। দায়ী।


সন্ধ্যা নামছে ধীরে, শান্ত তপোবন।
সন্ধ্যাপ্রদীপ ঘিরে বসে পাঁচজন, আহ্নিক সমাপন করে।
বেদ অভ্যাসে থেকে সারাদিন ধরে,
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বসেছেন প্রিয় চার শিষ্যের সাথে ,
ডান পাশে পৈল ও সুমন্ত , বাঁয়ে জৈমিনি , সামনে বৈশম্পায়ন,
গুরুর রচিত ‘জয়’ কাব্যটি হাতে।
  সারাদিনমান গেছে  নিরস সূক্তদের তত্ত্বতালাশে,
ব্যস্ত সময় কাটে  ঋক সাম অথর্ব যজুর বিন্যাসে ,
সন্ধ্যার পরে আর ওইসব আলোচনা গুরুর বারণ।
সে সময় ‘জয়’ পাঠে চারজন করে থাকে  অনিন্দ্য কাহিনীর মধু আহরণ।


হঠাৎই বলেন পৈল, ঋকবেদ-হোতা,
‘ক্ষমা করবেন গুরু দীনের মূঢ়তা,
শেষ অবধি বিনষ্ট হলো এগারোটি বীর বাদে সব ক্ষত্রিয়,
এমন ভয়ঙ্কর সমরকথন নেই কোথাও দ্বিতীয়।
কুরুক্ষেত্রে সেই ভারতবিনাশের দায়  দেওয়া যায় কোন চরিত্রকে? সেকথা স্পষ্ট করে লেখা নেই আপনার আট হাজার শ্লোকে।’


ব্যাস হেসে বললেন, ‘তোমাদের অভিমত শুনি?
দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ শকুনি,
শুধুই এদের জন্য আসেনি বিনাশ, বুঝেছো তা ঠিকই।
তাহলে সে কে ছিলো, নেপথ্য থেকে জ্বালে যে আগুন ধিকি,
বলো দেখি ভেবে। যুদ্ধের দায় খুঁজে কার কাঁধে দেবে?’


বললেন জৈমিনি, ‘আমি তো দোষ দেবো গান্ধারীকে।
প্রতিশোধে বিঁধে দিতে অন্ধ পতিকে,
চক্ষুষ্মতী হয়ে তিনি দৃষ্টিবিমুখ,
নাহলে বুঝতেন ঠিক, শুরুতে বিনষ্ট হতো ঈর্ষা অসুখ।’


‘প্রতিশোধ?’চমকে বললেন  সুমন্ত,
‘পতিপরায়না তিনি, প্রতিশোধী নন তো!’
মৃদু  হাসলেন জৈমিনি ,
‘তাহলে চোখ না বেঁধে স্বামীর দৃষ্টি হয়ে বাঁচতেন তিনি,
আলোর পৃথিবীর যাবতীয় অনুভব তবে ধৃতরাষ্ট্রের হতো না অধরা, অন্ধের সাথে পরিণয়ে যেই অন্যায়, তার প্রতিশোধে ওই চোখে পটি পরা।’


‘তাহলে তো ভীষ্মই দায়ী! মুখ খুললেন বৈশম্পায়ন।
যখন চেয়েছে তাঁকে কুরুসিংহাসন,
এড়িয়ে গেছেন দায়।
যোগ্য পুরুষ ছেড়ে বিচিত্রবীর্য রাজা, রাজ্যের সাথে সেটা ঘোর অন্যায়।
ভাই মারা গেলে, কেন তিনি বিয়ে করে নিজেই নেননি তুলে শাসনের ভার?
ক্ষমা করে গিয়েছেন দুর্যোধনের ভুল, কখনো টানেননি রাশ তার স্পর্ধার।’


‘সে ক্ষেত্রে তো দায়ী করে যায় আমাদের গুরুকেই।’
পৈলের অভিযোগ শুনে আর কারো মুখে কথা নেই,
দৃষ্টিরা ঘুরে গেছে মহর্ষির দিকে।
মৃদু হেসে ব্যাস বললেন,’জেনেশুনে ঔরসে জন্মাতে দিয়েছি দুই প্রতিবন্ধীকে,
সেটাই বলবে জানি।
তাতে আমি কেন হতে যাবো বলো অভিমানী,
জয়ের চরিত্র ব্যাস আমারই কল্পনা বটে, তবে আমি নই।
আজ থেকে সহস্র বছর পরে যাতে লোকে মনে রাখে, কে লিখেছে বই,
তাই ওকে করেছি সৃজন।
হতে পারে, তোমরা খুঁজছো যাকে ব্যাসই সেই জন।’


‘না গুরুদেব, দায়ী অন্য অস্ত্রগুরু, মহাবীর দ্রোণ।’
বললেন বৈশম্পায়ন।
দ্রুপদের প্রতি তাঁর  প্রতিশোধ নিতে,
যে মূল্য বললেন দক্ষিণা দিতে,
তারই অপমান থেকে জন্ম যাজ্ঞসেনীর ।
তাঁকেই কেন্দ্র করে তাবত যুদ্ধকথা এই কাহিনীর।’


‘যুধিষ্ঠির নন কেন? সুমন্ত স্পষ্টত এতে অসম্মত।
পাশাতে অমন বাজি নাই যদি হতো,
যদি অভিসন্ধি বুঝে ফেলে যদি উঠে আসতেন  ঘুঁটি ফেলে ছুঁড়ে, দূরত্ব থেকে যেতো  ইন্দ্রপ্রস্থ আর হস্তিনাপুরে ।’


‘তাহলে তো কুন্তীই দায়ী হন ভাই !
বক্তা জৈমিনি, যজুর্বেদ-জ্ঞানী, তিনিও উত্তেজিত যারপরনাই। শতশৃঙ্গ থেকে হস্তিনাপুর আসা ছিলো শুধু আশ্রয় চাওয়া  না সিংহাসনের দাবীতে?
অবদান কম নয় তাঁরও সেই যুদ্ধের ভিত গড়ে দিতে,
কর্ণ নিপাত করা মাতৃস্নেহের অছিলায়
অথবা দ্রৌপদীকে বন্টন করে দেওয়া পাঁচটি ভ্রাতায়, 
তাঁর ক্ষমতালীপ্সার কথা করছে প্রমাণ।’


আর কৃষ্ণ? বললেন পৈল। যুদ্ধের দায় তিনি কিভাবে এড়ান?
কর্ণের পরিচয় যুধিষ্ঠিরকে দিলে,
তাঁকে রাজা মেনে নিতো দুপক্ষ মিলে,
বরং বিপরীতে গিয়ে তিনি ধনঞ্জয়কে টেনে নামান সমরে,
ত্রিকালদর্শী তিনি, ধ্বংসের দায় তাই তার ওপর পড়ে।’


‘তোমরা জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ, বেদ বিভাজন করো তর্কাতীত দক্ষতাতে।
তবু নও একমত কেউ কারো সাথে, 
কাব্যরচয়িতার লক্ষ্য সফল হয়েছে তবে। এ আমার নিশ্চিত শ্রেষ্ঠ রচনা।’
বলে থামলেন ব্যাস। শিষ্যরা থামালেন গূঢ় আলোচনা,
সবিনয়ে ব্যাসকেই প্রশ্ন করেন চারজনে,
‘যুদ্ধের দায়ী বলে আপনি  ভাবেন কাকে মনে?’
হাসলেন ব্যাস ।’ওরা সকলেই, এবং আরো অনেকে।
যুগ থেকে যুগ যেন পড়ে লোকে শেখে,
একার কারোর নয় ধ্বংসের দায়।
সমকালে যারা কুশীলব,সকলের ওপরে সে দায় বর্তায়।’


একটা প্রদীপ ঘিরে চুপ পাঁচজন। ভাগীরথী কুলুকুল করে বয়ে যায়।


আর্যতীর্থ