। কবির গল্প।


‘বাহাত্তর সালে লেখা আপনার কবিতা
সেদিন একজন আবৃত্তি করলো!’


বৃদ্ধ কবির চলন এখন স্থবির, কানেও শোনেন কম,
তবু এ কথা শুনে মুখে আলো জ্বললো।


‘কোথায়?’


‘ওই যে , যেখানে আন্দোলনের ওপর পুলিশ ছুঁড়লো জলকামান,
টিয়ার গ্যাসে দিশেহারা ছত্রভঙ্গ মিছিল,
ওদিকে ক্রমশ স্থির হচ্ছে রাইফেলের টার্গেট, এদিক থেকে ছোঁড়া অবিশ্রান্ত ঢিল,
সেই বিস্রস্ত সন্ধ্যায় এতরফ বা ওতরফ কারো একটা মেগাফোনে
এক যুবক হঠাৎ  বলে উঠলো আপনার কবিতা।’


‘তারপর? কবি শুধোলেন উদগ্রীব স্বরে,
‘ খুঁজে পেলো মানুষ কি সেই বার্তা,
যা বলে চলেছে আজও দগ্ধ অক্ষর?
কিছু কি বদল হলো পুলিশে মানুষে সেই কবিতার পর?’


‘হলো তো! মন্ত্রের মতো আপনার কবিতা আওড়াতে শুরু করলো ততক্ষণ পর্যন্ত উদভ্রান্ত জনতা।
প্রথমে ছাত্ররা, তারপর শ্রমিক আর চাষী, শেষ অবধি গৃহবধূ আর নাবালকেরা বলে উঠলো আপনার কথা,
আপনার বাহাত্তরে লেখা শব্দেরা দুহাজার কুড়ির সন্ধের রোদ মেখে মশালের মতো জ্বলে উঠলো,
আর ঠিক তখনই.. ‘


‘তখনই কি?’


‘তখনই প্রথম কার্তুজটা ছুটলো।
তারপর আরো,  কবিতার যতিচিহ্নের মতো চারদিকে অনুরণন হতে থাকলো,
গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম....
আর অবিকল আপনার কবিতার মতো কারো বুকে , কারো মগজে সেঁধোতে লাগলো,
অথচ আপনার প্রজ্ঞার প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা কারো পা ছুঁলো না!’


স্নায়ুশিথিলতা ভুলে কবি উঠে বসেন।
কত অশ্রুর জলে সাগরেরা লোনা, মনে মনে হিসেব কষেন,
অন্তহীনের কি হিসেব হয়?
টিক টক টিক টক.. ঘড়ি বেয়ে পেরোয় সময়,
ফিসফিসে কবির জিজ্ঞাসা,
‘তাহলে কবিতা শেষ? রক্ত ও লাশে মাখা এই যুগ থেকে শুধু প্রাপ্য হতাশা?’


‘কে বলেছে শেষ? ওরকম সমাপ্তি বলতে আসিনি আজ।
খুন হওয়া মানুষের চারপাশ থেকে ,
বেঁচে না বাঁচা মানুষের দল
মরে মুছে যাওয়া মানুষের দল
কখনো না জেতা মানুষের দল
আজন্ম চুপ থাকা মানুষের দল
আপনার কবিতাকে কন্ঠে জ্বালিয়ে নিয়ে তুললো আওয়াজ।
সেই প্রলয়ের ডাকে ট্রিগারের আঙুলগুলো কেঁপে উঠলো ভয়ে,
নীরব হয়ে গেলো ওয়াকি টকির নির্দেশ..
আর লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি কন্ঠে দাবী নয় , ঘোষণা ভেসে এলো ..
‘ এটা আমার দেশ, এটা আমারও দেশ, এটা আমাদের দেশ!’


কবি হাসলেন।
যুদ্ধের  শেষে রণক্লান্ত সেনাপতি যেমন হাসেন।
তারপর,
কাঁপা কাঁপা আঙুলে অক্ষর বুনে দিতে তুলে নেন পেন।


আর্যতীর্থ