ইংরেজী philosophy  শব্দের বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘দর্শন’।  দর্শন শব্দটির উৎপত্তি ‘দৃশ’ ধাতু থেকে।  দৃশ মানে দেখা হলেও দর্শন কথাটি কোনোকিছুকে চাক্ষুষভাবে দেখাকে না বুঝিয়ে, বুঝায় যুক্তির আলোকে দেখাকে।  আবার জগৎ ও জীবনের অন্তরালের কঠিন সত্যকে অনুসন্ধান করার প্রক্রিয়াকেও বলা হয় দর্শন। সমাজের অন্যান্য মানুষের মতো সহজ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, খণ্ডবুদ্ধি কিংবা প্রজ্ঞার সাহায্যে জ্ঞানের সন্ধান না করে যাঁরা মরমী অভিজ্ঞতা বা অতীন্দ্রীয় স্বজ্ঞার সাহায্যে পারমার্থিক জ্ঞানের সন্ধান করেন, যাঁরা অবভাস ও প্রতিভাসের স্তর ভেদ করে বিকারহীন শাশ্বত সত্যের প্রত্যক্ষ প্রতীতি অর্জনে প্রয়াসী, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসে তাঁরাই সুফী বা মরমীবাদী বলে পরিচিত। বাংলায় সুফীবাদের উদ্ভব ঘটে একাদশ শতাব্দিতে।  তবে ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ শতাব্দিতে এর ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশ ঘটে। শেখ জালালউদ্দিন তাবরিযি যিনি হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রাহঃ)  নামে সমধিক পরিচিত, তাঁর আগমনের প্রেক্ষিতে বঙ্গে সুফীবাদের বিকাশ লাভ হয়।  স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক, মানুষের আগমন-নির্গমনের হেতু ও তার করুণ পরিণতি ইত্যাদি আধ্যাত্ম বিষয়াবলী সুফী বা মরমীবাদীদের ভাবিয়ে তোলে, ফলে তারা এর উত্তর খুঁজতে মনোনিবেশ করেন।  তন্ময় হয়ে এসবের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভাবুক মনে এক সময় সূরের অনুরণন অনুভূত হয়, তখন তারা এক ধরণের সঙ্গীতে নিবিষ্ট হয়ে পড়েন।  আর এ সঙ্গীতকে বলা হয় ‘সামা’ অর্থাৎ আল্লাহ-প্রেমমূলক গান।  পরবর্তীতে এই ‘সামা’ই নানাভাবে বিকশিত হয়ে নানারূপ লাভ করে, যেমন: আধ্যাত্মিক, দেহতত্ব, মরমী, মর্সিয়া, জারি-সারি, বাউল সঙ্গীত ইত্যাদি।  


ওলী-আউলিয়া, পীর-বুজুর্গ, কবি-সাহিত্যিক, আউল-বাউল’এর দেশ বলেই খ্যাত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ।  যেখানে বিদ্যমান সঙ্গীতের নানা শাখা। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: জারি-সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, আধুনিক, দেশাত্ববোধক, পল্লীগীতি, লোকগীতি, গম্ভীরা, মরমী, মর্সিয়া, বাউল, ঘেটু, মালজোড়া ইত্যাদি।  বাউল সঙ্গীত মূলত মরমী সঙ্গীতেরই একটি শাখা।  সুফী, মরমী সাধক এবং বাউলগণ আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনা থেকেই সঙ্গীত রচনা করেন আর তাদেরকে তাই বলা হয় মরমী কবি।  আর যাঁদের কন্ঠে এসব গান গীত হয় তাদেরকে বলা হয় বাউল বা বাউল শিল্পী।  বাউল একটি সাধক বা গায়ক সম্প্রদায়ও বটে।  অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাউল-সাধকরা  নিজেরাই গান রচনা করেন এবং গেয়ে থাকেন।  সাম্প্রতিককালে প্রথিতযশা সঙ্গীত শিল্পীদের মুখেও এসব গান গীত হয়ে চলেছে।  কিছু কিছু বাউল সঙ্গীত আবার পপ সঙ্গীতের আদলেও এখন গাওয়া হচ্ছে।


সুফীবাদ বা সুফী দর্শন  যেমন জগতের নানাবিধ উপাদান- প্রকৃতি, মানুষ, সময়, স্থান ইত্যাদির পূর্বাপর সম্পর্ক, নির্মাণ-কৌশল, উদ্দেশ্য, দেহ-মনের সম্পর্ক ও এর পরিণতি ইত্যাদি নিয়ে অনুসন্ধান করে তেমনি বাউল দর্শনও একই দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করে কিংবা গান রচনা করে থাকে।  বাউল দর্শন তাই সুফী বা মরমী দর্শনেরই এক ভিন্ন রূপ।  একে কখনো সমার্থক আবার কখনো ভিন্ন শাখাও মনে করা হয়। বাউল সাধকরাও তাদের সুগভীর অর্ন্তদৃষ্টি বা হৃদয়চক্ষু দিয়ে ঐসব বিষয়াবলীর অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করেন।  কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে বুদ্ধির পর্যায় অতিক্রম করে সরাসরি আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের সান্নিধ্য অর্জনে ব্রতী হন এবং উপলব্ধি করেন সেই মিলনের অনবদ্য অনুভূতি। তারা তখন সত্তার চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েন এবং দেহ-মনের নানাবিধ কার্যকলাপ, স্রষ্টার সাথে এর সম্পর্ক, জগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য ইত্যকার বিষয়াবলী নিয়ে ভাবতে থাকেন কিংবা সঙ্গীত রচনা করেন, যা এক সময় সাধারণ মানুষকেও সত্তার চিন্তায় মগ্ন হতে অনুপ্রাণিত করে।  সাম্প্রতিককালে আধুনিক ও ব্যাণ্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতির উদ্ধত উল্লম্ফনের মাঝেও বাউল সঙ্গীত যে একবারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এমন নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রচার-প্রসারও হচ্ছে।  বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসে, বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের বার্মিংহামে যখন ‘বাউল উৎসব’ হয় (২০১১ সালে), তখন এর জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজন সহজেই অনুমেয়।  


মুসলিম চিন্তা-চেতনার বিপরীতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও একই ধরনের মরমী ভাবধারা স্পষ্ট লক্ষণীয়।  বৈষ্ণব মতে, সৎ, চিৎ, আনন্দ পরম সত্তার স্বরূপ এবং হ্লাদিনী, সন্ধিনী ও সংবিদ তাঁর শক্তি। প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থাই ভাব।  ভাবের পরাকাষ্টাই মহাভাব।  এই মহাভাব বা মহাপ্রেমের মূল কথা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর, ভক্ত ও ভগবানের নিকটতম ও নিবিড়তম সম্বন্ধ এবং তাঁর সঙ্গে যুক্ত নির্মল আনন্দ। এই আনন্দঘন অবস্থার অপরোক্ষ প্রতীতির মধ্যেই ভক্ত সাক্ষাৎকার লাভ করেন ভগবানের।  প্রেমিক ও ভক্ত কবি চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, সন্ত কবি দাদু ও কবীর, বাউল কবি, সুফী কবি, এঁরা সবাই এ প্রেমের আদর্শে সগোত্র ও সমদর্শী।  মরমী অনুভূতির প্রশ্নে তাঁরা একমত যে, যেখানে অনাবিল ও অখণ্ড প্রেম সেখানেই মিলন ঘটে সান্ত ও অনন্ত জীবনের, ভক্ত ও ভগবানের।  ফলে এই মিস্টিক বা মরমী চিন্তা থেকে সৃষ্ট সঙ্গীত ধর্মের সীমা অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে একসূত্রে গেঁথে দেয়।  


‘বাউল’ শব্দটি শ্রীকৃষ্ণ বিজয় (আনুঃ ১৫৭৩), চৈতন্যচরিতামৃত (আনুঃ ১৫৮৩) প্রভৃতি সাহিত্যকর্মে স্থান পেয়েছে। মধ্যযুগের এসব সাহিত্যকর্মে বাউলবাদ বুঝাতে একটি ধর্মীয় মতবাদ বুঝানো হয়েছে।  এতে মনে হয় বাউলদের উদ্ভব পঞ্চদশ শতাব্দির শেষার্ধে।  তবে ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য  (বাংলার বাউল ও বাউল গান, কলকাতা, ১৩৬৪) মনে করেন, বাউল দর্শন বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদ হতে গৃহিত। তবে বিভিন্ন মত পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বাউলবাদ বা বাউল দর্শন গৌড়ীয় সহজিয়া বৈষ্ণব দর্শন, সহজিয়া বৌদ্ধ দর্শন ও সুফী দর্শনের সংমিশ্রণে সমগ্র বাংলায় বাউলবাদের উদ্ভব হলেও এর একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে।  তবে একথা সত্য যে, এ সবক’টি দর্শনই মূলতঃ প্রেম দর্শন। বাউল দর্শনে এ প্রেম দু’ভাগে বিভক্ত।  জাগতিক প্রেম আর ঐশ্বরিক প্রেম অর্থাৎ ‘ভবের পীরিত’ আর ‘ভাবের পীরিত বা খোদার পীরিত’। ভবের পীরিত ইহজাগতিক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করে আর ভাবের পীরিত জগতের আদিসত্তা বা স্রষ্টার প্রেমে নিমজ্জিত করে তার সান্নিধ্যলাভে আকৃষ্ট করে।  এখানে জৈবিক চাহিদা নয় আত্মিক চাহিদাই মুখ্য হয়ে ধরা দেয়।  বাউল দর্শন বিভিন্ন ধর্ম বা গোত্রের লোককে একই বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছে।  বৈষ্ণব বা সন্ন্যাসী, মরমী বা সুফী ও বাউলগণ যখন ভাব সমাধিতে তন্ময় থাকেন এবং স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভে ব্যাকুল হয়ে উঠেন তখন তারা প্রায় একই ধরণের সঙ্গীতে অনুরক্ত হয়ে উঠেন। এ ধরণের সঙ্গীত যখন গাওয়া হয় তখন কেউ কেউ একা একা অতি নির্জনে গেয়ে থাকেন আবার দেখা যায় অনেকেই সম্মিলিতভাবে নানা বাদ্যযন্ত্র সহকারেও গেয়ে থাকেন।  আর এসব বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে থাকে- একতারা, দোতরা, ঢোল, করতাল, ঝুনঝুনি, ডুগডুগি, মন্দিরা, ঘুঙুর ইত্যাদি।  বাউলরা বিশেষ করে এক ধরণের পোষাক পরিধান করেন এবং গলায় দ্রাক্ষা মালা পরে থাকেন, ফলে যে কেউ তাদেরকে বাউল বা সন্ন্যাসী বলে চিহ্নিত করতে পারেন।  


যাদেরকে আমরা মরমী কবি, বাউল কবি বা গায়ক বলে জানি এবং যাদের রচিত গান স্থানে স্থানে গীত হতো বা যারা নিজেরাই গান করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁঈ, মরমী কবি হাছন রাজা, শীতালং শাহ, শেখ ভানু, শেখ চান্দ, সৈয়দ শাহনূর, দূরবীন শাহ, আরকুম শাহ, ফকির মজনু শাহ, কবিয়াল রমেশ শীল, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, কবি মুকুন্দ দাশ, চাঁদ কাজী, দীনহীন, রকীব শাহ, পাণ্ডু শাহ, দুদু শাহ, গোঁসাই গোপাল, চণ্ডীদাস গোঁসাই, রশিদ শাহ, ফটিক শাহ, সৈয়দ শাহ অছিউল্লাহ, আবুল হাশিম, কিম্মত আলী চিশতি, পীর মজির উদ্দীন, সৈয়দ মর্তুজা, গিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।  আর অতি সম্প্রতি দেশ-বিদেশব্যাপী যার গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বাউল সঙ্গীতে যিনি আলোড়ন তুলেছেন তিনি শাহ আব্দুল করিম।  আবার কখনো কখনো নাম-পরিচয়হীন কিছু গায়কও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বরচিত গান গেয়ে থাকতেন, এমনকি আজো এমনটি হয়ে থাকে।  এদের কেউ কেউ বাউল, উদাস, পাগলা, কাঙাল/ কাঙালিনী  কিংবা বয়াতি নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকেন।  তাদের মধ্যে বাউল আমির উদ্দিন, আব্দুর রহমান বয়াতী, কুদ্দুস বয়াতী, বাউল কালা মিয়া, বাউল আরিফ দেওয়ান ও কাঙালিনী সুফিয়া খাতুনের নাম উল্লেখযোগ্য।  এমনি অগণিত অসংখ্য বাউল, উদাস, মরমী কবি ও গায়ক রয়েছেন বাংলাদেশের সর্বত্র।  


এবারে কিছু মরমী সঙ্গীতের আলোকে বাউল দর্শনে কিভাবে মরমী চিন্তা পরিস্ফুট হয়ে উঠে এর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।  একটি আধ্যাত্ম গান যেমন: ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশীদিন ভবের মাঝারে।  এ গানটিতে আল্লাহ বা পরম সত্তাকে ‘দয়াল’ বলে আখ্যায়িত করে সাধক বলছেন, তার দয়াল তাকে ডাকছেন, কাজেই ‘ভবের মাঝে’ বা বস্তুজগতে আর বেশীদিন তিনি থাকতে চান না।  ফলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির চূড়ান্ত মিলনের প্রত্যাশাই এ গানের মর্মকথা।  আবার যখন অন্য একটি গানে শুনি: আমার হাত বান্ধিলাম, পাও বান্ধিলাম, মন বান্ধিমু কেমনে/ তোমরা যে বুঝাও সখী মনে না আর মানে।  তখন মনে হয় সত্যিই তো বাস্তবে কারো হাত-পা বেঁধে রাখা সম্ভব কিন্তু তার মন বা ভাবনার বাতায়নে বারবার যখন উঁকিঝুকি মারে প্রেমাস্পদ বা পরম সত্তার সান্নিধ্য লাভ, তখন তাকে বেধে রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করা কি আদৌ সম্ভব?  অপর একটি দেহতত্ত্বের গানে যখন বলে:  দেহঘড়ি চৌদ্দ তালা তার ভিতরে দশটি নালা/ একটি বন্ধ নয়টি খোলা...তখন এই গানে দেহকে ঘড়ির সাথে তুলনা করে এর চৌদ্দটি স্তরের কথা বলা হয়েছে আর দশটি নালার মধ্যে নয়টি খোলা ও একটি বন্ধ বলে দেহের সৃষ্টির রহস্যকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে- এতে কোন সন্দেহ নেই।  ভাবুক মন তাই সদাই এ সবের রহস্য উৎঘাটনে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে।


মরমী বা বাউল দর্শনে ‘দয়াল, দয়াময়, সর্বময়, মুরশীদ, পাক সাঁঈ, বন্ধু, বন্ধুয়া, প্রাণের বান্ধব, প্রাণের বন্ধু, প্রাণবন্ধু, সোনা বন্ধু, প্রাণের মানুষ, মনের মানুষ, প্রাণনাথ, মৌলা, আল্লাজি, প্রিয়তম- এমনি নানা নামে স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানো হয়েছে।  একটি উদাহরণ যেমন: দয়াল মুরশীদও কতো ভালবাসি তোমারে। তাছাড়াও পরমসত্তা আল্লাহ বা পরমাত্মাকে- কখনো আল্লাহ, কখনো ঐশ্বর, কখনো ভগবান নানাভাবে ব্যক্ত করা হয়। ধর্মের গণ্ডি অনেক ক্ষেত্রেই লঙ্ঘন করা হয়েছে প্রাণের তাগিদে, কিংবা চিন্তাকে সার্বজনীন করার মানসে।  অপরদিকে মানুষের দেহকে- দেহঘর, মনমন্দির, কায়া, মাটির পিঞ্জিরা, আন্ধার ঘর ইত্যাদি নামে আর আত্মাকে- মন, প্রাণ, প্রাণপাখি, মন মনিয়া, অচিন পাখি, অন্তর ইত্যকার বহু অভিধায় চিত্রিত করা হয়েছে।


বাংলার বাউল ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ফকির লালন শাহ বা লালন সাঁঈ (১৭৭৫-১৮৯০) ’এর নাম। কুষ্টিয়ায় তার মাযারের সন্নিকটে যেনো গড়ে উঠেছে এক ‘বাউলনগর’।  ভক্ত-অনুরাগীরা সাধনা করে চলেছেন বাউল সঙ্গীত।  প্রায় প্রতিবছরই কুষ্টিয়া ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত হচ্ছে বাউল মেলা, লালন মেলা, লালন উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানমালার, যেখানে গীত হয়ে চলেছে তার গান। এবারে লালন শাহের কয়েকটি গানের দিকে একটু দৃষ্টি দিই- যেমন: খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়  কিংবা আমি অপার হতে বসে আছি ওহে দয়াময়। এখানে ‘দেহ’ নামের মাটির খাঁচায় ‘প্রাণ’ নামের যে ‘পাখি’র বাস, সেই পাখি কিভাবেইবা আসে আবার কিভাবেইবা খাঁচা ফেলে চলে যায়- এর রহস্য লালনকে ভাবিয়ে তুলেছে।  এটি যে কেবল লালন চিন্তার বিষয় তা-ই নয় বরং প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের মনেই এ প্রশ্ন জাগে।  আর তখনই সেই খাঁচা আর পাখির কারিগরের দিকে আমাদের হৃদয়চক্ষু বিস্তারিত হয়, আমরা তাকে অর্থাৎ আদিসত্তা বা পরমাত্মার সন্ধান লাভে তখন মনোনিবেশ করি। আবার যখন তিনি বলেন,  আমি পার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়... এই গানটিতে তিনি ঘাটের একা যাত্রী ভাবেন আর এ সংকটে তার দয়াময় ছাড়া কেউ পাড়ে নিয়ে যেতে পারবে না বলেই দয়াময়ের সান্নিধ্য কামনা করেন। তাতে স্পষ্টতঃ বুঝা যায়, অসীম প্রান্তর পেরিয়ে দয়াময় বা পরমসত্তার সাথে মিলন চিন্তায়ই তিনি মগ্ন।  এমনিভাবে তার প্রতিটি গানেই আধ্যাত্ম-সুর ঝংকৃত হচ্ছে, যা যুগ যুগ ধরে সাধক মনকে করবে আলোড়িত, হয়তো একসময় সাধকরা পানও পথের দিশা।  বিভিন্ন শিল্পী লালন শাহের গান গেয়ে থাকলেও লালন সঙ্গীতের মাধ্যমে লালন শাহের যে ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছে তার অনেকটা কৃতিত্ব শিল্পী ফরিদা পারভীনের।  সাম্প্রতিককালে শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়ও লালন সঙ্গীতে ব্যাপক সুখ্যাতি পেয়েছেন।


মরমী কবি হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) যিনি জমিদার দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী ছিলেন, একসময় সত্তার চিন্তা এবং ইহজগতের মোহ-মায়া অতিক্রম করে তিনি হয়ে উঠেন বাউলা, উদাস বা মরমী কবি।  যাকে ঘিরে আজ সুনামগঞ্জে হাছন মেলা, হাছন উৎসব হয়ে থাকে।  তাঁরই মরমী সঙ্গীতে তিনি যখন বলেন: আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাহর সঙ্গে/ হাছন রাজা আল্লাহ বিনে কিছু নাহি মাঙে কিংবা হাছন রাজায় কয়-/ আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়/ অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়..  তখন তিনি আল্লাহর সঙ্গে মিলনের প্রত্যাশাই করেন আর অন্তরে-বাইরে কেবল দয়াময় আল্লাহর অবস্থান অনুভব করেন।  আবার যখন বলেন, বাউলা কে বানাইলো রে হাছন রাজারে/ বানাইলো বানাইলো বাউলা তার নামটি মৌলা কিংবা  মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে/ কান্দে হাছন রাজার মন মনিয়া-রে...  তখন তিনি তাঁর মৌলা বা আল্লাহই যে তাকে বাউলা বানিয়েছেন কিংবা মাটির পিঞ্জিরা অর্থাৎ মাটির দেহে কিভাবে প্রাণ দিয়ে একে বন্দী করে রেখেছেন আল্লাহ নামের পরমসত্তা- এসবেরই সুর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে তার সঙ্গীতে।  আর এসব চিন্তাই মানুষকে ব্যাপৃত করে নিজেকে বা আত্মসত্তাকে এবং তার উৎস পরমসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে চেনার-জানার।  আর সেই সুরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে লালনের গানেও: একবার আপনারে চিনতে পারলে অচেনারে যায় চেনা/ ও যার আপন খবর আপনার হয় না।


মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (১২০৭-১২৭৩) যখন বলেন, “বাঁশী যখন বাঁজে তখন শোন দিয়া মন/ প্রাণ বন্ধুয়ার লাগি বাঁশী করিছে ক্রন্দন”- তখন সেই একই সূর যেনো ভেসে আসে  চণ্ডিদাস (১৪০৮- ? ) ’এর গানে: কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কাঁলিনী নৈকূলে/ কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে.. এখানেও উভয়ে সৃষ্টিকর্তাকে বুঝিয়েছেন।  তাদের মতে, বাঁশী কেবলই সৃষ্টিকর্তার জন্যে বাজে, যেনো বাঁশীতে আর কোনো সুর উঠতে পারেনা।  অপরদিকে শ্রী চৈতন্য (১৪৮৪-১৫৩৩) যখন বলেন, নাম ধর নাম জপ নাম সর্বময়/ নাম জপ হইতে হয় সর্বপাপ ক্ষয়। এখানে কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বনিয়ন্তা, সর্বশক্তিমানকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।  আর তার সাথে আত্মার গভীরতম সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই সকল পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে স্পষ্ট করা হয়েছে। কাজেই সৃষ্টি ও স্রষ্টার সম্পর্ক একবিন্দুতে মিলিত হয়ে গেলে যে আর কোন শঙ্কার সম্ভাবনা থাকে না, সকল পাপ থেকে নিজেকে তখন মুক্ত করা যায়- এখানে তা-ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মরমী, সুফী বা বাউল দর্শনে এই গীতই বারবার বেজে উঠে।


পাগলা কানাই (১৮০৯-১৮৮৯) মুহাম্মদ (সাঃ)’কে এবং কৃষ্ণ’কে একটি অভেদ সম্পর্কে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।  তিনি দেখাতে চান- তারা একই সত্তার দুটি ভিন্ন রূপমাত্র। তাই বুঝিবা তিনি বলেছেন: এক বাপের দুই বেটা, তাজা মরা কেহ নয়/ সকলেই এক রক্ত, এক ঘরে আশ্রয়..।  তবে এখানে শতর্ক থাকতে হবে যে, ভাব জগতের কোন বিষয়-আশয় বাহ্যিক জগতের আঙ্গিকে বিচার বা ব্যাখ্যা করা যাবে না।  এটা একান্তই মরমী চিন্তা, যেখানে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা বা খণ্ডবুদ্ধির কোনো স্থান নেই, কেবল আত্মিক উপলব্ধিই সেখানকার মানদণ্ড।


সৈয়দ শাহনূর (১৭৩০-১৮৫৪) ’এর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে এমন কথা: বন্ধু যদি হইত মাথার কেশ/ হাতে দর্পন ধরি রূপ নেহারি, পুরাইতাম মনের খায়েশ কিংবা তুমি চিনলায় নারে মন/ একৈ মন্দিরে বাসা না হৈল মিলন..। এখানে প্রথমটিতে তিনি বন্ধুকে মাথার চুলের মতো অতি নিকটে পাওয়ার কল্পনা করেন এবং আয়না দিয়ে তার যথার্থ রূপ দেখে মনের তৃপ্তি মিটানোর যে চাহিদাই ব্যক্ত করেন।  অপর এক গানে বলেন, দেহ-মনের পরষ্পারিক বসবাস সত্ত্বেও একে অপরের সাথে মিলন হলো না। কাজেই ভাবুক মন সবসময়ই দেহ-মনের মিলনের পাশাপাশি সত্তার সাথে আত্মার সম্পর্কে স্থাপনে সদা ব্যস্ত।


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) বাউল আঙ্গিকের কিছু রচনার দিকে দৃষ্টি ফিরালে দেখি তিনি বলেন: আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/ তাই হেরি তাই সকলখানে কিংবা সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।  এখানে কতটা সুন্দর করেই না তিনি বললেন- প্রাণের মধ্যেই রয়েছে প্রাণের মানুষ, সসীমের মধ্যেই অসীমের প্রকাশ অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার প্রকাশ।  আর সৃষ্টিকে বিকশিত করার জন্য স্রষ্টার কাছেই আমাদের চূড়ান্ত প্রার্থনা।  এখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির অপূর্ব মেলবন্ধনের সুরই মূর্ত হয়ে বাজে।


শাহ আব্দুল করিম (১৯১৬-২০০৯) তার গানে যখন বলেন: খুঁজিয়া পাইলাম নারে বন্ধু, তুমি কোথায় থাক/ আমি তোমায় দেখতে নারি, তুমি আমায় দেখ। আবার যখন বলেন, নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী অকূল সায়রে/ কূল দাও কি ডুবাইয়া মার, যা লয় তোমার অন্তরে... তখন তিনিও তার প্রাণ বন্ধু অর্থাৎ দয়াল আল্লাজি’রে খুঁজে পাননি, তাঁকে দেখার আকুল বাসনা রয়ে যায় তার মনে। তারপরও তিনি তার ভরসা ছাড়েননি, নৌকা ছেড়েছেন একমাত্র তার দয়ালের ভরসায়।  জীবিত রাখলে বা ডুবাইয়া মারলেও তার কোন দুঃখ নেই।  কেননা, তাঁর সৃষ্টজীবের কষ্টে তিনিই যে কষ্ট পাবেন এ বিশ্বাস তার রয়েছে।  আবার যখন বলেন সখী কুঞ্জ সাজাও গো / আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে - এখানে কুঞ্জ বলতে মনের ঘরকে বুঝিয়েছেন আর তাকে সজ্জিত করে রাখতে বলেছেন- কেননা তার প্রাণনাথ আসতে পারে এই ঘরে, তখন যে তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতেই হবে। এখানে হৃদয় মন্দিরে পরমসত্তার উপস্থিতির বাসনাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।


মহাকবি সৈয়দ সুলতান (হবিগঞ্জ)’এর উত্তরসূরী সৈয়দ আব্দুন নূর হোসেন চিশতি (১২৬১-১৩২৫ বঙ্গাব্দ) ‘দীনহীন‘ ছদ্মনামে লিখতেন।  তার দু-একটি গানও এখানে বিধৃত হলো: রহিম তোমার নামরে বন্ধু রহিম তোমার নাম/ তোমার জুনাবে ভেজি হাজার ছালাম/ রহম করিয়া তুমি সৃজিলায় আমারে/ ‘হুয়াল জাহির‘ নাম ধরিলায় তোমায় পাইবারে।  দীনহীনও আল্লাহকে ‘বন্ধু’ সম্বোধন করে তার সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন তুলেন।  সেই বন্ধু থেকে তিনি উদ্ভূত কি-না এ চিন্তায় তাকে পেয়ে বসে। যদি সত্যি সত্যিই তা থেকে আমার উদ্ভব, তাহলে তাঁকে ছাড়া আমি কিভাবে বেঁচে থাকতে পারি? এ প্রশ্নই তাকে সত্তা চিন্তায় বিভোর করে তুলে আর এ গানই গীত হয়ে চলেছে বাউল কণ্ঠে।


এমনিভাবে বাংলার মাটিতে অসংখ্য-অগণিত আউল, বাউল, ফকির, দরবেশ ও মরমীভাববাদী জন্মেছেন যাঁদের রচিত কবিতা, গান ও সঙ্গীতে পূর্ণ হয়েছে বাংলার ঐতিহ্যের ভাণ্ডার, বাংলার মাটি ও মানুষের মন সত্তাপ্রেমে হয়েছে সজীব, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টি করেছে মধুরতম সম্পর্ক, সত্তাদর্শন বা সত্তাপ্রাপ্তি হয়েছে সহজতর।  আর তাদের চিন্তাধারা ও সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে হলে ব্যাপক পরিসরের প্রয়োজন, যা এখানে সম্ভব নয়।  তাই ইতি টানতে চাচ্ছি এই বলে যে, আত্মপরিচয় থেকে সত্তার পরিচয়, আত্মা ও সত্তার সম্পর্ক, সৃষ্টির রহস্য, জগৎ সংসারে মানুষের করণীয়- ইত্যকার ইহজাগতিক ও পারলৌকিক বিষয় যখন মানবমনে প্রবল হয়ে দেখা দেয়, তখনই সাধক পারে কেবল ভাবের জগতে নিমজ্জিত হতে।  আর সেই নিমজ্জন বা তন্ময় অবস্থাই আত্মাকে করে তুলে সত্তাপ্রেমিক, আর আত্মাও তখন সত্তার সন্ধান পেয়ে লাভ করে আত্মতৃপ্তি।  কেননা, মায়াময় এ নৈসর্গিক জগতের অপরিসীম সৌন্দর্য ও মাধুর্য সৃষ্টজীবকে বিশ্বস্রষ্টার প্রতি প্রেমাসক্ত করে তোলে, ফলে উভয়ের আত্মিক মিলনে এর সফল পরিণতি ঘটে। এমনিভাবে মনোজগতের তুষ্টি মানুষকে করে তুলে সুস্থ-সুন্দর চিন্তার অধিকারী। এই চিন্তার বাইরে অসুস্থ, অশ্লীল, অমার্জনীয় সকল ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাজ্য, আর যারা এসব অশ্লীলতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি, এরা সাধক নয়, এরা অসুন্দরের পূজারী, কেবলই নর্দমার কীট। এদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে সত্তাপ্রেম ও সত্তালাভই হোক সকল সদাত্মা, সুফী, বাউল, মরমী ভাববাদীদের অভীষ্ট লক্ষ্য।


লেখকঃ অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক (বার্মিংহাম, ইউকে)।


তথ্যসূত্র:
১. ড. আমিনুল ইসলাম: জগৎ জীবন দর্শন; বাংলা একাডেমী, ঢাকা (জুন ১৯৯২)
২. ড. আমিনুল ইসলাম: মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন; বাংলা একাডেমী, ঢাকা (ডিসেম্বর ১৯৮৫)
৩. ড. মুহাম্মদ আব্দুল হাই ঢালী: বাংলাদেশ দর্শন; মিতা ট্রেডার্স, ঢাকা (১৩৯৪ হিঃ)
৪. সৈয়দ মোস্তফা কামাল: সিলেটের মরমী সাহিত্য; সিলেট ট্রান্সলেশন এণ্ড রিসার্চ, লণ্ডন (মে ১৯৯৮)
৫. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান: সিলেট বিভাগের পাঁচশ মরমী কবি; নিউ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, সিলেট (১৯৯৬)
৬. সৈয়দ ইকবাল: কিংবদন্তির আধ্যাত্মপুরুষ সৈয়দ হেকিম (রাহঃ); মাসিক মদীনা, ঢাকা (জানুয়ারী ১৯৯৬)
৭. সৈয়দ ইকবাল: বিশ্রুত এক পূন্যপুরুষ সৈয়দ আব্দুল্লাহ (রাহঃ); মাসিক আত্ তাওহীদ, চট্টগ্রাম (জুন ১৯৯২)
৮. ইন্টারনেট (গুগল সার্চ এঞ্জিন)।