বাংলা সাহিত্যাকাশের ধ্রুবতারা কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক, সঙ্গীতজ্ঞ, সুরস্রষ্টা, চিত্র পরিচালক, চিত্র-নির্মাতা, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, সৈনিক, দার্শনিক ইত্যাদি বহুধা গুণের অধিকারী হওয়া সত্বেও পাঠকহৃদয়ে যে স্থান তাঁর অবধারিত তা হচ্ছে ‘কবি’। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, ভারতবর্ষের বিদ্রোহী কবি।  


নজরুল সাহিত্যসমুদ্রে সন্তরণ করে মুক্তা খুঁজে বের করার মতো দুঃসাহস আমার না থাকলেও তিনি কী-করে বৈচিত্রময় ভাষা, রূপক ও উপমা প্রয়োগে ভাষা ও সাহিত্যের নূতন নির্মাণ করেছেন এর অনুসন্ধানের অদম্য বাসনা থেকেই প্রবৃত্ত হয়েছি কিঞ্চিৎ আলোকপাতের। নজরুলের প্রতিটি লেখায়ই মনে হয় তিনি শব্দ ও ভাষার  খেলায় মত্ত। আরবী, ফার্সি, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু সব ভাষার সম্মীলন ঘটিয়ে জন্ম দিয়েছেন এক নূতন ভাষার। তাঁর এই অনন্য সৃজনশৈলী বাংলা ভাষায় সৃষ্টি করেছে নূতন মাত্রিকতা। বহু ভাষার একত্র সম্মীলন, অসাধারণ সব রূপক ও উপমার কল্পনা ও উপস্থাপনে তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রমিক স্বাতন্ত্র্যে মূর্ত।


অতুলনীয় কল্পনা বিলাসে কবি তাঁর প্রিয়তমাকে সাজাতে কি করে আকাশের চাঁদ, তারা, রংধনু ইত্যাদিকে জেওর বা গহনার উপমা ও রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তা দিয়েই শুরু করা যাক্‌। যেমনঃ



মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল।।
বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব মেঘ রঙ এলো চুল।।
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে মাখাব তোমার গায়
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি’ আলতা পরাবো পায়।'


প্রিয়াকে সাজাতে খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয়া, কানে দুল পরানো, ফিতায় এলোচুল বাধা, গায়ে হলুদ মাখানো কিংবা পায়ে আলতা পরানো অতি স্বাভাবিক। অথচ নজরুল চান তাঁর প্রিয়তমাকে পরাতে ‘তারার ফুল, চৈতী চাঁদের দুল, বিজলী জরীন ফিতা, জোছনার সাথে চন্দন মেশানো প্রলেপ, রংধনু থেকে লাল রঙ নিংড়ে তৈরি আলতা’। কি অপূর্ব তাঁর রূপক ও উপমার কল্পনা ও উপস্থাপন!


আবার প্রিয়তমার বিরহে নজরুল যখন গেয়ে উঠেনঃ



বুল্‌বুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শোনে।
শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধির পাশে
তরুণ ইরাণ-কবি কাঁদে নিরজনে।


উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জল-ভরা মেঘ লয়ে বুকের কাছে
সাকীর শরাবের পেয়ালার পরে
সকরুণ অশ্রুর বেল ফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙা চাঁদ মলিন-আননে।।

বন্য গোলাপ ঝরে পড়েছে বলে বিচ্ছেদের কান্নায় ব্যথিত; আর তা দেখে নার্গিস ফুলের বাগানে বসেও বুলবুলি পাখি আজ বাক্যহীন। এমন করুণ পরিস্থিতিতে মুক্ত আকাশও উদাস মনে দুঃখের জল বুকে ধারণ করে স্থির হয়ে রয়েছে, কিংবা ভাঙা চাঁদ ব্যথিত চোখে চেয়ে আছে। ‘বন গোলাপের বিলাপ, উদাসীন আকাশ, জল ভরা মেঘ, ভাঙা চাঁদ, মলিন-আনন’ ইত্যকার উপমা, রূপক, প্রতীক ও বস্তুর ব্যক্তিরূপ প্রকাশ সবগুলো একাকার হয়ে আছে যার রচনায়, তিনি কেবল নজরুল।


অসাধারণ ভাববিলাসী মানস প্রবণতার অধিকারী, স্বপ্নচারী নজরুল- প্রেমিকার প্রতি তাঁর প্রেম প্রকাশে বৈচিত্রময় ভাষা ব্যবহার করেছেন এক অনন্য অস্ত্র হিসেবে। যেমনঃ  



আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফাস গ্যেয়ি।।
বিনোদ বেণীর জরীণ ফিতায়


আন্ধা ইশক মেরা কাস গ্যেয়ি।।
তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিলো লোভী আমার মন।



এখানে তিনি কী সুন্দর করে বিবৃত করেছেন- তাঁর হৃদয় কী-করে বাঁধা পড়েছে প্রেমিকার চুলের খোঁপায়, তাঁর অন্ধ প্রেম কেমন করে জরীর কাজ করা চুলের ফিতায় আটকে আছে, কী-করে প্রেমিকার চুলের ঘ্রাণে তাঁর লোভী প্রেমিক মন আত্মগোপন করে আছে ইত্যাদি। এমন উপমা ও রূপকের জন্ম দিতে পারেন একজন, তিনি নজরুল।  


তাঁর অপর গানে তিনি যখন বলেন-



'পরো-পরো চৈতালি সাঁঝে কুসুমি শাড়ি
আজি তোমার রূপের সাথে চাঁদেরও আড়ি
আ..আ..আ পরো ললাটে কাঁচ ফোকার টিপ
আলতা পরো পায়ে হৃদি মিনারী
তুমি-আলতা পরো পায়ে হৃদি মিনারী
পরো-পরো চৈতালি .........
প্রজাপতির ডানা ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুরু জোড়া দিও রাতুল শোভাতে-
বেজটিকার গড়ে মালা পরো খোঁপাতে
দিও উত্তরীয় শিউলি বোটার রঙের ছোপাতে
রাঙা সাধের সতীন তুমি রূপকুমারীই
পরো পরো চৈতালি সাঁঝে....................'


এই গানটিতে তিনি চৈতালি সাঁঝ, কুসুমী শাড়ি, রূপের সাথে চাঁদের আড়ি, কাঁচ ফোঁকার টিপ- ইত্যাদি উপমা ও রূপকের ব্যবহার করে, অনুপম শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস ও ছন্দের সৃষ্টি করে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশীলতাকেই প্রকাশ করেছেন। এককথায় বললে, তা পারেন কেবল উপমা ও রূপকের যাদুকর নজরুল।


নজরুল তাঁর জৈবিক ভাবাবেগপ্রসূত পার্থিব ভালবাসার গানেও রূপক-উপমা এমনভাবে গ্রহণ করেছেন যা শ্রোতাকে মুহূর্তে স্বর্গে মর্তে বিচরণ করিয়ে আনে। যেমনঃ



‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এই নয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকী সই ও-আঁখি কী যাদু জানে।
একে ঐ চাউনি বাঁকা সুর্মা আঁকা তায় ডাগর আঁখি,
বাঁধতে তায় কেন সাধ, যে মেরেছে ঐ আঁখি বাণে?
কাননে হরিণ কাঁদে সলিল ফাঁদে ঝুরছে শফরি,
বাঁকায়ে ভূরুর ধনু ফুল অতনু-কুসুম শর হানে।’


এ গানটিতে এক প্রেমিকের প্রেমতপ্ত হৃদয়ের হতাশামথিত কাতরোক্তি রূপক ও উপমার যাদুতে অনবদ্য ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। এভাবে নজরুলের হাজার হাজার গানে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য অনুপম উপমা ও রূপক।  আমার মনে হয় উপমা ও রূপক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নজরুল সব কবিকে ছাপিয়ে গিয়েছেন।


তাঁর গল্প ‘ব্যথার দান’এর উৎসর্গে তিনি প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
“মানসী আমার! মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম”।
চুলের কাঁটা বা ক্লিপ এর সাথে তুলনা করেছেন বুকের কাঁটা বা কষ্টের; অথচ এ এক মর্মঘাতী ইঙ্গিত।।  তাছাড়া, এর ‘রাজবন্দীর চিঠি’ অধ্যায়টি উপমা প্রয়োগের পাশাপাশি ভাষার অপরূপ কারুকাজের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


‘বিদ্রোহী’ কবিতা- যেটি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নজরুল জীবনের জন্য; সে কবিতার প্রতিটি লাইন উপমা, রূপক, প্রতীক ও বহু ভাষা ব্যবহারে সমৃদ্ধ সাহিত্যের অনন্য উদাহরণ।


তাছাড়া, বিরহ অন্তে প্রেমিকা মিলনের প্রত্যাশায় তাঁর দ্বারে উপস্থিত হলে তিনি বন্দনা গান এভাবেঃ  



দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিনী।
গাহিয়া সজল চোখে বেলা-শেষের রাগিণী।।
মিনতি-ভরা আঁখি কে তুমি ঝড়ের পাখি
কি দিয়ে জুড়াই ব্যথা কেমনে কোথায় রাখি
কোন্‌ প্রিয় নামে ডাকি’ মান ভাঙাব মানিনী।।
বুকে তোমায় রাখতে প্রিয় চোখে আমার বারি ঝরে,
চোখে যদি রাখিতে চাই বুকে ওঠে ব্যথা ভ’রে।
যত দেখি তত হায়, পিপাসা বাড়িয়া যায়
কে তুমি যাদুকরী স্বপন-মরু-চারিণী।।


ঝড়ের পাখির সাথে প্রিয়ার তুলনা করে তিনি তাঁর দৃষ্টিকে মিনতি ভরা আঁখির উপমায়.....................।,  


নজরুলের একটি বিখ্যাত গান হচ্ছেঃ



খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে।।
প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল-খেলা,
নিরজনে প্রভু, নিরজনে। খেলিছো .........
শুন্যে মহা-আকাশে, তুমি মগ্ন লীলা-বিলাসে।।
ভাঙ্গিছো গড়িছো নিতি, ক্ষণে ক্ষণে।
নিরজনে প্রভু, নিরজনে। খেলিছো.........
তারকা, রবি, শশী, খেল্‌না তব, হে উদাসী।
পড়িয়া আছে রাঙ্গা পায়ের কাছে, রাশি রাশি।।
নিত্য তুমি হে উদার, সুখে দুঃখে অবিকার।
হাসিছো খেলিছো তুমি আপন সনে।
নিরজনে প্রভু, নিরজনে। খেলিছো.........


বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ বা স্রষ্টাকে তিনি উপস্থাপন করেন বিরাট শিশু ও উদাস’এর রূপকে। ব্যক্ত করেন তাঁর সৃষ্টি ও ভাঙা-গড়ার স্বেচ্ছাকর্মকে পুতুল খেলার উপমায়। আবার সৃষ্টি কী-করে লুটিয়ে পড়ে স্রষ্টার পায়ে, তার চমৎকার বর্ণনা দেন বস্তুর ব্যক্তিরূপের প্রকাশে।


নবীপ্রেম তাঁর অন্তরাত্মাকে কতোটা প্রভাবিত করেছিলো এর প্রকাশ ঘটে, তিনি যখন তাঁর ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দাহাম কবিতার আবির্ভাব ও তিরোভাব দুই পর্বকেই উপমা, রূপক ও বস্তুর ব্যক্তিরূপ প্রয়োগে হৃদয়ঘনিষ্ট আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে এক রূপকল্প রচনা করেন।


আবির্ভাব প্ররবে বলেনঃ



চলে আনজাম
দোলে তানজাম
খোলে হুরপরি মরি ফিরদৌসের হাম্মাম
টলে কাঁখের কলসে কওসর–ভর হাতে আব-যমযম জাম।
শোন দামাম কামান তামাম সামান নির্ঘোষি কার নাম
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্‌লাম।


মুহাম্মদ (সাঃ) কে স্বাগত জানানোর জন্য চলছে ব্যাপক আয়োজন, বাজছে আনন্দ বাদ্য, স্বর্গের আয়তলোচনা নারীরা খোলে দিচ্ছে শৌচাগার, স্বর্গীয় পানীয়ের কলস তাদের কাঁখে করছে টলমল, হাতে যমযমের পানির পানপাত্র। রণবাদ্যসহ যাবতীয় বস্তু যে নাম ঘোষণা করে চলছে তা মুহাম্মদ (সাঃ)। কি চমৎকার তাঁর ভাষার কারুকাজ আর উপমা আর রূপকের বাহার!    


আবার তিরোভাব পর্বে যখন বলেনঃ



এ কি বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ!
বে-দরদ দিল কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর-শোক।
জান্ মারা তার পাষাণ-পাঞ্জাহ বিলকুল ঢিলা আজ,
কব্জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ, খাক চুমে নীলা তাজ।


মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রাণবায়ু কেড়ে নিতে নিষ্ঠুর আযরাইলেরও চোখভর্তি জল, সে কাঁপছে জ্বরে অসুস্থ মানুষের মতো, প্রাণ সংহারে যে হাত নিষ্ঠুর আজ সে হাত শিথিল, তাঁর হাতের মুঠি অবশ, হৃদয় ঝাঁঝরা, মাটি চুম্বন করে তাঁর নীল মুকুট- এমন বর্ণনা নজরুল দিয়েছেন বহু ভাষার সংমিশ্রণ, উপমা ও রূপকের যাদু তথা মানবীয় গুণ বহির্ভূত বস্তু ও প্রাণিতে মানবীয় গুণারোপ করে। ফলে কবিতাটি পড়ে প্রতিটি লাইনে পাঠককে কাঁদতে হয়। নিত্যদিনে ব্যবহৃত বহুভাষিক শব্দসম্ভার এখানে গুরুত্বের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আজকাল আর তেমনটি ব্যবহৃত হয় না।


‘উমর ফারুক’ কবিতায় তিনি যখন বলেনঃ


শুধু অঙ্গুলি হেলনে শাসন করতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!


কী মধুর, ভক্তের প্রাণের হৃদয় উজাড় করা সংগ্রামী সে আহ্বান!


তেমনি আবার ইসলামী সংগীতেও তাঁর এমনি প্রকাশ ঘটেঃ


আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ।
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।
পয়জার তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে
আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে
সেই চিহ্ন বুকে পুরে পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে
দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত।।


এখানে ব্যক্তিকে বস্তুরূপে প্রকাশ করে আত্মকথায় বিবৃত করেছেন। উপমা ও ভিন্ন ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে এই উভয় কবিতা ও গানে- ভাব আর আধ্যাত্মপ্রেমের পরাকাষ্ঠা রচিত হয়েছে।


মানুষের বাহ্যিক প্রাপ্তির চেয়ে আধ্যাত্ম সুখই যে বড়ো, তা তিনি প্রকাশ করেন তাঁর আলঙ্কারিক উপমায় নিজেকে সাজিয়ে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির দূরত্বের ব্যবধান কমিয়ে, ধর্মের অনুষঙ্গগুলোকে আপন অঙ্গে পোষাক ও অলঙ্কার হিসেবে জড়িয়ে এভাবেঃ



নাই হলো মা বসনভূষণ এই ঈদে আমার
আল্লাহ্ আমার মাথার মুকুট রসুল গলার হার
নামাজ রোজা ওড়না শাড়ি ওতেই আমায় মানায় ভারী
কলমা আমার কপালে টিপ নাই তুলনা যার
হেরা গুহার হিরার তাবিজ ক্বোরআন বুকে দোলে
হাদিস ফেকাহ্‌য় বাজুবন্দ দেখে পরাণ ভুলে।


তাঁর এবারকার গযলে তিনি আরবি, ফার্সি, বাংলা, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষার অপূর্ব সংযোজনে একদিকে যেমন নির্মাণ করেছেন ভাষার নূতন মাত্রিকতা, অপরদিকে উপমা ও রূপকের ব্যবহারে সৃষ্টি করেছেন প্রেমের অপরূপ ব্যঞ্জনা।


কি এক অপূর্ব ব্যঞ্জনায় প্রেমিক হৃদয়কে ভাবসাগরে নিমজ্জিত করেন তা দেখবো এ গযলটিতেঃ  


বাজলো কিরে ভোরের সানাই ...



আবার খালিদ, তারিক, মুসা
আনলো কি খুন রঙিন ভূষা।।
আসলো ছুটে হাসিন ঊষা
নও-বিলালের শিরিন সুরে।
আঁজলা ভরে আনলো কি প্রাণ
কারবালার ওই বীর শহীদান
আজকে রওশন যমীন আসমান
নও-জোয়ানীর সুরাত নূরে।



খুন, রঙিন, ভূষা, হাসিন, ঊষা, নও-বিলাল, শিরিন, আঁজলা, শহীদান, রওশন, যমীন, আসমান, নও-জোয়ানী, সুরাত, নূর- ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার শব্দাবলী ব্যবহার ও উপমা সহযোগে যে চিত্রকল্প রূপায়ন করেছেন তাহলো ‘নূতন বিলালের সুমিষ্ট সুরের আহ্বানে এসেছে এক সুন্দর সকাল’, ‘কারবালার প্রান্তরে প্রাণদানকারীরা মুঠি ভরে নিয়ে এসেছে নূতন প্রাণ, ফলে আকাশ-মাটি হয়ে উঠেছে নবযৌবনের ঔজ্জ্বল্যময় চেহারায় উদ্ভাসিত। সুর ও ছন্দের বন্ধনে বাদ্যযন্ত্রহীন এই সংগীতও হয়ে উঠে সুরের লহরীতে হৃদয়ের গভীরে সুরময়।


অপরাপর ইসলামী গানেও অনুরূপ শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাসে সুরের মূর্ছনা ভেসে উঠে, যেমনঃ


সাহারাতে ফুটলরে ফুল রঙ্গীন গুলে-লালা
সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা।।


সে ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি চাঁদ-সুরুয, গ্রহ-তারায়
ঝুঁকে পড়ে চুমে সে ফুল নীল গগন নিরালা।।



শুধু ইসলামী সঙ্গীতেই নয়, নজরুল ভজন, কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীতেও অমূল্য অবদান রেখে গিয়েছেন, যার সংখ্যা হাজারেরও উর্ধ্বে। সেখানেও উপমা ও রূপক সহযোগে মধুর শব্দচয়নে রয়েছে আধ্যাত্মপ্রেমের অনন্য সৃজনক্রিয়া।


নজরুলের বৈচিত্রময় ভাষা বাংলা ভাষার সঙ্গে অবিমিশ্র হয়ে কখনো বিদেশী আবহের সৃষ্টি করেনি বরং বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বাভাবিক বাঙালি কাব্যিক আবেগেরই পরিমণ্ডল ঘনীভূত করেছে। ভিন্ন ভাষার শব্দগুলোর মাধ্যমে তাঁর আবেগের যে উত্সারণ, তা চিত্রকল্পের নূতন আয়তন সৃষ্টি করেছে।


অপরদিকে, পুত্রশোকে কাতর নজরুল তাঁর কল্পনার স্বাপ্নিক বিন্যাসে অনুপম উপমা ও রূপকের অনন্য সম্মিলনে প্রকাশ করেন তাঁর অপত্য স্নেহ এভাবেঃ



শূন্য এ–বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়!
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়।
তুই নাই ব’লে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হ’ল আকাশের চাঁদ,
কেঁদে নদী–জল করুণ বিষাদ ডাকে: ‘আয় ফিরে আয়’।
গগনে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু, ওরে সুন্দর!
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড় লুটায় লতা ধূলায়!
তুই ফিরে এলে, ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল–দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল তোর চোখের চাওয়ায়।।


এখানে তিনি বলেন, তাঁর শিশুপুত্রকে না দেখে ‘সকালের ফুল অকালে ঝরে যায়, বনে ঝড় উঠে, লতাপাতা ধূলায় লুটায়, চাঁদ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, নদীর জল কাঁদে’- কি বিচিত্র সব রূপক আর উপমা! ইতোপূর্বে কেউ কি এমন উপমা ও রূপকের কল্পনা ও উপস্থাপন করেছেন?


দারিদ্র-পীড়িত, গৃহহীন, ছন্নছাড়া নজরুলের বিদ্রোহ ছিলো যাবতীয় অন্যায়, অবিচার ও সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়ও সে সুর মূর্ত হয়ে উঠে তাঁর উপমা ও রূপকের খেলায়।



হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা দিয়াছ তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!


ব্যক্তিরূপ আরোপ করে দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতাকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন কন্টকাকীর্ণ, লাজ-লজ্জা বা সংকোচহীন, বেপরোয়া চাহনি, ঝাঁঝালো শব্দাবলী ইত্যাদি রূপক ও উপমার সৌন্দর্যে, ভাষার শৈল্পিক বিন্যাসে।


অন্যদিকে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতায় যখন বলেনঃ



আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর
টগবগিয়ে খুন হাসে
...........................
আজ কপট কোপের তূণ ধরি
ঐ আসল যত সুন্দরী
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে
তাদের ‘প্রাণের বুক ফাটে তাও মুখ ফুটে না’
বাণীর বীণা মোর পাশে


সৃষ্টির আনন্দে চোখ, মুখ, রক্ত হাসতে থাকে কিংবা সুন্দরীরা আনন্দে আত্মহারা, তাদের মনে আজ আগুন, পায়ে পরেছে বুক চিঁড়ে বের করা রক্তের আলতা, বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এই যে উপমা আর রূপকের খেলায় তিন মগ্ন, এ যেন শেষ হবার নয়।


‘অবেলার ডাক’ কবিতায় কবি তাঁর মাতৃপ্রেমের চরিত্র চিত্রণ তাঁর উপমা ও রূপকের তুলিতে এভাবেঃ


আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াতো নয়ন চুমে,
চুমুর পড়ে চুমু দিয়ে ফের হানত আঘাত ভোরের ঘুমে
ভাবতুম তখন এ কোন বালাই
করত এ প্রাণ পালাই পালাই
আজ সে কথা মনে হয়ে ভাসি অঝোর নয়ন ঝারে
অভাগিনীর সে গরজ আজ ধুলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।


মা যেমন করে চোখে-মুখে চুমু খেতে খেতে ঘুম পাড়াতেন, তেমনি আবার ঘুম ভাঙাতেনও। একসময় মনে হতো, এ কঠিন বিপদ থেকে কীভাবে পালিয়ে বাঁচা যায়। অথচ সেই কথা আজ মনে পড়লে মায়ের শূন্যতায় মায়ের গর্বের ধন আজ চোখের জলে বুক ভাসায়, ধুলায় লুটিয়ে কাঁদে।  


অজস্র বাঙালির আত্মদান সত্বেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার যে লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো তা আবার আমাদেরই রক্তে রঞ্জিত হয়ে উদিত হবে- এই প্রত্যাশায় কবি তাঁর ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় রূপক ও উপমার গাঁথুনিতে রচেন প্রাণের আকুতি এভাবেঃ


কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর
বাঙালির খুনে লাল হয় যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার!


এভাবে নজরুল সাহিত্যের প্রতিটি লেখা নিয়ে পর্যালোচনা করলে তাঁর বহুভাষার সংমিশ্রণে, রূপক, উপমা ও বস্তুর ব্যক্তিরূপ প্রকাশের মাধ্যমে যেভাবে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং পাঠক হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন এর পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা এমন প্রবন্ধের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব নয় বরং একটি গ্রন্থ রচনার দাবী রাখে।  


তাঁর কবি-প্রতিভা, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য এবং মৌলিকতার স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে বিচিত্র ভাষার ব্যবহারে, নানা ছন্দে, আঙ্গিক ও রূপরীতিতে, রূপক ও প্রতীকে এবং উপমা ও চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ তাঁর অজস্র কবিতা, গান, গযল, গল্প, উপন্যাস ও অনুবাদের প্রত্যেকটি অধ্যয়ন করা আমাদের প্রয়োজন।


নজরুল নিজেই বলেছেন, কবিতায় থাকি আর না থাকি গানের মধ্যে বেঁচে থাকবো- এ বিশ্বাস আমার আছে। শুধু গান কেনো তাঁর উপন্যাসঃ কুহেলিকা, বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা; কাব্যগ্রন্থঃ অগ্নিবীণা, চক্রবাক, ছায়ানট, ঝিঙেফুল, দোলনচাঁপা, ফণি-মনসা, ভাঙার গান, মরুভাস্কর, সর্বহারা, সাম্যবাদী, সিন্ধু-হিন্দোল; গল্পঃ ব্যথার দান ইত্যাদি প্রতিটি রচনা পাঠকমনকে স্পর্শ করেনি এমন কথা আমরা কি হলফ করে বলতে পারি?


তাছাড়া পবিত্র ক্বুরআনের আমপারা, হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের অনুবাদ নজরুলের সৃজনশীলতার আরেক দৃষ্টান্ত। সৈয়দ মুজতবা আলী কবি নজরুলের ওমর খৈয়ামের অনুবাদ সম্পর্কে বলেছিলেন, “কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী”। আর জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেতেন, “বজ্র, বিদ্যুৎ আর ফুল, এই তিনে কাজী নজরুল”।


এতো উপমা যে নজরুল সৃষ্টি করলেন তাঁর জন্যে যথার্থ কোনো উপমা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; যদিও বহুজন বহু উপামায় তাঁকে উপমিত করেছেন। তাই আমরা বলি, “নজরুলের উপমা নজরুল নিজেই”!


সৈয়দ ইকবালঃ অধ্যাপক, কবি ও লেখক।