# কবিতায় বহুমাত্রিকতা


কবিতা কি,তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।কোন মতই কবিতা সম্পর্কে পূর্ণ ধারনা দিতে পারে নি।যা অরূপ,তাকে রূপময় সংজ্ঞায় ধরবেনই বা কি ভাবে ?
আমি আলোচনা করব,কবিতার একটি বিশেষ গুণ নিয়ে,যা কবিতার অপরূপ সৌন্দর্যকে মেলে ধরতে সাহায্য করবে;আর তা হোল,কবিতার বহুমাত্রিকতা।


আমরা অন্ত্যমিলকে যেমন ভুলে ছন্দ ভেবেছি, তেমনি অন্ত্যমিলযুক্ত পদ্যকে কবিতা বলে মেনে এসেছি বহুকাল।তার একটা বড় কারণ হল,চর্যাপদ এবং আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে শুরু করে পরবর্তী অনেকটা সময় অন্ত্যমিলযুক্ত সহজ সুখপাঠ্য বা সুখশ্রাব্য পদ্যের উত্তরাধিকার আমরা বহন করে আসছি।
উদাহরণস্বরূপ, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিখ্যাত চারটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করি:


'পাখীসব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুমকলি ফুটিয়া উঠিল
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে'


এটিতে একটি নীতির কথা,একটি আদর্শ পরিবেশের কথা বলা হয়েছে।ভাবের সহজ,সরল প্রকাশ এখানে লক্ষ্য করি।তাই এটি একটি আদর্শ পদ্যের উদাহরণ ।এর থেকে পাঠক মানসে কোন অবস্থাতেই  আক্ষরিক ব্যাখ্যা ভিন্ন অন্য অর্থদ্যোতনা তৈরী করেনা।অর্থাৎ পদ্য হল একটি সামান্য জ্ঞাপন।যার অর্থ, পদ্য হল একমাত্রিক।


কিন্তু কবিতা, বহুমাত্রিক।আর এখানেই পদ্যের সাথে কবিতার দূরত্ব।কবিতায় প্রতিটি শব্দ ব্যাপক এবং গভীর অর্থে ব্যবহৃত হয়।অনেক সময়েই শব্দ সেখানে বিমূর্ত ও রূপকাশ্রয়ী,শব্দের আক্ষরিক অর্থকে কবিতায় অতিক্রম করে যেতে হয়।
উদাহরণ দিই, কবি জীবনানন্দ দাশের 'আকাশলীনা' কবিতাটি,যেখানে কবি বলছেন:


'সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,
বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে,
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুনভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে,ঢেউয়ে,
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার'


একটা পর্যায়ে বলছেন,
'কি কথা তাহার সাথে?তার সাথে !'


তারপরে বলেছেন,
'সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস;
বাতাসের ওপারে বাতাস---
আকাশের ওপারে আকাশ'


তোমার হৃদয় আজ ঘাস ,এর যদি বাচ্যার্থের অতিরিক্ত অর্থ ভেদ করতে না পারি, পদ্যপ্রিয় পাঠকটির মতো আমরাও উৎসাহ হারাবো।
ঘাস অমরত্বের প্রতীক।ঘাস মরে না।উপর থেকে শুষ্ক মনে হলেও কিঞ্চিৎ বারিধারায় তা আবার সজীব হয়ে ওঠে।বলা হচ্ছে,
প্রেমিকার হৃদয় যেন তেমনি সজীব,ঘাসের মতো পেলব।আবার যখন কবি বলেন,
'বাতাসের ওপারে বাতাস,আকাশের ওপারে আকাশ' তখন আমরা বুঝি,এই প্রেম এই জগত থেকে অসীম,অনন্তকে ছুঁয়েছে।এই প্রেম যেন আর আমার একার রইল না তা যেন শাশ্বত: বিশ্বের হয়ে দাঁড়ালো।
কবি এক জায়গায় বলেছেন,' কি কথা তাহার সাথে?তার সাথে!'
এখানে 'তার' শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় ।ওই একটি মাত্র শব্দে প্রেমিকের ব্যাকুলতা যেভাবে ফুটে উঠেছে,পদ্যে তা কোনদিন পাওয়া যাবে না।


উদাহরণ নিই,সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেজাজ' নামের দীর্ঘ কবিতাটি,যার একেবারে শেষ কয়েকটি লাইন:


'বউমার গলা;মা কান খাড়া করলেন।
বলছে: 'দেখো,ঠিক আমার মতো কালো হবে'।
এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত।
ওমা,বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছে:
'কী নাম দেব ,জানো?
আফ্রিকা।
কালো মানুষেরা কী কান্ডই না করছে সেখানে'।


এখানে এই যে 'আফ্রিকা 'শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে,তার আগে পর্যন্ত এটি আমাদের অতি পরিচিত শাশুড়ি- বধূর আখ্যান পদ্য।কিন্তু শেষ দুই লাইনে এসে এটি একটি আন্তর্জাতিক উচ্চতায় পোঁছেছে এবং পৃথিবীর সংগ্রামী কালো মানুষদের কবিতা হয়ে উঠেছে ;আর তা, একটিমাত্র শব্দ 'আফ্রিকা'র সফল প্রয়োগের ফলে।


কবিতায় যখন কেউ লেখেন,'ক্লান্ত চিলের মতো শীত নামছে' তখন এই দৃশ্যকল্পটি আমাদের সহজেই ঘরের বাইরে বিস্তীর্ণ কোন মাঠে বা বিলে এনে ফেলে।


কবিতার এই যে ভাবের বিশালতা,এটিকে অনুভব করতে না পারলে কখনই আমরা কোন সংজ্ঞায় কবিতা কি, বুঝতে পারব না।


ঋণ: ড.সৌমিত্র শেখর