সাত সমুদ্দর তের নদীর অপারের এক দেশে
জনম থেকে তিরিশ বছর কাটায়েছি কেঁদে হেসে।
সেই সে মধুর দেশ
জন্মভুমি, মাতৃভুমি, আমার বাঙলাদেশ।


সকাল হলে ডালে ডালে পাখির কলতান
দূরমসজিদে মোয়াজ্জিনের সুমধুর আদান।
গাছে গাছে রঙ বেরঙের ফুটতো কত ফুল
কুড়ায়ে কুড়ায়ে দিয়েছি গলে পরেছি কানে দুল।
বনের লতায় গেথেছি মালা নানারঙের ফুলে
পরায়েছি কত জানা অজানা সাথীদের গলে গলে।
বটবৃক্ষের পাতায় বানানো পাগড়ি মাথার পর
কখনো সেজেছি বনের রাজা, সেজেছি কখনো বর।
গড়েছি কত তির-ধনুক আর খেলার উড়োজাহাজ
করেছি কত মন গড়া খেলা কিংবা অকাজের কাজ।


লেখা পড়ায় ফাঁকি দিতে খোঁজেছি অদেখা বন
সারাদিনমান কয়েছি কথা কতশত অগনন।
শুনায়েছি ব্যথা বনের লতা শুনেছে মন ভরে
শাষায়েছি তবু কখনো সখনো লতার কানটি ধরে।
শিখায়েছি কত আজব শিক্ষা কঞ্চি হাতে নিয়ে
ক্ষত বিক্ষত করেছি আবার বেজাবিত মার দিয়ে।
ক্ষিধা মিঠায়েছি বনের মাঝে কতনা মধুর ফলে
জমাট বাধা পুকুরের পানি গিলেছি তৃষ্ণা হলে।


আকাশেতে মেঘের খেলা বাতাশে মধুর গান
খরা রোদে বনের ছায়ায় জুড়ায়েছে মন প্রাণ।
চক্ষু জড়িয়ে নিদ এসেছে অলস দুপুর হলে
ঘুমিয়ে গেছি সবুজ কমল ঘাসে ভরা জঙ্গলে।
পাখির কূজন, বায়ু শনশন পাতার মর্মধ্বণী
বনের আড়ালে মাতাল চক্ষে নিদ্রা এনেছে টানি।
ফুলের গন্ধ, ফলের গন্ধ, মাটির গন্ধ শ্বাষে
পলে পলে মোরে টেনে নিয়েছে সুখ স্বপ্নের দেশে।
যেন স্বর্গবাস
সুখে আর সুখে কাটিছে কত দিবস রজনি মাস।


মায়ের বকুনি বাবার শাষন কিছু নেই আর মনে
স্মৃতিতেো নেই আমি যে অবেলা শুয়ে আছি তপুবনে।
ধড়াৎ মড়াৎ শব্দশুনে ভাঙিল যখন ঘোম
ধড়ধড় বুকে চেয়ে দেখেছি চারিদিগ নিঃঝুম।
পশ্চিমাকাশে অস্ত রবি ! স্মৃতিতে ভেসেছে ঐ
ফাঁকির মাঝে পড়িনি ধরা! রয়েছি আমি কই?
তড়িঘড়ি করে ফিরিনো ঘরে , চুপি চুপি পিছ দ্বারে
কান পেতেছি শুনবো বলে বাবা আছে নাকি ঘরে।
জপিছি মনে কতনা কিছু যদি পাছে পড়ি ধরা
কি বলে আজ রেহাই পাব কেমনে পাব ছাড়া।


কপালটা কভু মন্দ হলে যা কপালে ঘটে
আমার বেলা তাই ঘটিল সত্যি কিন্তু বটে।
আমার ছোট্ট ভাই-
কেমন করে দেখে ফেলেছে আমি তারে দেখি নাই।
'ভাই এসেছে, ভাই এসেছে' দিল জুরে চিৎকার
হায়রে কপাল; কেমন করে বাঁচি বল এইবার!


সারাদিনমান ধান বুনে বাপ ফিরিছে ক্ষণিক আগে
পুরোটা গতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে  কাদাঘাম আছে লেগে।
রোদেপুড়ে ঘামে ভিজে মেজাজ হয়েছে কড়া
কাছে ডেকে নিয়ে হাতের ছড়িতে দু' ঘা দিল কড়া।
জল্পনা আর কল্পনা সব নিমিষে হইলো মাটি
মার খেয়ে খেয়ে বাপের কাছে শতবার তওবা কাটি।

মা ছিল পুকুর পাড়ে
কান্না আর চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে ধারে।
' আর মেরনা' বলিয়া আমায় ঘিরিয়া লইলো বুকে
কতনা আদর কতনা বিষাদ দেখা দিল তার মুখে।
হাত ধরে মা টেনে নিয়ে যায় শান বাধানো ঘাটে
সিনানে নামায়ে গা মাজে আর কতনা কথা আটে।
কোমর পানিতে নামাইয়া মোরে বলিল-'বাবা যা
হাতে ধরে তাড়াতাড়ি করে ডুব দিয়ে ধো গা'।


কোমর পানিতে যদিও ছাড়িলো, ছাড়েনিকো মোর হাত
যদি কাজা হয় পাছে ডুবে মরি; এইতো মায়ের জাত।
আঁচলেতে গতর মুছিয়া বলে-'আয় ভাত খা;
কোন দিন আর স্কুল কামাই ভুলেও  করিসনা।
তো'দের পানে চাহিয়া আজ বেঁচে আছি দুনিয়ায়
অবলা এই মায়ের দুঃখ কে আর দেখিতে পায়।
গরিবের কুলে জন্ম ত'দের, গরিবেরই সন্তান
গণ্ড মূর্খ হইলে কেমনে বুঝিবে ব্যথার দান।
এই দুনিয়ায় গরিব যারা তারাই গরিবের ভাই
গরিবে গরিবে গরিবের বুকে গরিবরে দিয়েছে ঠাই।
বিদ্যা জ্ঞাণ কর আহরন নইলে যে সংসার
লাঙলের ফলায় কষিয়া কষিয়া হইবে সংহার।
বাপেরে তোমার চিননি বাচা গন্ডমূর্খ নয়
পুঁথি কেতাব অনেক পড়েছে; পুরাতন লোকে কয়।
তোমার দাদু সেকালের নাকি দ্বিতীয় শেরেনি পাশ
তিন গেরামের সব লেখালেখি করিতেন বরোমাস।
কত সন্মান কতনা গৌরব বাধা আছে এই ঘরে
বান্দে বান্দে গিথিয়া আছে কইতে মনটি ভরে।
ধন সম্পদ চায়নিকো কেউ কুড়েছে মান ইজ্জৎ
দুঃখ কষ্ঠ বুকে ধরেও কেউ ছাড়েনিকো হিম্মত।
সেই ভিটা্রই তোমরা বাতি আশা ভরষার ধন
তদের দিয়ে স্বপন দেখেছি কতশত অগনন।


এই বলে বলে মায়ের চোখে গড়ায়ে পড়িল জল
ব্যথার আকাশে জমানো মেঘ যেন হলো চঞ্চল।
সইতে পারেনি কইতে গিয়ে জীবনের শত দুখ
পাহাড় সম ব্যথা বুকে লয়ে আঁচলে ঢাকিল মুখ।
ব্যথা বেদনা বিষাদ ভরা জীবনের কত কি
দু' চোখের জলে ভিজায়ে মা আঁচলে রেখেছে মাখি।