নানা কে নিয়ে লিখতে গেলে, লিখতে হবে এক ইতিহাস
এক সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের কাছে
যেমন অতীব বৃহত্তর সমুদ্রকে তুচ্ছ মনে হয়,
মহাকাশের দৈব তারকারাজির তুলনায়,
যেমন এক বিচ্ছিন্ন হয়ে পরা উল্কার পিন্ডকে কাণ্ণ্ডজ্ঞানহীন উদাসীনতা আখ্যায়িত করা যায়,
আগ্নেয়গিরির বিশাল লেলিহান লাভার সম্মুখে
যেমন তপ্ত আগুনের ঝলকানি নিছক খেলো ভাবেই উপলব্ধি করা যায়।
তেমনি,
নানাকে নিয়ে কোনও শব্দ চয়নের আগেও
ডুব দিতে হয় বিশাল চিন্তার গহ্বরে,
যেন শূন্যে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলেই,
কেবল এক অসাধারণ হৃদয়ের বৃহত্তম মনের
মানব সন্তানকে নিয়ে শব্দ ঝরবে;
যেন নীলের মাঝে ভেসে বেড়ানো যত
মেঘ রাশি রয়েছে তার প্রত্যেকটি বেড়িয়ে এলেই,
কিছুটা বোঝা যাবে এক অত্যন্ত সিক্ত মনের
গোছালো মানবিক সেই সত্তাটিকে।


সবার জন্যই যার হৃদয়ে ছিল অপরিসীম মমত্ব, ভালবাসা,
সবার জন্যই যার মনে ছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ দৈব দোয়া,
আর দেশের জন্য ছিল অগাধ ভালবাসা, অক্লান্ত পরিশ্রমে গাঁথা,
একেকটি শক্তিশালী প্রবন্ধমালা,
যার সৃষ্টি আজীবন অমলিন হয়ে রয়ে যাবে তার তপ্ত লেখার কালিতে।


জ্ঞানঅর্জনকেই সবচাইতে দিতেন গুরুত্ব,
প্রকৃত পড়াশুনার পরিবেশ বাসার আঙ্গিনায় বিচরণ করত,
প্রতিটা বিচরণক্ষেত্রকে আলোকিত করে রাখা হত,
নানাবিধ বই আর গবেষণার ছক কত,
সৃষ্টিশীলতা, খেলাধুলা, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার একাগ্র জগত যেন;
সবই অনেক প্রশংসনীয় হলেও নানার কাছে;
প্রতিটা ক্ষেত্রকে প্রকৃত ও মহিমান্বিত,
করার লক্ষে যে ধৈর্য আর অগাধ সত্য;
পদচারণার প্রয়োজন,
নানা তা সব সময় মনে করিয়ে দিতেন।


আমার কাছে আমার নানার উপস্থিতি এক বৃহত্তম বট বৃক্ষের মত,
যার একতিল ছায়া যেন একরাশ অদৃশ্যের হাত থেকে রক্ষা করত;
যার ঠাণ্ডা মেজাজে মাথায় হাত রেখে শুধু বলা "নানা, মন খারাপ করে না, নানা সব সময় ভাল থাকো"
এতটুকুর আড়ালে লুকিয়ে আছে অসীম স্নেহের আচ্ছাদন-জাল
যার সামান্য বক্তব্য ""নানা, দারুণ সুন্দর চিন্তা, একে লিপিবদ্ধ কর, বাহ!, খুব ভাল লেখা",
ছোটবেলা থেকে মুক্তার মত পবিত্র ছোট্ট ছোট্ট কথাগুলো আমার সারা জীবনের অনুপ্রেরণা।


শেষ বার যখন দেশ ছেঁড়ে আসছিলাম
নানা, তার সারা জীবনের লেখাগুলো সাজিয়ে লিপিবদ্ধ করে আমাকে দিল
বলল, "নানা, সব পড় সময় করে",
শেষ বার যখন দেশ ছেঁড়ে আসছিলাম
নানা অনেক গর্ব করে বলল "আমার, তোমার উপর অগাধ বিশ্বাস নানা,
তুমি এগিয়ে গেলে আমাকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে";
কথাগুলোর মর্মার্থ এখন যেন হাহাকার এর মত করে ধারালো সুঁচের মত ধেয়ে আসে,
হৃদয়ে, মস্তিষকে বিধে রক্তক্ষরণ করে,
হৃদপিন্ডকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে আবারও রক্ত সঞ্চালনা করতে বলে,
কেন এত আবেগময় হয়েছিলেন নানা ? আমাকে কি বোঝাতে চাচ্ছিলেন নানা?
কোনো কি গুরু-দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন?
নিজের ছবির পাশে আমার ছবিটি রাখা -যার থেকে বড় প্রশংসা,
অগাধ বিশ্বাস, দৃঢ় আস্থা,
আমার জন্য আর কিছুই হতে পারেনা;
এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা যে নানার ড্রয়িংরুমে,
নানার পড়ার টেবিলের সামনে,
পাবোনা নানাকে দেখতে;
আমার স্মৃতিতে শান্ত স্বভাবের মিষ্টভাসী নানা ঐ টেবিলে বসেই পড়াশূনা করতেন
নানুর বাসায় দৌড়ে উঠে ড্রয়িংরুমের দরজা খুলেই নানার হাসিমুখটাই আগে দেখা ,
নানার সেই আদুড়ে ডাক,
"নানা, এসেছিস?"
শেষ বার যখন দেশ ছেঁড়ে আসছিলাম
কেন জানি পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা একসাথে ছবি তুলি
নানার অনেক আনন্দ আর খুশি উত্ত্ত্সব মুখর করে রেখেছিল আমাদের সময়
কিন্তু চলে আসার সময় নানা কেন অনেক অনেক বেশি করছিলেন দোয়া
বারবার আমাকে বলছিলেন "নানা লেখালিখি বন্ধ করবেনা",
নানা কি কিছু অনুভব করছিলেন?        
নিজের চলে যাওয়ার সময় মনের অজান্তে আচ করতে পারছিলেন?                            
আমার এখন তো আর লিখতে ইচ্ছে করেনা,
অনেক উত্ত্তসাহ নিয়ে এসে নানাকে  দেখাতে পারব না-পড়াতে পারবোনা;
এই তীব্র কষ্টবোধ এর হাত থেকে
মুক্তি কিভাবে? মুক্তি কোথায়?
শিরদাঁড়ায় এক ভয়ংকর শূন্যতার অনুভব সমস্ত সত্তা শিরশির করে দেয়,
যেন প্রকাণ্ড এই পৃথিবীতে কোনও ভূকম্পন হয়ে যায়।


প্রতিটি প্রিয় মুখের হারিয়ে যাওয়া  
অকস্মাৎ মৃত্যু যেমন জীর্ণ শীর্ণ করে দেয় বেঁচে থাকা প্রতিটা সত্তাকে
ঠিক তেমনি নানার চলে যাওয়া স্তব্ধ,
শীতল, অসাড়, জীবনমৃত শূন্যতায় আচ্ছন্ন,
করে দিয়েছে আমাকে- আমাদেরকে
কোনও নির্ধারিত শব্দ গুচ্ছের ধারায় প্রকাশ করা যা একেবারেই অসম্ভব।


নানা-নানুর গোছালো বড় এক সংসারের
আবর্তেই আমরা সবাই আবর্তিত হতাম
প্রতি শুক্রবারের সেই পারিবারিক আড্ডা,
সবার সেই হাঁসি মাখা মুখগুলো আজ গোমড়া হয়ে
হেঁটে বেড়াচ্ছে এক চাঁপা অদৃশ্য কষ্টের ভাড় বয়ে নিয়ে
আর এভাবেই হেঁটে যেতে হবে যেন  জীবনের বাকি পুরোটা পথ
হায়! এই হাহাকার! এই শূন্যতা!


তবুও খোদার দরবারে হাত তুলে দোয়া করি
যেন পৃথিবীর জীবনে ছোট বড় সমস্ত ভুল তার ক্ষমা করে দেন
পরম করুণাময়,
যেন অসাধারণ এই মানুষটি তার প্রিয় মানুষগুলোর সান্নিধ্যে
কাটিয়ে দিতে পারে বার্যাখ এর সময়,
যেন পৃথিবীর ক্রান্তিকালে আবারও সবার দেখা হয়,
আর,
আমরা সবাই মিলে মিশে জান্নাতের সুবাতাসে আলোয়,
অবিচ্ছিন্ন পরিবারের মতই মিলিত হয়ে,
আজীবন কাঁটাতে পারি সেই অনন্তকালের সময়।


২৬শে সেপ্টেম্বর ২্০২্০
রাত  ৩:০০, মালায়শিয়া সময়