সাহিত্যের সংজ্ঞা যদি হয় এই, ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য্য ও শিল্পের লিখিত প্রকাশ হচ্ছে সাহিত্য’। তাহলে সঙ্গীতও সাহিত্য। এমন কোন গান আছে কি? যেটা কোন  কবি বা গীতিকবি একটুও না ভেবে কয়েক সেকেন্ডে লিখে ফেলেছেন এবং তা  জনপ্রিয়তা পেয়েছে? ‘ফাইট্যাঁ যায়/বুকটা ফাইট্যাঁ যায়’ বাউল শাহ আলম রচিত মমতাজের কণ্ঠের এই গানও ইন্দ্রিয়ের জাগতিক অনুভূতি বা চাওয়া পাওয়ার চরম হতাশা হাহাকার। সাহিত্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী কি এই গানকেও সাহিত্য বলতে পারি না? অবশ্যই, সহিত শব্দ থেকেই তো সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি বলি। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা, কবিতার পাশাপাশি গান হয়েছে। আবৃত্তিশিল্পী যে কবিতা আবৃত্তি করেন ঠিক   একই কবিতা সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে গান হয়ে বাজছে। এটাকে আমরা কোন ধারার সাহিত্য বলবো?  গীতিকবির সংজ্ঞা কী আমার ভালো বোধগম্য নয়। সংজ্ঞা খুঁজতেও যাইনি কখনো। শাহ্‌ আব্দুল করিম লিখেছেন ‘কেন পিরিতি বাড়াইলিরে বন্ধু ছেড়ে যাইবি যদি?’ ‘গ্রামের নও জয়ান/হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া  বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম’ এটাকে আমরা গান বলি। পাশাপাশি ‘চিরকাল রবে মোর প্রেমেরও কাঙ্গাল/এই কথা বলিতে চাও বল, এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল/ তারপরে যদি তুমি ভোল’  ‘আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা/নিশীথবেলা’ এগুলোকে আমরা বলি কবিতা। পার্থক্য কোথায়? সাহিত্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমার চোখে কোন পার্থক্য নেই। শ্রেণীবিন্যাস থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথের Song of offerings বা গীতাঞ্জলী এটা কি কোন গানের বই? এটা কি কোন কবিতার বই? কী বলবেন?


বব ডিলানকে সাহিত্ত্যে নোবেল দেয়ায় যারা ক্ষুব্ধ, যারা কেচ্ছার পর কেচ্ছা গেয়ে যাচ্ছেন আমি মনে করি তারা ঈর্ষায় ক্ষুব্ধ। তা নাহলে তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব যে সাহিত্যের সংজ্ঞা তাতে ব্যাপক গড়মিল আছে! রবীন্দ্রনাথকে যেবার সাহিত্ত্যে নোবেল দেয়া হল, দেশ বিদেশের সমালোচকরা ঈর্ষায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো। একদলের আপত্তির কারণ রবীন্দ্রনাথ ককেশীয় শ্বেতাঙ্গ নন, তিনি অনুন্নত প্রাচ্যদেশীয়, তাঁর নামও উচ্চারণ করা কঠিন। পরাধীন ভারতের একজন কবিকে এই পুরস্কার! ইংরেজদের অভিযোগ, টমাস হার্ডি থাকতে বৃটিশের পদানত ভারতের এক কবিকে বিশ্বের সেরা পুরস্কার দেয়া হলো কেন? ফ্রান্সের অভিযোগ,আনাতোল ফ্রাঁসের মত সেরা বা তার মত বিশ্ববরেণ্য ঔপন্যাসিককে সম্মানিত না করে একজন এশিয়ানকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্মান দান করা হলো কেন?


আলোচনা সমালোচনা থাকবেই। রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ করতে সমস্যা এটাও কি কোন সমালোচনার বিষয় হতে পারে!? সাহিত্যে নোবেল বলতে আমরা যা বুঝি, গল্প-কবিতা-উপন্যাস; ডিলান এসবে নেই। একাডেমির ট্র্যাডিশনাল ছকের অনেক বাইরে ডিলানের অবস্থান। ডিলান আরেক ঘরানার কথক; মৌখিক, গণমুখী। সঙ্গীতকে সাহিত্য বিবেচনায় এনে প্রথম নোবেল দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ফ্রেম ভাঙার সাহস তখন দেখিয়েছিল নোবেল কমিটি। সেটা ছিল শুরুর দিকের বিপ্লব। এরপর আবার সেই ছকে আটকে যায় কমিটি। বব ডিলানকে দিয়ে আবার প্রথা ভাঙল সুইডিশ একাডেমি।
ডিলানের গান যদি পাঠ করা হয় তবে হয়তো বলা যাবে– এ নোবেলের সঙ্গে যায় না, ওই মানটা পায়নি। কিন্তু গান তো পাঠের জন্য না, গাওয়ার জন্য। শব্দ ও সঙ্গীতকে উপলব্ধি করতে হবে সামগ্রিকতার মানদণ্ডে।
শুনলাম বব ডিলানের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নোবেল পাওয়া নিয়ে তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আশা করছি, বব ডিলান অভিমান অনুরাগ ভুলে  তাঁর যথার্থ প্রাপ্য এই বিশ্বসেরা  পুরষ্কার গ্রহণ করবেন। এবং সমালোচকদের একটা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবেন।