*** এক ছেলেধরার কাহিনী***


--- তন্ময় দে বিশ্বাস ----


উত্তর প্রদেশের এক প্রত‍্যন্ত গ্রাম।
এখানেই ফতেমার মামার বাড়ি,
খুব সাদামাটা মেয়ে ফতেমা,
ছোট বয়েসে আব্বু আম্মা কে হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ।
মামা আসগার এর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।
বাড়ি বাড়ি ভাঙা ছাতা সারিয়ে দিন চলে তার।
সারাবছর তো আর কেউ ছাতা সারায় না,
তাই বর্ষা কালেই একটু স্বচ্ছলতা আসে ফতেমার মামার বাড়িতে।
বাকি দিনগুলো ভ‍্যান রিক্সা চালিয়ে যৎসামান্য আয় করেন মামা।
মামী মানুষ টা খুব ভালো।
নিজের একটা ছেলে, সাকিব।
ফতেমার থেকে বছর চারেকের ছোটো।
ফতেমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসা দিয়ে সেই ছোট্ট থেকে বড়ো করে তুলেছেন মামী।
এখন ফতেমার আঠারো বছর বয়স।


নিজের সঞ্চয় বলে তেমন কিছু নেই আসগারের।
তাই, এর তার বাড়ি থেকে কিছু সাহায্য চেয়ে
ফতেমার একটা শাদী দিতে চায় আসগার।


স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথা মনে প্রাণে খুব বিশ্বাস করে আসগার। সেটা হলো,
"কোনো ভালো কাজে অর্থ কোনোদিন প্রতিবন্ধক বা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।"

তাই মনে ভরসা নিয়ে পরিচিত সকলকে মনের কথাটা জানায় আসগার।
তার বড্ড আদরের ভাগ্নী। খুব দুঃখী মেয়ে।
হাজার অভাবের মধ‍্যেও দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়েছে ফতেমা কে। কিন্তু অভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত ফাইনাল পরীক্ষা টা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। সেজন্য একটা চাপা অপরাধ বোধ আজও জেগে আছে আসগারের বুকে।
তাই একটা ভালো ছেলে দেখে ফতেমার শাদী টা দিতে পারলে বুকের ভারটা হয়তো একটু কমবে আসগারের।


অবশেষে সেই দিনটি এলো।
আজ ফতেমার শাদী।
পাশের গ্রামের রহমান চাচার ছেলে ফারহান। তার হাতেই ফতেমাকে তুলে দেবে ফতেমার মামা ও মামী।
ফারহান পেশায় রাজমিস্ত্রি। রোজগার মোটামুটি খারাপ নয়। কিছু চাষের জমি জায়গাও আছে।


সবকিছু ভালোভাবেই মিটে গেল। শুভক্ষণে ফতেমা কে নিকাহ করে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেল ফারহান।


বেশ আনন্দে কাটলো একটা বছর। ফতেমার কোলজুড়ে জন্ম নিলো এক শিশু পুত্র।
দেখতে যেন দেবশিশু।
ফতেমা বা ফারহানের কোলে এমন সুন্দর ছেলে দেখে সবাই বলতে লাগলো--
আল্লাহর দোয়ায় কোনো রসুল বা নবী
পৃথিবীতে এসেছে ফতেমার পুত্র হয়ে।
সবাই তার নাম রাখলো আমির।
সকলের চোখের মনি হয়ে উঠলো ফতেমা ফারহানের পুত্র আমির।
বুকের শিশু আমির কে নিয়ে ফতেমা ফারহানের ছোট্ট ঘরটা যেন আলোয় ভরে উঠলো।


হঠাৎ একদিন সেই দিনটি এলো।
শহরে একটা বহুতল বাড়ি তৈরির কাজে
রোজ ভোরের গাড়িতে শহরে যেতে হয় ফারহান কে।
আজও রোজকার মতো ভোরবেলা শহরে গেছে ফারহান,
ফতেমার মাঝরাত থেকে উঠে দুপুরের খাবার তৈরী করে
ঝোলনায় ভরে দিয়েছে ফারহানের হাতে,
কিন্তু সকাল থেকেই কেমন যেন মনটা ছটফটে করছে ফতেমার,
আমির ও সকাল থেকে শুধু কাঁদছে,
অন‍্যদিন তো ওকে খাইয়ে সংসারের কতো কাজ সামলাতে হয় ফাতেমা কে,
ছোট্ট আমির তো দড়ির দোলনায় শুয়ে দুলতে দুলতে নিজের মনে হাত পা ছুঁড়ে খেলে হাসে ,
আজ যেন ওকে কান্নায় পেয়েছে,
বেশ বার কতক কাছে টেনে বুকের দুধ দিয়ে ওকে ভোলাতে চেষ্টা করেছে ফতেমা।
কিন্তু কিছুতেই কান্না থামছে না আমিরের,


হঠাৎ সেই খবরটা এলো,
পাশের বাড়ির নিয়ামত চাচা ছুটতে ছুটতে এসে
ফতেমার মামীকে বললো- শহর থেকে ফোন এসেছিল,
কাজ করতে করতে, পা হড়কে দশতলার ভারা থেকে নীচে পড়ে গেছে ফারহান-
কথাটা শুনেই আর্তনাদ করে উঠলো ফতেমার মামী।
ছুটে এসে ফতেমা দাঁড়াতেই সব জানতে পারলো,
আর তখনই পাগলের মতো
ছোট্ট আমির কে কোলে নিয়ে
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে আরম্ভ করলো
শহরে যাবার বাস রাস্তার দিকে-


শহরে যাবার পাকা রাস্তা ফতেমা দের গ্রাম ছাড়িয়ে
আরো দু তিনটে গ্রাম পেরিয়ে,
দিগ্বিদিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে
মাঠ ঘাট পেরিয়ে
বন জঙ্গল মাড়িয়ে
ছোট্ট আমির কে বুকে জড়িয়ে
ছুটে চলেছে ফতেমা-
তার ফারহান হয়তো এখনো বেঁচে আছে,
একবার শেষবারের মতো হয়তো খুঁজছে
আমির কে, ফতেমা কে,
পাগলের মতো ছুটে চলেছে ফতেমা--


হঠাৎ কোনো এক গ্রাম থেকে কে বা কারা
চেঁচিয়ে উঠলো--- ছেলেধরা, ছেলেধরা,


আর তখনই ফতেমা কে দেখে শয়ে শয়ে
মানুষ তাড়া করতে লাগলো ফতেমা কে।


ফতেমার কোনো দিকে নজর নেই
তার মন পড়ে আছে বাস রাস্তায়, শহরে
সেখানে ফারহান তাকে খুঁজছে,


উন্মত্ত জনতা ঘিরে ফেললো ফতেমা কে
কেউ কেউ বললো - এই তো ছেলেধরা,
কোলের আমিরকে দেখে বললো--
-- দেখো, দেখো সবাই। কোন ধনীর ঘরের ছেলে চুরি করে পালাচ্ছে ।
ওকে মারো, ওকে মারো, বাচ্ছাটাকে কেড়ছ নাও।
এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়েছে ফতেমা,
সে আমিরকে বুকে চেপে ধরে বললো---
এটা আমির, আমার সন্তান, আমার ছেলে।


জনতার কানে তার কথা পোঁছালো না,
সবাই জোর করে ফতেমা র বুক থেকে ছোট্ট আমির কে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করলো।
মাটিতে পড়ে সবার পায়ে ধরে ফতেমা বলতে লাগলো--
---আমি ছেলেধরা নই,
--- আমি ফতেমা, এটা আমার ছেলে, আমার আমির।


কেউ শুনলো না ফতেমার কথা।
কেউ বিশ্বাস করলোনা ফতেমার কথা।
এমন একটা মেয়ের এতো সুন্দর ছেলে হতেই পারে না।
সবাই বুক থেকে ছিনিয়ে নিলো আমির কে,
প্রচন্ড মারধোর শুরু করলো ফতেমা কে,
ছেলেধরা একটা মেয়েকে হাতেনাতে ধরেছে বীর পুঙ্গবের দল।
যে যেমন ভাবে পারলো ফতেমার শরীর টাকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে, আধমরা করে মাটিতে ফেলে, আমিরকে নিয়ে চলে গেল।


সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অস্তাচলের পথে,
চারিদিকে সন্ধ্যার আবছায়া নেমে আসছে
অবশেষ পুলিশ এসেছে,
জনতার হাতেনাতে ধরা ছেলেধরা বমাল ধরা পড়েছে,
থানায় জমা পড়েছে এক দুগ্ধপোষ্য শিশু,
পুলিশের পায়ের কাছে মৃতপ্রায় ছেলেধরা - ফতেমা,
ছেলেধরা মৃত‍্যুপথযাত্রীর কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তরেখা,
ক্ষতবিক্ষত ছিন্নবসন উলঙ্গপ্রায় নারীর স্তনবৃন্ত থেকে ঝরে পড়ছে মাতৃদুগ্ধধারা।