগ্রামী গণচেতনাকে তিনি তাঁর কাব্যে অনুপুঙ্খ রূপ দিয়েছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি কবিতা, গ্রহণ, নানা কথা, খোলা চিঠি, তিন পুরুষ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।


         কবি সমর সেন সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁর অসংখ্য কবিতায় তাঁর সেই বিশ্বাসের প্রবল প্রকাশ পাওয়া যায় । তিনিও ছন্দের কবিতায় খুউব বিশ্বাসী ছিলেন না ।


        কবিতা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তিনি তাঁর সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় লেখা এক প্রবন্ধে যা উল্লেখ করেছেন তার কিয়দংশ আসরের কবিদের জন্যে তুলে দিলাম -- "কবিতার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কী সেটা স্পষ্টভাবে বলা কঠিন। অনেকে বলেন কবিতা আসে শুধু অন্তঃপ্রেরণার তাগিদে। কথাটি বলা সহজ, কিন্তু সঠিক নয়, কারণ অন্তঃপ্রেরণা অন্তরের জিনিশ নয়, তার মূল উৎস বিশাল ও বিক্ষুদ্ধ বহির্জগত। এ-সূত্রে কবিতার ভাষা ও ভাষার ব্যক্তিগত, স্বতন্ত্র ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে পারি। আমরা কোনো বিশেষ সমাজে, বিশেষ সমাজে জন্মাই, এবং সামাজিক জীব হিসেবে প্রচলিত কোনো ভাষা ব্যবহার করি। কিন্তু কবিতা লেখার সময় সে-ভাষার উপরে যে স্বতন্ত্র ছাপ পড়ে তার নাম ডিকশন, এবং এই স্বতন্ত্র ব্যবহারের শক্তি কবির পুরুষকারের পরিচায়ক। অথচ এই পুরুষকার কাজ করে বহু শতাব্দীর শ্রমলব্ধ জটিল ব্যাকরণের সাহায্যে, এবং একটি বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতির পটভূমিকায়। কবিতা অনেকটা নাটকীয় স্বগতোক্তির মতো, কিন্তু কাব্যবিচারে আমরা নাটকের কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করি কিংবা অস্বীকার করি। পারপার্শ্বিকের উপর নির্ভরতা অস্বীকার করা অসম্ভব। পারিপার্শ্বিকের প্রভাব বিশিষ্টভাবে উপলদ্ধি করা, মেনে নেওয়া স্বাধীনতার সূত্রপাত। --- এখনো অনেকে বিশুদ্ধ কবিতায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখেন; এঁরা হচ্ছেন পূর্বযুগের ক্রিশ্চানদের মতো, যাঁরা কুমারী মেরীর বিশুদ্ধ গর্ভধারণে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করতেন। কবিতার কারণ এঁদের কাছে অনাবিল অন্তঃপ্রেরণা, অন্তঃপ্রেরণা এঁদের কাব্যলোকের নিরাকার ব্রহ্ম- একমেবোদ্বিতীয়ম্। একটি সহজ সত্য এঁরা ভুলে যান যে ,ভিতরের প্রেরণা যদি কবিতার মূল এবং একমাত্র উৎস হতো তাহলে প্রতিবছরে, প্রতিমাসে, প্রতিসপ্তাহে মহৎ কবিতা রচিত হবার পথে কোনো অন্তরায় থাকতো না। কাব্যের ইতিহাসে অন্তরায় আসে, তার কারণ কবিতা বিশুদ্ধ কল্পনা নয়, পরিবর্তনশীল সমাজগতির, স্থানকালপাত্রের মুখাপেক্ষী, এবং মুখাপেক্ষী হলেও মাঝে-মাঝে সমাজের মুখ-বদলানোর কাজে সাহায্য করতে পারে। সামাজিক পরিস্থিতি এবং অন্তঃপ্রেরণার মধ্যকার আত্মীয়তার জটিল কিন্তু অনস্বীকার্য"।


      উপরের লেখা থেকেই কবিতা সম্পর্কে তাঁর গভীর ভাবনার যে চিত্র পাওয়া যায় তার সাথে সাযুজ্য রেখেই তাঁর একটি সুবিখ্যাত কবিতা -'কয়েকটি মৃত্যু' আসরের সাহিত্যানুরাগী কবিদের জন্যে উপস্থাপন করলামঃ


কবি সমর সেন'র একটি সুবিখ্যাত কবিতা
----------------------------------
কয়েকটি মৃত্যু
-------------

তার মুখে সূর্যের কাঁচা সোনা,
মনে তার নতুন অরণ্যের স্বাদ
তাই সবি ভালো লাগে।
প্রেমের ব্যাপারে দিব্যি বেপরোয়া
সরম নেই।
আর একটি গুণ –
ছেলেপিলে চায় না মোটেই।
পুন্নামের মুখে মস্ত তুড়ি মেরে
স্বচ্ছন্দে চলে যায় দাম্পত্য জীবন।


অবশেষে ঠকঠকে বুড়ি হয়ে মারা গেল,
সংসার খালি;
দূর ছাই, কিছু ভালো লাগে না,
সঙ্গীহীণ বুড়ো ভাবে সন্ধ্যায়:
সমাজ বদলেছে অনেক, নিরুপায়,
নইলে হে হরি,
এ বয়সে মন্দ লাগত না আর একটি কিশোরী।



চলেছি সমুদ্রে পথে;
বিস্তীর্ণ বালি, হলুদ বালি,
হাতে কাজ নেই, মন খালি,
শূন্য মেঘের ফালি।
চায়ের দোকানে কতদিন পয়সা খসিয়েছ,
কত ধার নিয়েছ, শোধ দিতে গিয়েছ ভুলে,
কত বই চুপি চুপি অক্লান্ত মেরেছ,
প্রায় শূন্য আলমারি।


আজ মৃত্যু সে সব কথা মনে আনে
হলুদ বালির পথে।



বৃষ্টিতে মাজা নীল শূন্য;
জানি, করাল অভিশাপে
এ বস্তের বাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে;
আমাদের এ টুকরো প্রেম, কৃষ্ণচূড়া দিন,
এ বাসরঘর,
শ্মশান কুরুক্ষেত্রে শকুনের কোলাহলে
মোলায়েম বাঁশির মতো।


এ কথা একদিন তুমি বলেছিলে।
তারপর তুমি চলে গেলে যমলোকে;
মড়াপোড়া ধোঁয়ায় সারাদিন জ্বলেছে চোখ,
ফিরেছি শ্মশান ছেড়ে স্নান সেরে; দেখেছি,
পথেঘাটে স্বচ্ছন্দে চলে বর্বর জীবন,
অশোক, নির্লজ্জ;
বৃষ্টির পরে নীল শূন্য; রক্তঝরা কৃষ্ণচূড়া।


তারপর চায়ের দোকানে ব’সে সহসা ভেবেছি;
আজকাল ঘরে ঘরে সমাজধার্মিক অনেক,
মুখে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বুলি,
মনে রোমান্টিক বুলবুলের অবিরত গান,
তুমি ছিলে তারি একজন।
এ অধমও তারি একজন।
সুতরাং শোক বৃথা; মরে তুমি হয়তো বেঁচেছ,
আমরা বাঁচিনি,
আমাদের বসন্তবাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে,
আরো কত বল হরি হরি বোলে, দারুণ জোয়ারে।


         -----------০-----------