। হাজার হাত।


‘আমায় ডেকেছো কন্যা?’ দরজার বাইরেতে বললেন যিনি,
তিনি মহাভারতকার, কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাস। দূতমাধ্যমে তাঁকে রাণী যাজ্ঞসেনী,
পরমভক্তিভরে আহ্বান করেছেন আজ পাণ্ডব অন্তঃপুরে।
যুদ্ধের অবসানে ঘন কুয়াশার মতো শোক থিতু বেঁচে থাকা সব মন জুড়ে,
দ্রৌপদীর পিতা ভ্রাতা, পাঁচ সন্তান সকলে জীবিত ছিলো কমাস আগেই।
এখন রয়েছে বৈভব, দাস দাসী, রাজসিংহাসন। শুধু তা দেখার কোনো হাসিমুখ নেই।


‘আমায় ডেকেছো বাছা?’  বাইরে বেরিয়ে এসে পাদ্য অর্ঘ্য দেন রাণী দ্রৌপদী,
‘আসুন ঋষিশ্রেষ্ঠ। আপনার বিরচিত ‘জয়’ কাব্যটি এসময়ে শোকের ওষধি,
রোজ পাঠ করি আমি । কিন্তু মহাত্মন, দ্যূতক্রীড়া পর্বটি একেবারে নয় যথাযথ
কেন সেটা বুঝতে পারিনি। আপনি ত্রিকালদর্শী, সত্য জানেনা কেউ আপনার মতো,
আপনি জানেন সেই কঠিন সময়ে, কী ঠিক হয়েছিলো বস্ত্রহরণে।
বাসুদেব বহু দূরে, প্রশ্নই নেই তার সভাতে আসার সেই দিন। আপনি জানেন ঋষি, হাজার হাতের শাড়ি কিসের কারণে।’


ব্যাস নিরুত্তর। লেখবার পর থেকে তার ভয় ছিলো মুখোমুখি হতে কৃষ্ণার,
চিরকাল স্পষ্টবাদিনী তাঁর প্রপৌত্রবধূ। স্বভাবত সত্যের বিকৃতি সহ্য হবেনা সেই অপমানিতার,
কিন্তু কি করেন তিনি! হাজার হাতের শাড়ি যে  সম্ভ্রম বাঁচিয়েছিলো পাণ্ডবপত্নীর, সেটা বাস্তব,
ব্যাস সেটা লিখতে পারেননি বলে অগত্যা অলৌকিকে ত্রাতা হয়ে গেলেন কেশব।
ধরা পড়া সজ্জন ব্যক্তিমাত্রেই না জানার ভান করে, মহাঋষি ব্যাসও তার ব্যতিক্রম নন,
আজ তাই অবাক হওয়ার ভানে বিপরীতে প্রশ্ন করেন, ‘ বলো বৎসে তবে , কি ঘটেছে আসলে তখন!’


‘আপনি জানেন মহামুনি । পাশা খেলেন মাতুল শকুনি, কর্ণ দুর্যোধন হাসে প্রতি জয়লাভে,
যুধিষ্ঠির দাস হয়েছেন, শৃঙ্খল পরানো তার পায়ে। একথাও ভুলেছেন লিখতে কোনোভাবে,
শৃঙ্খল না পরালে সেই দিনই রাজসভা তছনছ করে দিতো বাকি চার স্বামীরা আমার,
অতটা মূর্খ নয় দুষ্ট চতুষ্টয়, ওঁদের না বেঁধে নিয়ে সাহস করবে ছুঁতে কেশ কৃষ্ণার।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ব্যাস করলেন মাথা নিচু। তারপর বললেন , ‘আসলে জানো তো মা,
দুদিকেই ছিলো প্রপৌত্র আমার। অতটা ধূর্ত ওরা জেনেও স্নেহতে করেছে বুড়ো কিছুটা ক্ষমা।’


‘তা বলে বস্ত্রহরণে সত্যের অমন অপলাপ? আজও মনে পড়ে সেই ভয়ানক দিন,
রজস্বলা একবস্ত্রা সভায় একলা আমি । দুঃশাসন বাড়িয়েছে হাত,
সভায় সবার সামনে আমাকে করবে বস্ত্রহীন,
দুর্যোধন, শকুনি কর্ণের লালাঝরা দৃষ্টি কামুক, অধোবদনে বসে অসহায় কুরুবৃদ্ধরা..
হঠাৎই হুংকার হলো বামাকণ্ঠে। রাজবধূ ভানুমতী, সাথে দুঃশলা
হাঁক দেন ‘কই গেলি তোরা!’
অমনি অন্তঃপুর থেকে যত কৌরবের রমণীরা বেরিয়ে এলো সেই নারীহীন রাজার সভাতে,
‘ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখো হে দেওর’, গর্জান ভানুমতী, ‘আমরাও খুলে দেবো শাড়ি সাথে সাথে! ‘
মুহূর্তে হাত গোটালো দুঃশাসন, চোখ ফেরালো কর্ণ, অধোবদন হলো দুর্যোধন শকুনি,
রাজা ধৃতরাষ্ট্রেরও ফেরে সম্বিত।হাজার নারীর সেই হাজার শাড়ি
আমাকে বাঁচিয়েছিলো মুনি,
সেই অনন্য প্রতিবাদ বাদ দিয়ে হঠাৎই কেন আপনার কাব্যে কৃষ্ণ বাঁচালো কৃষ্ণাকে?
বাসুদেব বন্ধু আমার, বিখ্যাত কীর্তিধর দ্বারকাধিপতি, তাই বুঝি দেবতা বানিয়ে দেন তাঁকে? ‘


ব্যাস নিশ্চুপ। পুরুষের সমাজে নারীই বাঁচালে নারী, কাহিনী যে কেউ শুনবে না।
তারা চায় প্রতিটি নারীর যেন রক্ষক থাকে।


সেটা বলা যায় নাকি এই কন্যাকে?


আর্যতীর্থ