*** বাদলা পুকুর আত্মকথা ***


----- তন্ময় দে বিশ্বাস ----


বাদলা পুকুর - মনে আছে তোর মোম ?
যার পাড়ে সেই ছাতিম গাছটার তলায় -
শ‍্যাতলা পড়া শানের সিঁড়ি, তুই আর আমি  -
পাশাপাশি বসে আগামীর ইতিহাস লিখতাম ?
তুই সাজাতিস নিজের মতো করে স্বপ্নের ইতিহাস ?
আমি খালি উল্টে পাল্টে দিতাম তোর জালবোনা !
মনে আছে ?


তুই খুব রেগে যেতিস, মুখখানা গম্ভীর
চেয়ে থাকতিস সেই ছাতিম গাছখানার মাথার দিকে ?
তুই বলতিস, আমাদের একটা ছোট্ট ঘর হবে -
সেই ঘরের দরজায় সামনে থাকবে
কামিনী, হাস্নুহানা আর চাঁপাফুলের গাছ,
আমি বলতাম, শুধু হাস্নুহানা কামিনী কেন ?
গোলাপ টা কি দোষ করল ?
মনে আছে ?


তুই বলতিস, কাজের ব‍্যস্ততার মাঝে
যদি গোলাপ গাছের কাঁটায় আটকে যায় শাড়ির আঁচল,
গোলাপ গুলোর পাপড়ি যদি ঝরে পড়ে -
গোলাপ টার কষ্ট হবে না?
আঁচল যদি ছিঁড়ে যায় ?
আমি বলতাম, যায় যাবে !
তালি মেরে নিবি শাড়ির আঁচল জুড়ে,
রঙবেরঙের তালি- বাউল দের ফতুয়ার মতো !
বেশ মানাবে তোকে - মোম বাউলি !
তুই মুখটাকে ছোট্ট করে জিভটা বের করে
কেমন সেই ভেঙচি কাটতিস ?
মনে পড়ে ?


শানের ঘাটের সিঁড়িতে লোহার পেরেক দিয়ে দাগ কেটে
তোর নাম লিখেছিলিস তুই,
আমি হাত রেখেছিলাম তোর হাতের ওপর, শক্ত করে
সেই দাগটা এখনো আছে‌,
তার চারপাশে শ‍্যাওলা জমে তোর নামটা
কেমন যেন জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে,
তোর মনে আছে ?


আমি তোর নাম দিয়েছিলাম- মোম
মোমের মতো মসৃন ছিলো তোর হাত বুক গলা মুখ,
তুই আমাকে ডাকতিস, বাতি বলে,
খুব রোগা, লম্বা ছিলাম তো, তাই
মনে পড়ে মোম ?


তুই বলে ছিলিস, আমরা মোমবাতি হবো
আমাদের মুখে জ্বলবে ভালোবাসা আর সুখের আগুন -
সেই আগুনের উত্তাপে গলে গলে তুই -
জড়িয়ে ধরবি আমাকে, আরো নিবিড়ভাবে,
আমার শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবি তুই
কেউ আলাদা করতে পারবেনা আমাদের,
আলাদা হবার আগেই, বিচ্ছেদের আগেই আমরা-
হারাবো আমাদের অস্তিত্ব ,
মনে পড়ে ?


একবার, দুর্গা অষ্টমীর দিন সন্ধ্যায়
তোকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম,
ঠাকুর দেখতে তো নয়, তোর হাত ধরে পথ হাঁটতে,
তোর পরনে ছিল লাল তাঁতের শাড়ি,
আমার লাল পাঞ্জাবী,
পাজামা টা ঠ‍্যাংঠ‍্যাং করছিলো,
তোর সেই কি হাসি,
বলেছিলি, নাভির নীচে নামিয়ে পর গেঁয়ো ভুত।
বেড়ার দিকে মুখ করে ,
নামিয়ে, ঝুলিয়ে পরেছিলাম পাজামা,
জগুবাজার থেকে রাসবিহারী পর্যন্ত
ট্রামলাইন ধরে হেঁটেছিলাম দুজনে,
আমার হাতের মধ্যে ধরা ছিল তোর নরম হাত,
একবার ও ছাড়িনি,
মনে পড়ে ?

সারা রাস্তা জুড়ে রঙিন আলোর আলোকসজ্জা,
লাল নীল আলোর প্রতিচ্ছবি তোর চোখের তারায়,
জ্বলজ্বল করছে তোর দুটো চোখ, চিকচিক করছে,
ল‍্যাম্প পোষ্টের নিয়ন আলোয়
ঝকমক করছে তোর লাল শাড়ি, গলা ঘাড় খোঁপা,
আমি বলেছিলাম, তোকে চাঁদের মতো লাগছে,
মনে হচ্ছে চাঁদ আকাশ থেকে নেমে
ধরা দিয়েছে আমার হাতে,
তোর পাশে আমাকে খুব বেমানান লাগছিলো,
বলেওছিলাম তোকে,
তুই বলেছিলিস, তোকে যদি চাঁদ মনে হয়,
আমি তবে সেই চাঁদের কলঙ্ক,
কলঙ্ক ছাড়া চাঁদকে মানায়না,
কলঙ্ক ই নাকি চাঁদের গর্ব, অহংকার,
মনে পড়ে ?


এখনো যখন তোর কথা মনে পড়ে -
বুকটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে তোর জন্যে -
ছুটে যাই সেই বাদলা পুকুরের শানের সিঁড়িতে,
তোর নামটার ওপর হাত বুলোই,
বিশ্বাস কর, তোকে ছুঁতে পারি আমি,
মনে হয় তোর হাত ধরে যেন আবার আমি
ছুঁয়ে চলেছি তোকে, তোর দাগে দাগ মিলিয়ে -
তোর হাতে হাত মিলিয়ে, আমার মোম ছুঁয়ে,
বিশ্বাস কর,


আমাকে ছেড়ে চলে গেলি তুই,
নব পরিনীতা হয়ে, স্বর্ণ সালঙ্কারা হয়ে, নববধূ সাজে,
যাবার সময় খুঁজেছিলিস আমায় ?
সানাইয়ের আওয়াজ কানে এসে বলছিলো বারবার-
সে নাই - সে নাই - সে নাই-
আমি দূর থেকে দেখছিলাম তোর চির প্রস্থান,
অপরূপা দেবীসাজে সেজেছিলিস তুই,
মনে পড়ে মোম ?


তোর শরীরে লাগেনা মোম ?
সোনার অলংকারের রুক্ষ ধারালো প্রান্ত-
কেটে কেটে দাগ বসে যায়না তোর পেলব গলায় বুকে?
ধাতব ঝনঝনানি শব্দে ঝালাপালা করেনা তোর কান ?
তোর কষ্ট হয়না মোম ?
তোকে ফুলের সাজেই ভালো মানাতো মোম,
গলায় জুঁই রজনীগন্ধা, গোলাপের মালা,
বাহুমূলে , কব্জিতে সাদা বেলফুলের অলংকার,
তুই যে ফুলের মতোই নরম রে মোম ?
তুই বুঝতে পারিস না ?।


আজ তুই হয়তো অনেক বিলাসী,
সুসজ্জিত প্রাসাদের মহীয়সী লীলাবতী রানী,
কিছুই অপ্রাপ‍্য নেই , সব সাধ হয়েছে পূরণ,
সুখপাখিটাকে ধরতে পেরেছিস মোম ?
যদি পেরে থাকিস, তাহলে তুই জিতে গেছিস,
আমার মতো হাড়হাভাতের হাত থেকে বেঁচে গেছিস,
আমি আজও সেই অস্তিত্বের সন্ধানে ঘুরছি,
তোর চোখ দিয়ে দেখানো সেই মোমবাতির অস্তিত্ব,
মোম ছাড়া যে বাতির কোনো অস্তিত্ব থাকেনা মোম,
তাই আজও আমি অস্তিত্ব সঙ্কটে,
তবুও আমি বেঁচে আছি মোম,
আশা বুকে বেঁধে, বাদলা পুকুর কে সঙ্গী করে,
স্বপ্ন গেঁথে, শ‍্যাতলা পড়া সিঁড়ি, দাগ বুকে করে,
বাদলা পুকুর যে আজো তোকে খোঁজে মোম !!!