। একদিন বিদ্যাসাগরে।


‘উঠুন, বিদ্যাসাগর এসে গেছে’
চটকা ভাঙালেন পাশের যাত্রী হাঁউমাঁউ বোলে।
বলেছিলাম নামবো, বাঘাযতীন পেরিয়েই, তাই উপকার।
তড়িঘড়ি নেমে যাই, ব্যস্তবাগীশ এক পুর-অঞ্চলে।


ছমছমে সন্ধ্যা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, পথ শুনশান,
কোথায় এলাম? কোন কলকাতা?
বাতি নেই, অনেক ওপরে চাঁদ আলো দেয় কিছু,
কেউ নেই.. নাকি আছে, একজন বেঁটে মতো,
সামনেই হেঁটে যান, হাতে খোলা ছাতা।


দাদা, শুনবেন? বিদ্যাসাগর এটা?
সেখানে যাওয়ার ছিলো, বুঝছিনা এজায়গা কিনা,
লোকটি থামলেন। কাছে ডেকে বললেন হেসে,
অতই সহজ নাকি, সাগরকে পাওয়া যায় সন্ধান বিনা?


আঁধারে ঢেকেছে মুখ, পরনে ধুতি ও পিরান,
মনে হয় স্বদেশী নাটকের পরে সে পোশাকে ফিরছেন ঘর।
কিঞ্চিৎ ছিটিয়াল নির্ঘাত, তা নইলে এমন জবাব!
রাস্তায় আর কেউ নেই, অগত্যা এই আমি তিনি-নির্ভর।


তিনি বললেন, ইতিহাস জানো? বিদ্যাসাগরের কথা?
‘ সে আর কে না জানে, বিধবা বিবাহ, মেয়েদের শিক্ষা,
তারপরে ধরুন, ওই মাইকেলকে উৎসাহ, সংস্কৃত কলেজ,
আরও টুকিটাকি আছে, এখন আর নেই মনে ঠিক তা।


পাশাপাশি হাঁটছি। তিনি হনহন, আমি প্রায় জগিংয়ের মতো,
কি জোর পায়ে! তিনি থামলেন, গনগনে স্বরে বললেন আর তারপর?
খুব ভেবে বলো দেখি,  মেয়েদের কতদূর যেতে দেয় এ স্বাধীন দেশ,
রঙ রূপ গৃহকর্মে নিপুণা দিয়ে খুঁজে দেওয়া মনোমত বর,
তার বেশি কিছু চায় আধুনিক যুগ? বিধবা অসহায় হলে,
বিয়ে তো দূরস্থান, নিজের কাছের লোকও সমব্যথী হয়?
লোভের লালায় বিষ, গিলে নিতে চায় তারা বিষয় ও নারী,
সে লোকের ভাবনাকে মান্যতা দিয়েছে কি এখনো সময়?


আমি ঢোঁক গিলে বলি, তা ঠিক নয়, সব হবে। ঠাকুর চাইলেই..
‘ আবার ভড়ং!’ ওইটুকু চেহারায় অত গর্জন, না দেখলে বিশ্বাস হতোনা।
‘ ধর্ম মানুষ শুধু পেছনে ঠেলেছে, পৃথক করেছে স্রেফ জন্মের দায়ে,
মানুষের কাজগুলো পচে হেজে যায় লেগে ধর্মের চোনা!
শোনো হে অর্বাচীন, ঈশ্বর বলে যদি থাকেনও কেউ কোনো অধরা-তে,
তাঁর কিছু যায় আসেনা মানুষ নষ্ট হলে।অবশিষ্ট জগৎ তো আছে,
তোমরা এখন যার কাজ ভুলে গেছো, তার নামও ঈশ্বর ছিলো,
অথচ ধর্ম ফেলে, শত অপমান সয়ে গিয়েছিলো সে লোকটা মানুষের কাছে।’


এতক্ষণ কথা হলো, নাম জানিনি এখনো। বুঝছি না কোনখানে নেমে পড়েছি,
সময় যাচ্ছে বয়ে। গলা খাঁকরিয়ে বলি, ইয়ে মানে , জানেন বিদ্যাসাগর  কোথায়?
হা হা করে হাসলেন ছোট্ট মানুষ । ‘ আমারও তো প্রশ্ন সেটাই,
মূর্তিকে ভাঙো গড়ো,
আসল মানুষটার তাবত স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছো,আজও বাঁধ দিয়ে আছো তার ইচ্ছায়।’


বলতে বলতে কি যেন হলো। মানুষটা আরো জোরে হনহন করে হাঁটতে থাকলেন,
এগিয়ে যেতে থাকলেন অনেক, অনেক আগে। বাঁকে মিলিয়ে যাওযার আগে.
চেঁচিয়ে বললেন, পারো যদি ভেবো আমি যা ভেবেছি উনিশ শতকে,
ওহে একবিংশ! মানুষের ওপরে এখনো ভরসা রাখতে বড় সাধ জাগে!


চকিতে রাস্তা জুড়ে অটোর হর্ণ, বাসের কালো ধোঁয়া, নিস্পৃহ ভিড়,
আর পথের মধ্যে মলিন নিরাসক্ত ঈশ্বর মূর্তি। আমি বিদ্যাসাগরে দাঁড়িয়ে,
ভাবছি কে ছিলেন উনি। যেই হোন,কথাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছে,
দুশো বছর ছুঁই,
তবু তাঁকে শুধু বর্ণপরিচয়ের ছবিতে আটকে রেখেছি, আসল শিক্ষাগুলো গিয়েছে হারিয়ে।


ভোরের স্বপ্নের মতো একঝাঁক স্কুলের কিশোরী, খিলখিল হেসে হেসে যায় পথ দিয়ে...


আর্যতীর্থ