পুরনারী, পুনশ্চে একটি নিরীক্ষামূলক আখ্যান, যা মানব চরিত্রের সম্পর্কগুলোকে আপাত সরলতার সাথে অনুভব করে, কিছু কিছু সংবেদনশীল টানাপোড়েনের ভেতর।


অনুভূতির ঝুমকোতে চমকে ওঠে ক্ষণিক কোনো সুর :


"তোমার কি শেষ হলো?" কানের কাছে মৃদু কণ্ঠস্বর, মৃদুলের।


আরজু ফিরে তাকালেন। ডালের সম্ভার দেবার মুহূর্তটি অনেকটাই জোরালো কোনো ঝগড়াটে সময়ের মত। তেলের মধ্যে শুকনো মরিচ আর জিরের ফোঁড়ন পুরো রোষে ফুঁসতে থাকে সম্ভাব্য ও অসম্ভব সকল অসুবিধের মধ্যে। যা অনেকটা তারই মতো। আরজু এই মুহূর্তে মৃদুলের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করতে পারেন, তীর্যক কোনো মন্তব্যও করে বসতে পারেন। তবে সব মিলিয়ে তিনিও ডালের বাটিটির মতোই উদার এবং বাধ্য। পরিস্থিতি তাকে এর চাইতে খোলাসা করবার অনুমতি দেয়নি।


"কি বলছো? কিছু দরকার?" আরজু পাল্টা প্রশ্ন করলেন।


"আজ মেনু কি?" ঝটপট উত্তর , প্রশ্নতে।


"এই তো, রাঁধছি।" আরজু উত্তর দিলেন। তার উত্তরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একধরণের শীতলতার আভাস খুব স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। তবে এটিও তিনি স্পষ্ট জানেন, এসবের বিন্দু মাত্র মৃদুলকে এখন চিন্তিত করবে না , বিচলিত হওয়া তো দূরে থাক। অভ্যাস মানুষকে ধাতস্থ করে তোলে, এবং ভোঁতা করে তোলে। ধার কমে আসে সংসারের খুঁটিনাটি প্রয়োজনেই।


তিনি চুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে মৃদুলকে ক্রমাগত ক্ষমা করতে থাকেন। আরজু একজন সাধারণ মহিলা , যার পরনের সাধারণ আটপৌরে শাড়ীর আলোছায়া , আগুনের আঁচে গালের লালচে আভা, তাকে ক্রমশ রহস্যময়ী করে তোলে , করে তোলে অচেনা এবং দূরাগত। এক অন্তপুরচারিনীর দুর্ভেদ্য এক দুর্গের মত হেঁশেল কথকতা। সেই দুর্গেশনন্দিনীর রাজত্বে মৃদুল তবু সন্তর্পনে কিছু হাতড়াতে থাকেন, অনুমানে, সাবধানে।


আমার উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, কোনো কিছুকেই বিন্দুমাত্র আমলে না এনে।


মাঝবয়েসী জীবনের ঝিমিয়ে পড়া প্রহরগুলো একধরণের অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায় ঘেরা। স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে পারে, এরকম আচমকা অনুভূতি অহরহ না হলেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। তখন যেন চেনা সাজের ছাপ জলছাপের মতো অদৃশ্য সুতোগুলোকে বড্ড বেশী স্পষ্ট করে তোলে। কথার আগেই প্রতিপাদ্য উপস্থিত হয় প্রকান্ড হাইয়ের ভেতর। বড় বেশী চেনা , বা চিনে ফেলবার অনুভূতি ,যা অনুভূতির জায়গায় খুব বেশী প্রগলভ হতে দেয়না কখনোই। আর অনুক্ত থাকে অন্যদিনের অব্যক্ত আকুলতা , এমন দিনে তারে বলা যায়।


আরজুর রান্নাঘরের জানালার ওপাশের পৃথিবীতে সেই উন্মুখ মুহূর্তে ঝুম বৃষ্টি নামে এই প্রান্তে। আর ও ঘরে সেই আকুলতা অঝোরে স্নান করে মৃদুলের কবিতার পাতায়, ছিঁড়ে ফেলা কাগজের টুকরোগুলোর জঞ্জালে। কে যে কারে ভাসিয়ে নেয় এইবার ! ঈশ্বরের এলাহী আয়োজনে পৃথিবী নীরব হয়ে ভাসে ইলিশ মাছের তেল ঝোলে, কবেকার পুরোনো হয়ে যাওয়া নতুন বৃষ্টির সুরে।


আর আমি চোখ বুজে একমনে নিশ্চিত হয়ে যাই, লুকিয়ে আছি আমি নিশ্চয়ই ,চোখের অগোচরে!


মৃদুলের জীবনে অপ্রাপ্তি অনেক, অজস্র বাতুল প্রসঙ্গের ভীড়ে তার প্রয়োজনের কণ্ঠ প্রায়শই রোধ হয়ে আসে , অস্পষ্ট হয়ে উঠে তার অনুযোগী শব্দচয়নের পারঙ্গমতা। তার না পাওয়া জগতে একা আরজু , অভিমানী আরজু বাস করবেন ,সেটাই প্রত্যাশিত। তবে যা প্রত্যাশিত নয়, তা হলো, তার অবহেলার জগতেও আরজু বাস করেন , বড় বেশি অস্পষ্ট এবং নিরুচ্চার হয়ে। তার সে নীরবতায় বেশ খানিকটা অভ্যস্ত মৃদুল, যা হরহামেশাই ভেঙে যায় অর্থের চাইতেও বেশি দ্যোতনায়। আধখানা সরব স্বর তার, আধখানা নীরব ওমে। প্রচন্ড ব্যথার ভেতর গরম পানির সেঁক নিতে গিয়ে যা মৃদুল প্রায়ই স্মরণ করে হেসে ফেলেন, পুরোপুরি নিজের অজান্তেই।


আজ আমি মৃদুলের কথা বলতে চাই, তবে আরজু বড় বেশি ব্যস্ত। কিছুটা একান্তে সময় তার নিতান্তই প্রয়োজন।


তবে আসুন, ঘুরে আসি, কিছুক্ষনের জন্য , মৃদুলের জন্য রেখে যাওয়া আরজুর গরম ভাতের গন্ধ-ভরা মুহূর্তগুলোকে অব্যাহতি দিয়ে , আরো কিছুদিন পূর্বে, খুব বেশিদিন আগের কথা নয় সেটি।


তখনও আকাশ নীলচে বুক নিয়ে মেঘদঙ্গল নিয়ে ছাপিয়ে যেত, কোনো এক মেঘনাদ কে সঙ্গী করে , আশৈশব স্বপ্নকে অভয় দিয়ে ।


ছেঁড়া পাতার চেৰাপুঞ্জীর বুকে আছড়ে পড়ার গল্প।


তুচ্ছ মুহূর্তের অজেয় কথকতা।


শুনতে কি পাও, শুকনো পাতার খসখসে স্বর ?


ঘুম ভেঙে যাবার পরে ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় প্রয়োজন হয়। নিঃশব্দ রাতগুলো খুব বেশি বর্ণচোরা , কিছু বোঝাতে যাবার আগেই নিশ্চিত হয়ে বুঝে যাই নীরবতার অবশ্যম্ভাবী বর্ণ , বিশদ ব্যাখ্যা সাথে নিয়ে। তা সে আদৌ পোষায় কি না , সে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অমরাবতীর দুধসাগরে মর্ত্যলোকের হাহাকার , চির বিরাজমান শূন্যতা।


শৈশবের কথা বলতে ভালোবাসে, এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। মানুষ ধাবিত দ্রুততায়, গতিতে, আর একইসঙ্গে নিভৃতচারী অনুষঙ্গে, যা কখনো খতিয়ে দেখেনি জীবনের একেকটি মিথ্যে মুহূর্ত সত্যি হয়ে ওঠে কেন।


স্বপ্নপুরের মানসাংকে বাস্তবতার গোঁজামিল ,যা ঠনঠন করে বাজলে আজও বুকে শেলের মত বাজে!


যেদিন আকাশ ছেয়ে যায় ঘন দুর্দান্ত মেঘে , যেদিন কোথাও অতীতের কথা বলতে গিয়ে বর্তমানকে ভুতগ্রস্তের মত ধাবিত দেখি অচেনা কোনো গন্তব্যে,সেদিন ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলতে ইচ্ছে করে , প্রাচীনতম বৃক্ষটির কথা।


আর নিজেকে শুধোতে ইচ্ছে করে , শুনতে কি পাও এইবার , শুকনো পাতার খসখসে স্বর ?


এই শুকনো পাতাটির গল্প সুদীর্ঘকালের , যে রোদের ঝাঁঝালো তেজ , ঝরে পড়া এই শুকনো পাতাটির প্রায় গুঁড়ো হয়ে যাওয়া শরীরের কথকতা, সেই একই রোদ কখনো প্রথম প্রহরে কোমল স্পর্শে ছুঁয়েছিল অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা সালাহ নামের এক যুবককে। সেখান থেকেই আমার কল্পনার শুরু , শুরুটা কেমন ছিল, তারই নাতিদীর্ঘ জল্পনায়।


সালাহ সম্পর্কে আমার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা তেমন কোনো একক বিচ্ছিন্নতার উপসর্গে ভোগেনা , তারা সকলে মিলে একটা বিনি সুতোর মালা হয়ে ওঠে , অবলীলায়। ক্ষুদ্র গল্প গুলো সমগ্রে এক বিশাল মহাকাব্য হয়ে ওঠে , আলাদা করে তখন তাদের চেনা প্রায় অসম্ভব।


তবু সালাহ তার চুলের ভেতর থেকে সূর্যালোককে মুছে ফেলে কখন যেন আমার হয়ে ওঠে। আমার ভেতর থেকে তার জন্য মমতা ঝরে, রাবার গাছের কষের মত। তবে দিনশেষে আমি ঠোঁট কামড়ে আমারই থাকি , নিজেকে যুঝবার জন্য। রবির আলোকে অন্ধকারে খোঁজা যায়না, বড় কষ্ট হয় এখানে আমার। তবু নিজেকে বোঝাই অনবরত , আমার জায়নামাজের জমিনও সেই প্রশ্নে জর্জরিত, জীবনভর। ভালো-বাসার ভালোবাসা। নন্দনতত্বের সৌন্দর্য , যখন শেকল পরানো যায়না।


ভোরের আলো ফোটবার আগেই, অন্ধকারের চাদর মোড়ানো কুয়াশা জড়ানো মুহূর্তগুলো অনেক দিন ধরেই চেনা। ওযুর পানির ঠান্ডা অনুভূতি , জায়নামাজের উদার জমিনও প্রায় বরফ শীতল, তার ভেতর উষ্ণতম মানুষের হৃদয়, আন্তরিকতায় এবং প্রয়াসে। তুচ্ছতম দৈনন্দিন কাজেও স্রষ্টাকে খোঁজবার চেষ্টা চলে, দিনমান, সে উষ্ণতার আঁচেই। বড় সহজ কথা নয় সেটি। যা ভেতর থেকে আসে, তাই ঈশ্বরের জন্য। লোকদেখানো সমাজে তাঁকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব , তার আলোর ধরণই অন্তরালের, নিভৃতচারণের এক অদ্ভুত তাড়না।


নিভে আসা প্রণয়কাল, ক্ষণজন্মা :


আচমকা দমকা হাওয়া এসে সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলে , কোনো কোনো দিন হৃদয় জেগে ওঠে পুরোমাত্রায়। দৃশ্যের অধিক দৃশ্যকল্প, শ্রবণের অধিক সুরের কল্পজগৎ, বর্ণের অধিক আব্ছায়ার জলছাপ। সময়ের পুরো চাদর জুড়ে জীবনের খুচরো শরতের মেঘ , কোন মেঘদল যে পার্থেননের পথে, আর কোন মেঘদল যে অলকায়, তা নির্ণয় করবার সম্পূর্ণ ঐশ্বরিক প্রেরণা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে ইচ্ছে জাগে, সে পুলকের বিভ্রম এতো বিচিত্র আর অমিত! ঈশ্বরের হাতের এক পুতুল চরিত্রের হাতে জেগে ওঠে স্বপ্নরাঙা সুতোর বর্ণিল জাগতিক সম্ভার , ছন্দে মুখর, স্বপ্নে জাগ্রত। সে ছন্দের দোল থেমে যায় , স্বপ্নের কাল দিনের শব্দে আচমকা জেগে ওঠে, তবু থেকে যায় রেশ , ঘোরের ভেতর, আবার কোনো দাহকালের।


আরজু চোখ খুলে তাকালেন। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে এখনো মৃদুলের উঠে যাওয়া শরীরের ওম লেগে থাকা চাদরের সান্নিধ্যে কিছুক্ষন কাটিয়ে দেয়া যায় , ছুটির দিনের বাড়তি আলসেমির আদিখ্যেতার মত,যা নিয়ে আলাদা করে তেমন করে কিছুই বলবার নেই। যে সময়ের যে বাসন্তী বৈভব।


প্রবাস জীবনের আকাশে বাসন্তী পরিচ্ছদ এক বিশাল বিপর্যয়ের নাম। পাশের বাড়ীকে বোঝানোর ক্লান্তিতে যা নিজের মধ্যে বটবৃক্ষকে কেটেছেঁটে রাখা বনসাই প্রাণের মত কোন এক রূপ নেয়। আকাশ সংস্কৃতির ঘর গেরস্থালীতে আর রবির কিরণকে খোঁজ করে লাভ কি ! রবির দিগন্ত রবিবারেই শেষ হয় ঘরে ঘরে, আচারে এবং প্রচারে।


তবে কোনো কোনো দিন তবুও আরজু এবং মৃদুলের হয়ে ওঠা উচিত, তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই । বিধাতা দৃষ্টি দিলেন, দিলেন বিচক্ষণ হৃদয়, তারপর সর্বকর্মার সর্বশেষ ভুলের মত দিয়ে দিলেন ভরপুর আবেগ , যা সকল উপসর্গ-অনুসর্গের ভেতরেও অব্যয় এক মুহূর্তে উথলে ওঠে দুধের পাত্রের সফেন ঘনত্ব নিয়ে , জীবনের আনাচে , কানাচে। গোধুলীবেলায় বাড়ী ফেরবার তাড়া নিয়ে ক্লান্ত পথিকের গায়ে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার মত। এক পাতার খুচরো কড়চা।


আমায় কেউ বলে দেয়নি, তবে এরকম কোনো দিনে বন্ধ জানালার ভেতরে নিরাপদ হতে হতে ভাবতে ভালো লাগে, বিধাতাও ক্ষমা করলেন আমায়, বিধাতার সকল প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাঁর সৃষ্টি মানুষও।


আরজুর জন্য, মৃদুলের জন্য। হয়তোবা আমার জন্যেও। স্বপ্নে বাঁচে যারা , তারাই তীর্থযাত্রী। পিছুটানবিহীন, উদার আকাশের মতো।