রোজ সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে শারীরিক কসরতে চোখের জল না মুছে বই খুলতে পারিনি। কাচারিঘর পালিয়েছি কত...বার, সারা দিনের নালিশের হিসেব গুলো চুকাত বলে---এখন আমি আর অবাধ্য নই মা, এখন আমি এমন সন্ধ্যা বার-বার চাই, খুব করে চাই, তুমি মারো , আরও মারো, তোমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করো ,তবু তোমার শাসনের ভার থেকে মুক্তি দিও না।


রাতে আরামের বিছানা ছেড়ে দিদির সাথে পাল্লা দিয়ে কখনও বসতে পারিনি টেবিলে, তাতে তুমি বকে কানে তব্দা ধরিয়েছ, পৌষের শীতে কনকনে ঠাণ্ডা জলের থেরাপি দিয়েছ মুখে—আমার ভবিষ্যৎ কে লক্ষ করে , মা এমন ভোর আমি হাজারটা চাই, তুমি বকে দাও, গালমন্দ দাও, তবু তোমার দায়িত্তের সীমা রেখা থেকে বঞ্চিত করোনা। আমি এখন পৌষের বরফ কাটা শীতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি অনুভূতিহীন অস্তিত্তে শালুর টুকরো জড়িয়ে।


তুমি যে ঘরটায় ঘুমাতে, আজও সেটা খালি পড়ে আছে, জীবনের প্রতি ঘৃনা অবহেলায় কোঠর হয়ে নিজের আত্মাকে ভুগিয়েছ আমরণ, বিছানার নিচে রুটিগুলো ভাঁজে ভাঁজে রেখেছ বলে—পিঁপড়েরা আনন্দে মিছিল দিত, রাতে পিঁপড়ের কামড়ে গুনগুন করে কাঁদতে , জানো মা ঘর জুড়ে আজ পিঁপড়েদের আনাগোনা আছে, শুধু তোমার কান্নার গুনগুন শব্দ নেই।


বন্ধুদের আড্ডায় যখন সবাই মায়ের গল্পে উচ্ছ্বাসিত হয়, আমার চোখ দু’টো তখন লুকিয়ে কাঁদে। আমার নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়ে আসে।মায়ার অপার সান্নিধ্যে নিঃসঙ্গতার নিসর্গে আমি হারিয়ে যাই।


জানো মা , তোমার হাতে বোনা শীতলপাটি  ওদের কাছে সস্তা, তাই  যত্রতত্র পড়ে আছে। যেখানটায় দাঁড়িয়ে মাঝরাতে পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড়, লাল আগুন দেখিয়েছিলে—বুঝতে পারিনি সেদিন জলের ধারে তোমার চিরদিনের ঘরকে তুমি ইঙ্গিত করেছ।
বারান্দার গ্রিলে চিবুক ঠেকিয়ে নিস্তব্ধ নগরীর আকাশে শূন্য চাঁদকে দেখে আমি ভাসতে থাকি, সাদা-কালো ফ্রেমের ভিতর দেখি বাবার নিরঝঞ্ঝাল  জীবনের সমস্ত দায়িত্ব,  একটা ভেলায় আগলে রেখেছিলে হাসির আড়ালে কষ্ট লুকিয়ে। মা আজ আমার ও একটা ভেলা হয়েছে।


তোমার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলিনি কখনও, কিশোর বয়সে ছত্রভঙ্গ জীবন কাটিয়ে, কর্মের তাগিদে ব্যস্ত করে দেয় সংসারী জীবন। সংগ্রামে চিত্ত বিসর্জনে স্বপ্নগুলোকে বইলে আঘাতে আঘাতে। আমার জগৎ জুড়ে অবসাদের বিষণ্ণ ছায়া , বিবর্ণ বলয়, তোমার শূন্যতায় অস্তিত্তে নোনা ধরা দেয়াল।


আমি প্রায় একটা স্বপ্ন দেখি গভীর রাতে। একটা স্বপ্ন বার-বার দেখি বিভিন্ন ভাবে। নিভৃতচারী তোমার পায়ের শব্দে আমার ঘুমভাঙ্গে –আমি তোমার পিছুপিছু যাই, একটা বাগান খুব সুন্দর, কিছুক্ষন পর বাবা আসেন,আমাকে মাঝখানে বসিয়ে  তোমাদের অসাড় দেহের ক্ষত চিহ্নগুলো, কষ্টের দাগগুলো দেখাও,  আমি আঘাত ভুলিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় ছটফট করি, আমার ঘুম ভাঙ্গে- ভেজা চোখের পাতায়।