বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের রয়েছে ইসলামী তাহজীব-তামদ্দুনের এক গৌরবময় ইতিহাস। এই ভূমিতে পাঁচ শতেরও বেশী মরমী কবির জন্ম। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে যেসব নাম তাঁদেরই একজন আজকের উপলক্ষ গণমানুষের কবি, প্রয়াত কবি দিলওয়ার। শুধু সিলেট কেন, বাংলাদেশের গণ্ডি অতিক্রম করে সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাঁদের রয়েছে সুনাম-সুখ্যাতি তাঁদের মধ্যে দার্শনিক দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী, কবি আফজাল চৌধুরী, কবি দিলওয়ার, দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা, ঐতিহ্যলেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন খান, রাগীব হোসেন চৌধুরী, মুসলিম চৌধুরী, অধ্যাপক আসদ্দর আলী, নন্দলাল শর্মা ও কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ প্রমুখ অন্যতম।


তাঁদের কারো কারো সাথে কথা, সাক্ষাৎ ও চলাফেরার সুযোগ হলেও, কবি দিলওয়ারের সঙ্গে আমার সে সুযোগটি হয়ে উঠেনি বলে দুঃখবোধও কম নয়। এই দুঃখবোধ নিয়েই আজ আমি তার সাহিত্যের দিকে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে তৃপ্ত হতে চাচ্ছি। আমরা যখন শুনিঃ


“তুমি রহমতের নদীয়া
দোয়া করো মোরে হযরত শাহজলাল আউলিয়া
যে দেশেতে আসিলা রসুল দয়ার পারাপার
সেই দেশ হইতে আইলায় তুমি ইনসাফও আল্লাহ্‌র
এই সিলেট ভূমি পূণ্য হলো তোমার পরশ পাইয়া
দোয়া করো মোরে হযরত শাহজলাল আউলিয়া”।


তখন আমরা কবিকে দেখি না, দেখি তার সৃষ্টিকে। আর শ্রদ্ধায় অবনত হই স্রষ্টার প্রতি, গুণকীর্তন করি স্রষ্টা ও তাঁর প্রেরিত মহামানব মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁদেরই উত্তরসূরী পূণ্যপুরুষদের, যাদের মাধ্যমে আমরা ইসলামকে চিনতে পেরেছি এবং গ্রহণ করতে পেরেছি।


আমি কে? কোত্থেকে আসলাম? কীবা আমার পরিচয়? কে পাঠালেন? কেন পাঠালেন? কী আমার কাজ? – এসব প্রশ্ন সদাই ভাবুক/ মরমী/ দার্শনিক মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এদিক থেকে কবি দিলওয়ারও ভিন্ন নন। তাই তিনি মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে যখন বলেনঃ


“শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়
আমরা কি আজো দিতে পারলাম মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খণ্ডে খণ্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে মানুষের বিধাতাকে”।


অপরদিকে, কবি যখন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই উত্থাল দিনগুলোতে লিখেছিলেনঃ


“জুলুম-শোষণ-বঞ্চনার
অগ্নি ফসল বাংলাদেশ
রাখবোনা আর বক্ষে তা
দুখ বেদনার শঙ্কা লেশ।
মুক্তি নিশান উড়ছে তার
রক্ত নয়ন ঘুরছে তার
দুশমনেরা খবরদার!
চূর্ণ মোহর স্বপ্নাবেশ”।
(বাংলা তোমার-আমার)


কবি যেহেতু সংগ্রামী চেতনা নিয়ে বেঁচেছিলেন আর রাজনীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাই তার এমন উচ্চারণ খুবই স্বাভাবিক। হাল আমলের রাজনীতি যেভাবে আমাদের দেশ ও জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে আর রাজনীতিকদের যাঁতাকলে জনগণ যেভাবে পিষ্ট হচ্ছে, তা যে কোনো সচেতন ব্যক্তি বা মহলকেই ভাবিয়ে তুলবে। এমনই সচেতনতা আমরা দেখি কবি দিলওয়ারের লেখায়ওঃ


“মার্কায় ডানবাম অনেক ‘ফ্যারাও’
পদ্মিনী বাংলাকে করেছে ঘেরাও
হীরা মোতি পান্না ও মণিকাঞ্চন
ধমনীতে রক্তের ধ্বনি চন চন
বিনিময়ে মানুষেরা পায় সন্ত্রাস
নির্মম নিষ্ঠুর এই ইতিহাস”।


কবির প্রেম ছিল প্রবল। তিনি স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভালোবেসেছিলেন গোটা বিশ্বকে। তাই তিনি তাঁর
‘গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা’ কবিতায় বলেনঃ


“প্রিয়তমা এসো তুমি যৌথকণ্ঠে শেষ বার বলি
আমরা বহন করি অলৌকিক মানবতা বোধ
তাকে রোজ স্নাত করে অতলের জলীয় আমোদ
তার স্বাদ পেতে চায় আদিম প্রাণের কথাকলি
উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি রোদ হাতে নাজিম হিকমত
ম্যাক্সিম গোর্কির রাত আজো কিনা হয়নি নিঃশেষ
জননীর কণ্ঠে শুনি বাঁধভাঙ্গা কঠোর আদেশ
ধ্বংসকে দেখিয়ে দাও সৃজনের ধ্রুপদী হিম্মত
প্রিয়তমা, মনে রেখো পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণ
অগত্যা বিশ্রাম নেই আকাঙ্খিত আলোর সফরে
অনাগত সন্তানেরা রক্তস্রোতে বিচরণ করে
পশু মানুষের হাতে নয় তারা কখনো অধীন
প্রিয়তমা তুমি নও, গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা
তার জন্য অনিবার্য বৈপ্লবিক প্রেম-পরিক্রমা”।


জন্মের পর থেকেই শুরু হয় মানুষের সংগ্রাম।  সে সংগ্রাম বেঁচে থাকার সংগ্রাম। যা কখনো প্রকৃতির সঙ্গে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে, দৈনতার সঙ্গে কিংবা কোনো শক্তিধর তাগুতের সঙ্গে। কেউ হয়ত উদয়াস্ত সংগ্রাম করে সফল হয় আবার কেউবা হয় পুরোপুরি বিফল। এর কারণ কিংবা প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন এভাবেঃ


“পৃথিবীতে এসে কেঁদে যায় যারা বেদনার গেয়ে গান
হতাশার কালো নয়নে মাখিয়া তপ্ত নিশ্বাস ফেলে
নত করি শির চরণে নিজের দুঃখের পসরা ঠেলে
মহাজীবনের ললাটে আঁকিয়া তলোয়ার খরশান
তাদের বিফল জীবনের লাগি, বলো ঠিক দায়ী কারা
বিধি না জনক? শাক্ত না ধনী? কোথায় জবাব তার
লুকালো কোথায় উত্তরদাতা, সে কোন অন্ধাকার?
নিবিড় আবেগে কাঁপিছে আমার দুইটি আঁখির তারা”!


এমন লেখায় সদা-সর্বদাই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কষ্ট, আবেগ, অনুভূতির আওয়াজ ফুটে উঠতো।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের সুরমা পাড়ের এ সন্তানের ভোর হতো ঐতিহাসিক কীন ব্রীজে। তাঁর অবলোকনের ব্যাপ্তি যে কাউকে আন্দোলিত করে তাঁর ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’ কবিতা পাঠ করলেঃ


এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখীকে দুলিয়ে।
নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা
সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।
সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখীর কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কুরণ!
ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কীন ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।


কবির লেখা ‘আমার মৃত্যুর পর’ কবিতায় তিনি বলেনঃ


“আমার মৃত্যুর পরে যদি তুমি
কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি
মনে রেখো তবে
বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে
আমার দিন
প্রতীচ্যের মুক্তির গৌরবে”।


এমনি একজন শিল্প-সাহিত্যের আলোকিত মানুষ, রাজনীতি সচেতন তথা সাধারণ মানুষের উচ্চকণ্ঠ কবি দিলওয়ারের প্রয়াণ (১০/১০/২০১৩ খ্রিঃ) আমাদের সাহিত্যজগতে শূন্যতার বিউগল বাঁজায়। তাঁর লেখনী হোক আমাদের প্রেরণার উৎস আর তাঁর পারলৌকিক জীবন হোক শান্তিময় - পরম করুণাময়ের কাছে আজ এই প্রার্থনা!


সৈয়দ ইকবালঃ অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক।