যোজন দূরত্বের নক্ষত্র এক , নিঃসঙ্গ বলয়- বৃত্ত পথিক


"কি চাচ্ছো ?"


"চাওয়ার কথা উঠছে কেন?"


"কারণ চাওয়া পাওয়ার বাইরে কখনো কিছু ঘটছে না। ঘটবে না।"


"মুশকিলে ফেললে। এভাবে ভাবলে তো সমস্যা।"


"সমস্যাই বটে। ঘোরতর সমস্যা।"


খুব স্বল্পাহারী মানুষেরও ক্ষুধা নিবৃত্ত হতে মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন। মৃদুল আগে কবিতার পাতায় মনোনিবেশ করতেন, আরজুকে ভুলে হয়তো আরজুকে নিয়েই। তিনি আজকাল স্থান ত্যাগ করেন, বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান। তার ফিরে আসবার বিলম্বের সাথে যুক্ত হয় আরো অন্য সব কারণ , তার উদাসীনতার সাথে যুক্ত হয় ক্ষুদ্র আরো শত অপমানবোধ। মানুষের ক্ষুধার জগৎ রহস্যজনকভাবে গদ্যময়, সেখানে নজরদারী, খবরদারী কিছুই মাত্রাতিরিক্ত চলেনা, উচিতও নয়।


স্নান সেরে যখন আরজু খোলা চুলে যখন কাপড় গুলো গুছোতে থাকেন, তার চুলে সূর্যালোক ঠিকরে পড়ে, হয়তো কালকের চাইতেও বেশি কড়া আঁচে , অথচ আরো বেশি নীরব কোমলতা নিয়ে। সেখানেও হয়তো শিল্পের অপমানবোধ মৃদুলের চোখ অন্যদিকে সরিয়ে দেয়। পরস্পরের জন্য তারা নিরুত্তাপ হয়ে ওঠেন, নিজস্ব বলয়ে ঘূর্ণনরত দুটো সত্তা হয়ে ওঠেন তারা আরো নীরব সরবতায়।


যে কালের যে কাহন।


রাতের বেলা ঔষধ পর্বের নাম নিয়ে সে আরেক যন্ত্রনা। যখন জীবনের ছন্দ মঙ্গলবারের দাপট নিয়ে শুক্রবারে আছড়ে পড়ে, তখন কেউ কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় দিনশেষে , জীবন তাদের আসলেই ক্ষমা করেনি, বিবিধ রঙের বিভিন্ন মাত্রার ঔষধে। গোলাপী, নীলচে, হলদে কষ্টের রকমফের। দুঃখদিনের পরাকাষ্ঠা !


রাতে পাশাপাশি শুয়ে আরজু শোনেন মৃদুলের ঘুমের ভেতর নাক ডাকবার ক্লান্ত আওয়াজে তার আরেকটি ঘুমের বড়ির বিপদ সংকেত। হয়তো তার অব্যবহিত পূর্বেই, মৃদুল ক্লান্তি চাপছিলেন আরজুর সুতি শাড়ীর খসখসে শব্দে, চুড়ির টুংটাং আওয়াজে। ব্রতকথায় সশব্দ চিহ্ন , জ্যোতির্ময় এক কথায় প্রকাশ, শুধু ভাব সম্প্রসারণের মত কঠিন কাজে তারা দুজনেই সমান অপারগ।


আর তখন আমায় কেবলই পেয়ে বসে খোলা জানালার ওপাশে আসন্ন ঝড়ের ঘোর আচ্ছন্নতায় মগ্ন পৃথিবীর চালচিত্রে। কেউ ভুলে বসবাস করে, কেউ ভুলতে চেয়ে। অন্ধ গ্রন্থিকের আয়ুষ্মান এই ঝোড়ো পৃথিবীর মগ্নকাল। সুন্দরের সকল নীরব বোধে সৌন্দর্যের।


সংসারের নৈমিত্তিকতায় আরাধ্য সপ্তসুর


প্রতিটি দিন অন্যদিনের, অন্যমনের। যা যা দিয়ে বর্তমানকে পুরোপুরি সাজানো সম্ভব, তা সব থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরি বর্তমানে অভিনিবেশ করা সম্ভব হয়না কেন কে জানে! যদিও বা সে অভ্যাসে বেশ কিছু অভিযোগের সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ! মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভেতর শিথিল হয়ে আসা জীবনের রং, ফিকে আর চালসে পড়ে যাওয়া চোখের মত ঝাপসা।


আরজুর প্রতিটি দিন অনেকই নিরুত্তাপ, সাধারণ আর আটপৌঢ়ে তার বিশদ, প্রতিদিনের চোখের আড়ালে গুল্ম লতার বেড়ে ওঠবার মতনই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মাঝে মাঝে খুঁটিনাটি আনন্দ, আলোড়ন ,জাগতিক জীবনের হৃদস্পন্দনের মতন ঠেকে বটে , তবে তা অনেক রহস্যময় আর আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে সেসব দিন, যেসব দিনে বাড়ীর চিঠি আসে। মানুষ যে চিঠি পড়তে ভালোবাসে এখনো, এটিই কি যথেষ্ট নয়?


চিঠি আসে ছোটবোনের, মা বেশ অসুস্থ, চিঠি লিখতে তাঁর কষ্টের কথা থাকে, আর থাকে মানিয়ে গুছিয়ে চলবার জন্য তাঁর মৌখিক কিছু পরামর্শ। যেকোন মায়েদের মতন , তবে ভীষণ ভাবে আরজুর চেনা , যা তার একান্ত, আপন গন্ডীর। তিনি কখনো বলেননি আপদের কথা, তিনি বলতেন মুক্তি আসে মিলে এবং মিলিয়ে দেবার আনন্দের মধ্যে। প্রাত্যহিকের অতুল বৈভবই বৃহত্তর মুক্তি।


অরুর চিঠি গুলো চাপা, সংক্ষিপ্ত এবং জরুরী ভিত্তিতে লেখা, সব চিঠিরই সুর একইভাবে চেনা যায়। আরজুর এই ছোট বোনটি কখনোই স্বীকার করেনি যা, তা আরজুর জানা। সে আজও বাবার মৃত্যুকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠোন থাকে বিশাল, আকাশ থাকে বৃত্তাবদ্ধ, হারিয়ে যাওয়া একেকটা শূন্যতা যে ফোঁকর সৃষ্টি করে, তাকে হয়তো চিঠির ভাষা পুরোপুরি ঢাকতে পারেনা, ঢাকতে চাওয়ার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা গুলো কোথাও নিজেদেরই কুড়োতে থাকে , নির্লিপ্ত, শান্ত, নেভা দিনের গল্পের মতন। অনেক প্রতীক্ষার পর সেদিন মায়ের ছোট একটা চিঠি এলো, অরুর সঙ্গে।


"আরজু, তোর শরীর কেমন আছে? ইদানিং তোকে বেশ মন মরা লাগে। সংসারে মানিয়ে নেয়াটা অনেক দরকারী , জামাইকে বুঝতে চেষ্টা করবি। আমার শরীরটা খারাপই যাচ্ছে আজকাল। আমি আর ক'দিন , আমাকে দেখতে আসবি না?"


খুব ছোট একেকটা অক্ষর। খুব চেনা অনুরোধ, চেনা স্বরের মতন । শুধু বলা যায়না , অক্ষরগুলো চোখে জল আনে কেন এখনো, চোখের কোনের জল তো এতদিনে শুকিয়ে যাওয়া উচিত! শুধু বলা যায়নি সেসব কথা। অসুস্থতাও একটা প্রকান্ড ভার, অহেতুক বোঝা বাড়ানোর দায় মায়ের জন্য সে সাব্যস্ত করতে পারেনি, তাই উত্তরটা এখনো দেয়া বাকি। মায়ের কথা মনে হলেই চোখে একটা ছবি ভাসে , শীতের দিন মা পুলি পিঠে জোগাড় করছেন, সবাই মিলে সেই পিঠের নারকোল পুরে হাত লাগাচ্ছে , এলাহী কারবার ! সংসারের নৈমিত্তিকতায় আরাধ্য সপ্তসুর , এক অভূতপূর্ব অনুভব।


মৃদুল আজকাল বেশ গাছের পরিচর্যা করছেন। টানা বারান্দায় বেশ ক'টি ফুলের গাছ। ক'দিন পরেই ফুল ফুটতে শুরু করবে , বর্ণে, সৌন্দর্যে, আলোতে। সেপর্যন্ত অপেক্ষা করতে তার মন্দ লাগেনা। কখনো কখনো অপেক্ষায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ , উচ্চতার কায়া অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে , সেখানে অপেক্ষার শান্তিটাই মুখ্য। তোমার হৃদয় চেনা সূরে বাজে,মৃত্তিকার মায়ায়। মাটির এমনি জোর, দেশে দেশে, দশে দশে।


চোখের আলো, যেখানে আলোক জগৎময়।


তোমার সন্ধ্যায় আমার পাখীরা কুলায় ফেরে, তবু বিহঙ্গ


এমনিতেই মনে পড়ে


বুনতে গিয়ে ভালোবাসা এমনি করেই পড়ে


কেউ কারু নয়, ছন্দ-দ্বন্দ্ব, এমনি দিনের খেলা


আকাশ কালো , মেঘের দলও , নীলচে রঙের ভেলা।


সালাহ বাড়ী ফিরছিলো। সন্ধ্যের মুখে দীর্ঘ ছায়াকে সঙ্গী করে বাড়ী ফেরবার মধ্যে একধরণের শূন্যতা আছে। ভীড়ের মধ্যে একাকী একজন, শত পথচারীর ব্যস্ততার মধ্যে মগ্ন সন্ধ্যার আলোছায়া। মাত্র অস্ত যাওয়া সূর্যের সংবাদ সেই আলোছায়ার প্রহরে। অথবা হয়তো কবিতাকে সাজিয়ে বলা , আগামী সূর্যোদয়ের সংবাদও। কবির সাফল্য তো সেখানেই , সোনালী রঙের সাজকে অনুভূতির দুয়ারে পৌঁছে দেয়া। অস্তগামী সূর্যের গৌরবও সেখানে সত্যি কথা বলে , আরেকটি সত্যি সূর্যোদয়ের জন্য।


সালাহ এর মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষের জন্য জীবনের খুঁটিনাটি উপাদান ছড়ানো থাকে। হেঁটে যাওয়া রাস্তাতে খোলা চুলের সুন্দরীরা, ফুটপাতের ফুচকা নিয়ে ফুচকাওয়ালা, অথবা নীলক্ষেতের মোড়ে সারি সারি বইয়ের দোকান নিয়ে দোকানদারেরা। বেঁচে থাকবার সৌন্দর্য মুক্তিতে , খোলা হাওয়ায় আর অনবরত গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসে , যখন জীবনের সবকিছু বেঁচে থাকবার বিপরীতে চলে যায়।


সাধারণ জীবনের খুচরো কথকতার মান খুচরো পয়সার মতো। দুই পয়সার আলতা।


যা জীবনের সমান্তরালে ক্রমাগতভাবে অতিবাহিত হতে থাকে, তা স্রষ্টার নিজ হাতে দেয়া সময়ে মানুষের অন্তহীন সমস্যার জীবন। একেকটি আরেকটির থেকে জটিল, বহুমুখীভাবে, ভারাক্রান্ত নিজের নিজের কষ্টে।


অশ্রুপাতের একটা স্বাভাবিক পরিণতি আছে, ক্রমাগত বৃষ্টির ফোঁটা যেমন তপ্ত মাটিকে ঠান্ডা করে তোলে , তেমনি চাপা কান্নার সময়গুলো নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে , নিজেকে তেমন খাপছাড়া আর অস্বাভাবিক মনে হয়না। বহ্নিশিখার দাহ্য যন্ত্রনা, মধ্যবিত্ত স্বপ্নের আকাশ ছোঁবার গল্প।


একটা গ্রামীণ চেকের কভার সহ বালিশের ওপর কতগুলো জলের ফোঁটা পড়লে সেই স্বপ্নের আধুনিক সত্যিটা সত্যি হয়ে ওঠে, তা কারো জানা নেই, আসলেই। মানুষের জীবন সুরে সাধা, কান্নার সুরেও থাকে সেইসব স্বপ্নের রং, স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায়।


প্রতিটি ক্রন্দন মানুষের স্থিতির সময় , জানালা দিয়ে দোয়েল পাখিকে দেখবার সময় ভেতরের ফাঁকা অনুভূতির মতই, অন্তহীন এক শূন্যতার মত।  


অন্ধকারে আলোর শিক্ষা অনেকসময় এক ফুঁয়ে নিভিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে , অনুভবের সহজ - কঠিনে জীবনের ঘোরপ্যাঁচ এমনি জটিল। বুনো একটা অন্ধ রাগ নিজেকে প্রায় অন্ধ করে ফেলে, আমি না বলতে শিখি , আমি সকল হ্যাঁ বোধক অর্থের না হয়ে উঠতে থাকি। যে অন্ধ চক্ষুর জন্য সত্যি একটি শতদ্রু নদীর প্রয়োজন।


তবে আপাতত আমার কথা থাক। জগৎসংসার যখন চতুষ্কোন হয়ে ওঠে , তখন সে চতুষ্কোণে আসলেই একটি ক্ষুদ্র বর্গাকৃতি আকাশেরই প্রয়োজন, শ্বাস নিয়ে আবার স্বাভাবিক হবার জন্য। দ্বিতীয় চেষ্টাগুলোও অর্থবোধক , সালাহ যখন প্রয়োজনের খাতিরেই কোথাও ওই আকাশের নীচেই অসংখ্য মানুষের একজন।


তীব্র জলপ্রপাতের পতনের শব্দ থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অশুভ সংকেতকে যখন আলাদা করা যায়না , তখনও মানুষ মানুষের জন্য বাঁচে ,পরিবারের জন্য , বহির্বিশ্বের জন্য। তার সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে , তার সীমাহীন অসংগতি নিয়েও। সাদা-কালো বস্ত্রাবৃত মুহূর্তের ধূসর অক্ষরের কথন।


যুঝতে থাকা দাহকাল, বিরহের উন্মেষে উন্মাতাল।


ঘুমের ভেতর আরজু মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে আজকাল , ঘুমের ঔষধে কাজ হচ্ছেনা তেমন। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আবার ঘুমোতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায় , নিস্তব্ধ শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই মনে হতে থাকে ক্রমশ: দূরত্বে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মৃদুলের কথা। আশা করা যায় , পাশের ঘরে মৃদুল তার মত রাত জেগে একাকী বসে নেই। যে জীবন একাকী যুঝবার, তাতে যুগলবন্দী স্বপ্ন বুনে লাভ নেই। অনুভূতির তীব্রতা অনেক সময় স্বার্থপর হতে শেখায় , একলা হয়ে যাওয়া ভুবন জুড়ে জ্বলতে নিভতে থাকে জোনাক আলোর মত সেইসব প্রচ্ছন্ন নিজস্ব সময়। যাকে খুব বেশী একলা করে চাইতে গেলে বিপদ বৈকি !


ধীরে ধীরে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালে , রাস্তার যে আলো আরজুর গালের ওপরে এসে পড়ে, সে আলোয় তাকে ঠিক ভুতে পাওয়া কোনো অতীত বিভ্রম মনে হতে থাকে । একটা নিঃসঙ্গ পথচারী একলা হনহন করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই ভয়াবহ ক্লান্তি এসে ভর করে আরজুর সমস্ত শরীর জুড়ে। সকল নিমিত্তে সেই প্রশ্নের সুরটাই বাজছে যেন চিরকালের সত্য হয়ে, সাতকাহনের নকশী বুনন, আমায় চেনো কি ? কি উত্তর তার, জানা যে নেই মোটে !


এই আকাশ গুছিয়ে স্বপ্ন বোনা হয়না, ঠিক কতকাল ? আজীবনের এই এলোমেলো দিগন্তজোড়া আকাশের ক্ষ্যাপামি আর কতকাল চলবে?


আমাদের না হয়ে ওঠা আমাদের কোথাও পৌঁছে দেয়। পর্বতচূড়োয়,আনন্দের শিখরে, আরাধ্য সময়ের প্রগতিতে , প্রবল চেষ্টার পরবর্তী ধাপে। আমি পতনের সংকেত শুনি, চেনা অংশে, অস্বস্তি বোধ করতে থাকি, এবং পরিণত বোধের সকল জলপ্রপাতের শব্দ শুনতে থাকি। যা আমাদের, আমার ভেতর, আমাকে নিয়ে আমাদের গল্প হয়ে ওঠবার মাহেন্দ্রক্ষণ।