গতকাল সন্ধ্যেয় যে ছেলেটার বাবা মারা গেল
ঘন্টাখানেক পরে সে আবছা শব্দে শুনতে পেল
কুলখানিতে কি আয়োজন হবে তা নিয়ে আলোচনা ।


চোখ মুছতে মুছতে কেবলমাত্র লাশটা কবরস্থ করে উঠল ছেলেটা
ছেলেটা?
কতইবা বয়স হবে ওর?
সতের,আঠারো কিংবা ঊনিশ
জাহাজের মাল ওঠা-নামার কাজ করে
কতইবা বেতন?
আট,নয় কিংবা দশ।


ওর হাতে লেগে থাকা কবরের মাটি পরিষ্কার করতে করতে
দূর সম্পর্কের এক চাচা বললেন "আগামীকালই বাজার-সদাই সেরে ফেল"।
আগ বাড়িয়ে তিনিসহ কয়েকজন পুরো সদায়ের লিষ্ট বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল।


ছেলেটা ওর বাবার জন্য একটু কাঁদতে চেয়েছিল
এখন ঘামছে,এতগুলো টাকা কিভাবে জোগাড় হবে?
এরপর ধার-কর্জ কিংবা ঋণ নেয়া।


কেউ একজন কাফনের কাপড় কিনে দিয়েছিল
সেই টাকাটা বেঁচে গেছে
নে- তোরা কাফনের কাপড়ের টাকা খা
পারলে কাফনের কাপড়টাই খা।


গতকাল সন্ধ্যেয় যে ছেলেটার বাবা মারা গেল
ছেলেটা?
কতইবা বয়স হবে ওর?
সতের,আঠারো কিংবা ঊনিশ
জাহাজের মাল ওঠা-নামার কাজ করে
কতইবা বেতন?
আট,নয় কিংবা দশ।


ওপাড়ার সেলিনার মা বলে,ছেলেটার বেতন কম তো কি হয়েছে
জাহাজে তেল চুরি কইরা ভালোই টাকা কামাই হয়
নে- তোরা চুরির টাকায় কুলখানি খা
নে- তোরা কাইল্যা তেল খা।


লিষ্ট হাতে ধরিয়ে দেয়ার পর সেই চাচাকে আর তেমন পাওয়া যায়নি
খুব ভোরে উঠে মাংসের দোকানে লাইন দেয়া
তপ্ত রোদে আলু- পেঁয়াজ আর ডেকরেটরের গামলা ঘাড়ে করে টেনেছে সদ্য পিতৃহারা ছেলেটা।
চোখের জলের সাথে ঘামের প্রতিযোগিতা হয়েছিল
তবু ছেলেটা সময় নিয়ে কাঁদতে পারেনি
সমাজ গোগ্রাসে গিলেছে,কাঁদতে দেয়নি।


বাবুর্চির রান্না যখন শেষের দিকে
এবার সেই লিষ্ট ধরিয়ে দেয়া চাচাকে পাওয়া গেল।
পুরো উঠোনটায় সামিয়ানা টানানো হয়েছে
সামিয়ানার আড়ালে উঠোন থেকে আর কবরটাও দেখা যায়না।
মানুষের পেছনে সামিয়ানা,সামিয়ানার পেছনে কবর
মানুষের সামনে আরও মানুষ,ডেকরেটরের প্লেট আর মাংসের গামলা।


এটা মরা বাড়ি নাকি ঈদ মিলনমেলা?
আত্মীয়দের মিলনমেলা। (অধিকাংশ-ই বিত্তবান)
আত্মীয়-স্বজনদের বাচ্চারা অনেকদিন বাদে একে অপরকে দেখেছে
তাদের সেকি আনন্দ? সেকি হুল্লোড়?
হয়ত অবুঝ ওরা ভাবছে আবার কবে একজন মরবে?
আবার কবে সবাই একত্রিত হয়ে হুল্লোড় পারবে?


খাবারের প্যান্ডেলেই নতুন কিছু আত্মীয়ের সাথে পরিচয়
এদের সাথে এই প্রথম-ই দেখা
আগে কখনও কথাও হয়নি বোধহয়।
কেউ কেউ হয়ত মৃত লোকটার নামটাও বলতে পারবেনা।


পাশের বাসার মনিরের মায়ের বোনের বাড়ির কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি
তাই ওরা অভিমান করেছে
ঘরের একজনও নাকি কুলখানি গিলবেনা।
অনেক হাত-পা ধরে মাফ-টাফ চেয়ে তাদেরকে খাওয়াতে বসানো হল
তারপর আর তাদের থামায় কে?
পরে জানা গেল,কয়েক প্লেট খাবার ঘরেও নিয়েছিল।


মহাসমারোহে আত্মীয়ের কাঙ্গালিভোজ শেষ হয়েছে
অথচ খালের ওপাড়ে একা বাস করা বৃদ্ধ রহিমার মা আজ হয়ত চুলোও জালাননি।
এরকম আরও কত রহিমার মা উপেক্ষিত।


ষাটোর্ধ একজন বলল,কি বাবুর্চি এনেছ  -হে!
নুনে হয়েছে কম।
আর একজন বলল, ঝালটা বেশি হয়েছে।


মধ্যবয়সী এক আত্মীয় উদরপূর্তি করে
১৯ বছরের বাপমরা ছেলেটার কাছে অভিযোগ জানালো
রান্নার এমন মান যে তেমন কিছুই সে খেতে পারেনি।
তোরা আর কি খাবি শুয়োরের বাচ্চা?
ছেলেটারে খা,মরহুমের লাশটাও খা।


যে ছেলেটার বাবা ওষুধের অভাবে মারা গেছে
এরা নুনে কম-ঝালে বেশি খাবার খেয়েও
সেই এতিম ছেলেটার খসাইয়াছে প্রায় ৯০ হাজার।


অথচ এই টাকায় সদ্য অভিভাবক হারানো পরিবারটার আগামী কয়েক মাস চলে যেত।
কিংবা সমাজ যদি এভাবে চেপে ধরে
কুলখানির আয়োজনের পরিবর্তে
চেপে ধরে বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটার চিকিৎসার আয়োজন করতে বাধ্য করত
ওষুধ কিনে দিতে বাধ্য করত।
হয়ত মানুষটাকে বাঁচানো যেত। (সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়)
এই সমাজের এহেন নিয়মের পশ্চাৎদেশে আমি থু দেই।


সেই আত্মীয়রা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে করে
খাবার নিয়ে গেছে
বাড়ির যারা আসেনি তাদের জন্য
এটাও নাকি নিয়ম,দিতেই হবে।


রাতে দেখা গেল ডেকরেটরের গেলাস উধাও ৩ টা, প্লেট ৮ খানা
দেও জরিমানা।
প্লেট কিংবা গেলাসের নয়
কুলখানি আয়োজনের জরিমানা।


জরিমানা চুকিয়ে দেয়ার পরের দিন
সেই মনিরের মা তিনটে প্লেট ফেরত দিয়েছে
বাকি কিছুই আর পাওয়াও যায়নি।


সব ব্যস্ততা শেষ করে ছেলেটা আজকের রাতে কাঁদবে বলে ঠিক করলো
রাতে জাহাজের মালিক টেলিফোনে জানালো চাকরি বাঁচাতে হলে আর্জেন্ট সকালেই রওয়ানা দিতে হবে।


জাহাজের চাকুরিতে যায় ছেলেটা
কয়েকদিন পরে বাড়ি থেকে ওর মায়ের ফোন আসে
ওপাশ থেকে মা বলে " ঘরে রান্নার চাল নেই,
আইজকা কিছু টাকা পাঠা বাপ!


কুলখানি; এক বর্বর রেওয়াজ  || তাওসিফ আকবর