হাজার বছরের বাঙালীর শ্রেষ্ট দুই অর্জন রাষ্ট্র ভাষার অধিকার প্রতিষ্টা এবং বাঙালীর স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রুপিত হয় ভাষা আন্দোলনে ,এই আন্দোলনে যে কয়জন অকুতোভয় ব্যক্তি নেতৃত্বদানে সম্মুখ সারিতে ছিলেন তাদের একজন হচ্ছেন আব্দুল মতিন যিনি আমাদের নিকট ভাষা মতিন নামে পরিচিত।
৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন , জেল জুলুম অনেকেই খেটেছেন , আত্মহুতি দিয়েছেন কিন্তু ভাষা শব্দটি কারো নামের সাথে নয় -মিশে গেল একটি নামে ,আর সেটি হচ্ছে ভাষা মতিন।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারত বিভক্তি পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্টা হওয়ার পর যে বিষয়টি পাকিস্তান নামক ভূখন্ডকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে সেটি হচ্ছে সদ্য প্রতিষ্টিত এই রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে ,উর্দূ না সংখ্যা গরিষ্টের বাংলা।
পাকিস্তান প্রতিষ্টার পূর্বকাল থেকে এই বিতর্ক থাকলেও স্বাধীনতার অব্যাহতির পরপরই এটি চরম আকার ধারন করে যখন কায়েদে আজম জিন্নাহ ঢাকায় এসে একতরফা ঘোষনা দেন ,উর্দূই হবে পাকিস্তানের একক ও একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
প্রতিবাদে বাঙালিরা গর্জে উঠে। ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধের প্রতি সহানুভূতিশীল তমুদ্দন মজলিস এবং পাশাপাশি প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবাদী প্রগতিপন্থী দুইটি বিপরীত মেরুর সহবস্থান ঘটে ভাষা আন্দোলনে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্টায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে বাঙালী। এক ইস্পাত কঠিন ঐক্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। সমন্বিত এই আন্দোলনে প্রগতিপন্থী ধারার নেতৃত্বে যে কয়জনের নাম বেশী শুনা যায় তাদের অন্যতম হচ্ছেন - মুহাম্মদ সুলতান ,অলি আহাদ , মুহাম্মদ ইলিয়াস এবং ভাষা মতিন।
পিতা আব্দুল জলিল ও মা আমেনা খাতুনের ছেলে আব্দুল মতিনের জন্ম সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানার দুবলিয়া গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর,মৃত্যু ৮ ই অক্টোবর ২০১৪।৮৮ বছরের বর্ণাঢ্যময় জীবনে সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ।
ব্রিটিশ পুলিশে চাকুরিরত বাবার ছেলে মতিনের লেখাপড়া শুরু ১৯৩২ সালে দার্জিলিং- এ।১৯৩৬ সালে গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি ,৪৩ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে পাবনায় প্রত্যাবর্তন ।চলে আসেন রাজশাহী কলেজে। ১৯৪৩ সালে রাজশাহী থেকে আই এ পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । এই বিশ্ববিদ্যালইয়ে বি এ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এম এ পাশ করেন ।
ছাত্র জীবনে উচ্চভিত্তিয় ঢং এ চলতে অভ্যস্ত আব্দুল মতিনের জীবনের মোড় ঘোরে যায় ১৯৪৮ সালে যখন তিনি উপলব্ধি করেন পাকিস্তান নামক সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে বাঙ্গালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে ।
২৪ শে মার্চ ১৯৪৮ কার্জন হলে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে যে ক'জন ছাত্র না না বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন আব্দুল মতিন ছিলেন তাদের একজন ।
১৯৪৯ সালে ভাষার দাবিতে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারনে গ্রেফতার হন ।১৯৫০ সালে তারই প্রস্তাবানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ।এই পরিষদের তিনিই আহবায়ক মনোনীত হন ।
২০ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১১জন ১৪৪ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ৩ জন ভঙ্গ করার পক্ষে এবং একজন ভোটদানে বিরত থাকেন ।
১৪৪ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে গুটি ক'জনের একজন আব্দুল মতিনের সাথে সাধারন ছাত্ররা একাত্মতা ঘোষণা করে । ২১ হয়ে উঠে একুশে ।৫২ হয়ে উঠে বাঙ্গালী ইতিহাসের এক অনবদ্য ইতিহাস ।
মতিন আবারও কারারুদ্ধ হন ।সংস্পর্শে আসেন বাম নেতাদের । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন ।১৯৫৬ সালে উত্তরবঙ্গে কৃষক সম্মেলন করে পূর্বপাকিস্তান কৃষক সমিতির গোড়া পত্তন করেন ।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাপে যোগ দেন ।
পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান । মস্কো ও পিকিং পন্থীদের দ্বিধা বিভক্তি , নকশাল পন্থীর আবির্ভাব,বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও বৈশ্বয়িক চিন্তাধারা এই মানুষটিকে বিতর্কিত করে।
একসময় চরমপন্থী হিসাবেও পরিচিত হয়ে উঠেন।১৯৭২ সালে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গ্রেফতার হন ।দীর্ঘ ছয় বছর জেল জীবনের পর জিয়ার শাসন আমলে মুক্তি পান ।
এরশাদ পরবর্তী সময়ে ওয়ার্কাস পার্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন ।
২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার এই ভাষা সংগ্রামী কে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরুস্কার একুশে পদকে ভূষিত করে ।
নিন্দিত ও নন্দিত এই মানুষটির সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন ভাষা সংগ্রামী ।বাঙালী যখন তাঁর আত্ম পরিচয় ৫২ তে খুঁজবে সেখানে দেখবে ধ্রুবতারার মত একটি নাম ভাষা মতিন ।মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, বাংলা ও বাঙ্গালীদের সর্বস্ব দিয়ে যাওয়া এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম ।