ছোট উপহারটা খুবই পছন্দ হয়েছে রাহেলার। একটা ফুলকারী নকশা কাটা , ভেতরে আলোর বাল্ব রাখা যায় , এমনি একটি ছোট বাতি। সুইচ অন করলে একটা নরম আলোতে মন ভালো হতে থাকে , আসলেই মন ভালো হতে থাকে বেশ কিছুটা। খুব সাদা টিউব লাইটের আলো রাহেলার কখনোই ভালো লাগেনি  , নরম  আলোর এই বাতিটা সন্ধ্যেবেলার মত একটা আলোর বোধ ছড়াতে পারে, হয়তো ছড়ায়ও , খুব বেশি বেশি চিন্তা করে মাথা গরম করে ফেলতেও রাহেলার কোনোদিন ভালো লাগেনি , সংসারে চিন্তার শেষ নেই, ইতিমধ্যেই।  পিষতে পিষতে পেশা সম্পর্কে সময় এখন প্রচন্ড তিক্ত , এবং সেই উগ্রতা কিছুটা উগ্র, যাকে উহ্য রাখা সবসময়ে সম্ভব হয়না। প্রচন্ড ভাপে পুড়ে যাওয়া হাতের নীল চামড়ার মতন , ওটা নিয়ে আর যাই হোক আহ্লাদীপনা করা সম্ভব হয়না পুরোপুরি।  


সম শব্দটি শুনলে কি মাথায় আসে তোমার?
সমতা , সম্মান, সম্পূর্ণ।
এই সম শব্দটা সংসারে খুব জরুরী। এই সম যখন অপ নামক কোনো প্রতিস্থাপনের আশংকা জাগায়, তখন সবার আগে নিজের ভেতর খুঁটিয়ে দেখবে। নিজের ভেতর খুঁটিয়ে দেখাটা খুব জরুরী , তোমার নিজের জন্য। নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আসে আত্মবিশ্বাস থেকে।  আত্মবিশ্বাস কিন্তু উচ্চাশা নয় , আত্মবিশ্বাস একধরণের স্বচ্ছতার ধারণা, যা বিশেষত আসে সততার বোধ থেকে।


আমাকে একটা খুব খারাপ কথা বলবার অনুমতি দেবে? রাগটি অনেক পুরনো। আমার জন্য এই রাগ প্রকাশ খুব জরুরী।


কথাবার্তা খুব সুবিধের তো লাগছেনা।  সংক্ষিপ্তাকারে বলতে পারো, মনে হয়।


দুই বছরে প্ৰ,পরা,অপ, সম ইত্যদি কোনো দিকেই দৃষ্টি দেয়া যায়নি।  সম প্রশ্নে সমকামীতার প্রশ্নে দুনিয়া এমন ভাবে কাঁপে যে, সম সূচক কোনো শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায়না।  প্রগতির বিধিবদ্ধ প্রশ্ন কি একমুখী সত্যে লটকে থাকা জরুরী? আমার ছেলের মাঠে গিয়ে ঘুড়ির সাথে আকাশ , অনন্ত, অসীম, নীলাকাশ দেখাটা খুব জরুরী, খুব খুবই জরুরী।


তুমি এমন জটিল প্রশ্ন করো কেন ? তোমার প্রশ্নে আমি পুড়ছি প্রায় !
জানি।  আমরা একত্রে  পুড়ছিনা কেন? জীবনে এতো জটিলতা আনবার তো কোনো প্রয়োজন নেই , আছে কি?


না , নেই।  সত্য কোনো সালিশ সভা নয়, যে চুকিয়ে দেবে, সত্য কোনো হিল্লা বিয়েও নয়, যে এক মুহূর্তে সমাধান দেবে। তুমি আমাকে আমার সত্য বলতে দেবে।  আমার সত্য তোমার কেন? আমার জিহবার দোরগোড়ায় স্পষ্টতর সত্য এসে আটকে থাকে , আমার সবসময় মনে হয় তাকে অনুমতিসাপেক্ষে, বিবেচনায় উত্তীর্ণ।  কেন মনে হয় ?


তুমি বল , তোমার এ ব্যাপারে কি মনে হয় ?
তিক্ততা বাড়তে পারে, এসব  বিষয়ের ব্যাপারে নিরপেক্ষতার বাইরেও বেশি দরকার নিজেকে চেনা , বা নিজেকে জানা।  কেন এসব মনে হচ্ছে, তার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া।  


আমার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, জানো।  দম আটকে আসে, শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। আমি জায়নামাজে দাঁড়াতে চাই, কপালের সেজদার দাগ গুলো প্রমান করলে ভালো, যে  আমার চেষ্টা ছিল, নিজের জন্য।  মানবিক সত্য অনেকটা সবুজাভ বৃক্ষের মত।  মানব চরিত্রের অনেক দিক থাকে , একই ধারণার বাদানুবাদ সর্বত্র কেন ? শিল্পসত্ত্বার যে সত্য কমনীয়, তাকে ক্রিমের মত মাখবে পেলব শরীরে, আর দুয়ো দেবে প্রশ্ন করলে, কেন এতো বিস্তারিত ভাবে নির্ধারিত বিতর্ক , পদে পদে, পলে পলে? তোমার চোখেও তো অশ্রু দেখি।  সে অশ্রু কি মানুষের নয়, বোধের নয় ?
এতো কাঁটাছেঁড়া কেন?


তুমিও তো বলছো ! ক্ষিপ্ত হয়ে , প্রায় খিঁচতে খিঁচতে !
ভীষণভাবে চুলের মুঠি চেপে ধরলো যে !
কে?
বাঁদরের মত একটা সত্য, যে ক্রমাগত চ্যাঁচাতে থাকে যে, ভাবছি কেন এভাবে।  কিছু ভাবার আগেই যদি ভাবনার কায়দা কানুন তৈরী হতে থাকে, তবে খুব মুশকিল হয়, জানো বোধহয়।


ভেবো না, ওভাবে ভেবো না।  অন্যভাবে ভাবো।
এই অন্যভাবে ভাবাটাই তো রপ্ত হলোনা সারা জীবনে ! ভেবে ফুরিয়ে গেলে, কেউ এসে খালি বলছে, ওভাবে নয়, অন্যভাবে ভাবো।


তুমি আমায় শক্ত করে ধরে রাখবে? চুলের ঝুঁটি ধরে না, একেবারে বুকের ভেতর ! আশ্বাসে, বিশ্বাসে এবং এসব অদ্ভুত বোধোদয়ের পূর্বেই? সাতরাজ্য জয় করে ব্যাঙের নাম কেন শিখবো, ব্যাঙ কি তোমায় ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কথা বলে নি?


ঠিক বুঝলাম না।  তুমি কি বিগ ব্যাং থিওরির কথা বলছিলে ?


,না , ঠিক ওসব নয়।  ভেবে ভেবে প্রেমানুভূতি, ওসব কোনো কাজের কথাই নয়! কাজের কথা প্রচ্ছন্নে, যা রেখে দেয়া আস্ত একটা ডিমের ঝোলের মতন, যাতে তোমার কোনো ভাগ নেই, প্রত্যাশাও নেই !


তোমায় আমি এখনই একটা কথা বলতে পারি, যা মেঘের মত, আলোর মত, সূর্যরাগে অস্তরবির মতন।  আমি তোমার জন্য সেখান টাতে দাঁড়িয়ে থাকি, তবুও মৃত্যুর মত একটা হিম শীতল বোধ নিয়ে।  তুমি এলে, তবে তোমার হাই হিলেও ঘষা মেঝেতে জুতোর টক টক করে আওয়াজ তুললো।  মনে হলো তুমি শুধু ছিলে সেখানটাতে, তোমার থাকা যেন আমায় পায়ই নি ! আমি কেন তোমায় মাছের আঁশের মতন বটিতে কুটবো ? তুমি তো এমনিতেই অনেক কষ্ট পেলে ! তোমার চুলে হলুদ ফুল গোঁজার আগে, তোমার চুলগুলোকে শুকিয়ে দিতে পারলাম না কেন বলতো ? আমিও তো পর!


রাহেলা ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলেন।  পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট এলার্ম ঘড়িটা তারস্বরে সময় জানান দিচ্ছে।
তাঁর সারা শরীর ঘামে ভেজা জবজবে, আর কষ্টগুলো ভীষণ রকম চাপা, অনেক ভাবে চাপা।


কেউ যেন স্বপ্নে এসে বলল , ভালো থেকো তুমি।  অনেক অনেক ভালো!