ভাগ্যের দুর্বিপাকে কিংবা ‘সুখে থাকতে ভূতের কিলায়’ বলে আমি বিলেতবাসী হই ২০০১ সালের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবসে’। সমাজবাসী মানসিকতার কারণেই বার্মিংহামে আসার পর থেকে খুঁজতে থাকি বাঙালি সমাজ; যেনো একটুখানি মাতৃভাষার স্বাদ পূরণের ইচ্ছায়। স্বাচ্ছন্দ্যে কারো সাথে কথা না বলতে পারায় একটা গুমোট ভাব জমে তখন মনে। চেষ্টা করি কবিতা লিখে শান্তি খোঁজার।  কিন্তু কে-ই-বা শুনবে কিংবা বুঝবে! তাই খুঁজে খুঁজে যাই বাঙালি সংগঠন বা সভা-সমিতিগুলোতে। এমনি এক পর্যায়ে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের রান্নাঘরে চা খেতে যেয়ে জনাব ইকবাল হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে পরিচয় হয় জনাব জাহাঙ্গীর আলম, যিনি কিনা ‘জান আলম’ নামে পরিচিত তাঁর সাথে। লোকটিকে দেখামাত্র তেমন ভালো না লাগলেও ভরাট কণ্ঠের কথা শুনে এবং কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় বেশ ভালোই লাগলো আমার। কথাবার্তায় মনে হলো বেশ শিক্ষিত; পরে জেনেছিলামও তাই। আমাকে বললেন, “ভুল সময়ে এলেন ভাই; আপনার মতো লোকদের আরো আগে আসা দরকার ছিলো। যা হোক- চেষ্টা চালিয়ে যান, ভালো একটা কিছু করার জন্য। প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য পাবেন”।
এরপর নানা সভা-সমাবেশে, আড্ডায়, তাঁর ‘বিইআর’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশীস ফর ইকুয়াল রাইটস’ নামের সংগঠনের অফিসে বসে কথা হয়েছে ঘনিষ্টভাবে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “শুনলাম আপনার বাড়ি হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জে কোথায়”? হবিগঞ্জী উচ্চারণে উত্তর দিলেন, ‘ছরম-মোয়া’ অর্থাৎ ‘চর হামুয়া’ গ্রামে, যা কিনা আমাদের জেলা সদর থেকে প্রায় ৩/৪ মাইল দূরে। কথায় কথায় একদিন বললাম, আমার মিসেস একটা উইমেন অরগেনাইজেশন করেছে, ফান্ডিংয়ের জন্য নানা স্থানে আবেদনও করেছে; তবে কোনো এক পর্যায়ে আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে।  তিনি বললেন, আমি একদিন আসবো এবং একদিন ঠিকই তিনি এসে হাজির হলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছুর খোঁজ-খবর নিলেন, কী কী করতে হবে বলে দিলেন। এরপর থেকে যখনই আমার সাথে দেখা হয়েছে, তখনই খোঁজ নিতেন এভাবে, “আমার বোন পারভীন কেমন আছে? তার সেন্টার কেমন চলছে”? তার দরদমাখা কথাগুলো আমাকে আপ্লুত করতো। শেষের দিকে তিনি আমাকে আপনি বা তুমি সরাসরি কোনো সম্বোধন না করলেও ‘ছোট ভাইয়ের’ মমতায় কথা বলতেন, যা আমার খুব ভালো লাগতো।  


তিনি আমাদের (বার্মিংহাম সাহিত্য পরিষদের) সাহিত্য আড্ডায়ও এসেছেন। তার ভরাট কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি সকলকে মুগ্ধ করেছে। একবার বার্মিংহাম উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী থেকে প্রস্তাব এলো তারা ‘রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত’ উৎসব করতে চান।  আমাদেরকে এ নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে। আমি স্বেচ্ছায় ‘নজরুল’ নিলাম,  জনাব মনোওয়ার আহমদ ও ইকবাল আহমেদ চৌধুরী দুইজনের একজনে ‘রবীন্দ্র’ নেবেন বললেন। কিন্তু কাকে ‘সুকান্ত’ দেয়া যায়, ভেবে পাওয়া যাচ্ছিলো না। জান আলম ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আমি নেবো”। এতে তার সাহিত্য প্রতিভার একটা প্রকাশ আমাদের কাছে ধরা পড়ে। তাছাড়া, ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর দখল ও প্রাঞ্জল বক্তৃতা আমাকে প্রাণিত করতো।


তিনি রাজধানী শহর লন্ডন থাকাকালীন কমিউনিটির উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। টাওয়ার হ্যামল্যাটস কাউন্সিলের ডেপুটি লিডার ছিলেন। বাঙালি পরিচয় বহনকারী বেশ কিছু স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতে গড়া বলেও জেনেছি। এমনকি বার্মিংহামে বসবাসকালীন সময়েও নীরবে নিভৃতে কাজ করেছেন বলেই আমরা জানি। অনেক বাঙালি সভা-সমাবেশে ইংরেজ মন্ত্রী-এমপি আসেন, সভার সৌন্দর্য বর্ধন করেন। গাদা গাদা পরামর্শ আমাদের দিয়ে যান, আমরা হজম করি। কিন্তু, একমাত্র তিনিই (জান আলম) সভায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেন তাদের, “এ কমিউনিটির জন্য তুমি কী করেছো বা করবে স্পষ্ট বলে যাও আমাদের”। এমন সৎসাহস আমি আর কোনো নেতার মধ্যে দেখিনি। শোষণহীন ও সমান-অধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠায় তার প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ছিলো প্রশংসনীয়। বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিলের জন্য ‘সিটিজেন চার্টার’ তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন; যার আলোকে বিভিন্ন কমিউনিটি- কী হারে সরকারী সুযোগ-সুবিধা পাবে এটি ছিলো, তাঁর একটি ম্যান্ডেট। তবে, কেউ কেউ তাঁকে ভুল বুঝেছেন কিংবা তার সমাজমনস্কতাকে খাটো করার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতিও খুঁজেছেন। বাঙালি সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ছোট-বড় যতো উদ্যোগই কেউ নিয়েছেন, তিনি সানন্দে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।  এদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন, যেমন: ‘এনএইচ ট্রাস্ট‘এর একজন ডাইরেক্টর ও ‘রয়েল সোসাইটি অব আর্টস‘এর একজন ফেলো ছিলেন। বাংলাদেশী অনেক সংগঠনের উপদেষ্ঠা তো আর ছিলেনই।


ঘটা করে নিজের নাম প্রচার করার জন্য, নিজেকে জাহির করার জন্য, কোনো সভা কিংবা সমিতির সভাপতির পদ লাভের জন্য, তাঁর সামান্যতম চেষ্টাও আমার নজরে আসেনি। খুবই উদার মনের মানুষ ছিলেন বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। রাজনীতি যদিও আমার পছন্দের বিষয় নয়, তবুও একদিন এক আলাপচারিতায় বলি, “আমিতো মনে করি দেশীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তি না করে, এ দেশীয় রাজনীতিতে জড়িত হওয়া আমাদের কমিউনিটির খুব দরকার। তাহলে, বার্মিংহামে একজন বাঙালি কাউন্সিলর নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আমাদের অধিকারের কথা সরকারকে জানাতে পারবো (উল্লেখ্য, তখন কোনো বাঙালি কাউন্সিলর এখানে ছিলেন না)। তাই সুযোগ পেলেই আমি বলি এবং লিখি”।  তিনি তখন খুব দুঃখ করে বললেন, “ভাইরে, আপনি তো আসলেন মাত্র সেদিন। আমি এই মাঠে কাজ করি দীর্ঘদিন ধরে। আমার কমিউনিটিকে এসব কতো করে বুঝাতে চেয়েছি কিন্তু এরা বুঝবে কী করে; এরা যে ভুল পথে হাঁটছে, ভুল নেতার পিছু ছুটছে! এতে ব্যক্তিস্বার্থ হয়তো কিছুটা হবে, তবে সমাজের বৃহৎ স্বার্থলাভ যে একেবারেই সম্ভব নয়; জানি না, হয়তো একদিন এরা তা বুঝবে”! কী বুঝাচ্ছেন, কাকে বুঝাচ্ছেন- আমি সে প্রশ্নে আর গেলাম না। তবে আজো জানি না, জান আলমের সে সংকেত আমাদের হৃদয়ে পৌঁছেছে কি-না!


এমনিভাবে নানা কথায়, নানা আড্ডায়, তাঁকে জানার, বুঝার সুযোগ আমার হয়েছিলো, কিন্তু কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। অসম্ভব সম্ভাবনাময় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁকে হারিয়ে (১লা ডিসেম্বর ২০১২) আমরা তাঁর শূন্যতাকেই উপলব্ধি করছি কেবল! এমন সৎ নেতার আবির্ভাব যুগে যুগে আমাদের কাম্য হলেও পাবো যে ক’জন একমাত্র আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন।


তাঁর অনেক স্মৃতি আজ মনে জাগরূক থাকলেও লেখার কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে এখানেই সমাপ্তি টানতে হচ্ছে। তবে এর আগে তাঁকে উৎসর্গ করা আমার কবিতাটিও এখানে যোগ করতে চাইঃ


যোগফল


সবাই চলে যায়, চলেই যাবে
নাই কারো নিস্তার,
তবুও শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব
করে চলে বিস্তার।
কতো আর্জি, কতো আর্তি
কতো যে চেষ্টা-তদবির,
জীবনের মায়ায়, সমাজের তরে
নিয়ত লড়ে যায় বীর।


রেখে গেলে এ ভবে খানিকটা
হিতকর্মের ছাপ,
একদিন না একদিন চিদাত্মায় কোনোও
লাগবে সে উত্তাপ।
কিছু কৃতি, কিছু শ্রুতি- মিলবে, মিলাবে
কল্যাণের স্তুতিগানে,
এই করে করেই সদাত্মাও
ছুটে যাবে অমরাত্মার পানে।


অবশিষ্টেরা চাইবে তখন
ফলুক সুন্দরের সুফল,
বিধাতার দরবারে প্রার্থনা আমারও
মিলুক তবে সেই যোগফল!


মহান আল্লাহ্‌ তাঁর পারলৌকিক মঙ্গল করুন!


লেখকঃ অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক।