ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৬, ভাগ-৫২> – ছন্দের আকৃতি বা রূপভেদ  
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ - মহাপয়ার ও প্রবহমান মহাপয়ার
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি মো ফিরোজ হোসেন মহাশয়কে।          
------------------------------------------------------------------------------
মহাপয়ারঃ
অক্ষরবৃত্ত রীতিতে রচিত ৮ ও ১০ মাত্রার দুই পর্বের চরণযুক্ত, চরণান্তিক মিল সমন্বিত দুই চরণের যে স্তবকবন্ধে প্রতি চরণান্তে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে, তাকে বলে মহাপয়ার।
বৈশিষ্ট্য-
ক) মহাপয়ারে থাকে দুটি চরণ;
খ) দুই চরণে থাকে অন্ত্যমিল;
গ) প্রতি চরণে থাকে ৮ ও ১০ মাত্রার দুটি পর্ব।
ঘ) প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে;
ঙ) মহাপয়ার অক্ষরবৃত্ত রীতির ছন্দ।
যেমন-  
“সারাদিন বাজাইলি বাঁশি ওরে তুই ওঠ আজি
আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি”


প্রবহমান মহাপয়ারঃ
অক্ষরবৃত্ত রীতিতে রচিত ৮ ও ১০ মাত্রার দুই পর্বের চরণযুক্ত যে ছন্দ-বন্ধে ভাব চরণান্তে আংশিক বা সামগ্রিক প্রকাশিত না হয়ে পরবর্তী একাধিক চরণে স্বচ্ছন্দে প্রবাহিত হয়, তাকে বলে প্রবহমান  মহাপয়ার।
বৈশিষ্ট্য-
ক) প্রবহমান মহাপয়ার অক্ষরবৃত্ত রীতির ছন্দ।
খ) এর লয়, মাত্রাগণনা পদ্ধতি প্রভৃতি এই ছন্দের নিয়মানুসারী।
গ) প্রতি চরণে থাকে ৮ ও ১০ মাত্রায় মোট ১৮ মাত্রায়।
ঘ) চরণে ৮ মাত্রায় হ্রস্বযতি, ১৮ মাত্রায় পূর্ণযতি।
ঙ) প্রবহমান মহাপয়ারে ছেদস্থাপনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
**প্রবহমান মহাপয়ার আবার দুই প্রকারের-
১) অমিল প্রবহমান মহাপয়ার
যেমন-
“বসন্তে আহ্বান এল অস্ত্রে অস্ত্রে প্রতিরোধ করো
তড়িতে আঘাত তীক্ষ্ণ অব্যর্থ সন্ধানে হানো দেখি
শীতের তুষার ক্ষয়ে-“
২) সমিল প্রবহমান পয়ার
যেমন-
"নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াবে বিচারের আশে
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে”


**কিন্তু কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর 'কবিতার ক্লাস' গ্রন্থে বলেছেন - "পয়ার বলতে সত্যিই কোনও ছন্দ বোঝায় না, পয়ার আসলে একটা বন্ধ মাত্র, এবং সেই বন্ধে যেমন অক্ষরবৃত্ত, তেমনই মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের পঙক্তিকে বাঁধা যেতে পারে। অনেকেই বেঁধেছেন।" আবার মহাপয়ার বিষয়ে বলেছেন- মহাপয়ারের নামেই প্রমাণ, ওটি আর কিছু নয়, পয়ারেরই একটা বড়ো সংস্করণ।" এটিও তিন ছন্দে লেখা যায়।
তিনি উদাহরণ দিয়েছেন এভাবেঃ
অক্ষরবৃত্তের মহাপয়ারঃ
নিম্নে সারাদিন দেখি আদিগন্ত সমুদ্র সুনীল
ঊর্ধব শ্বেতবিন্দু সম উড়ে যায় দুটি গাংচিল।
মাত্রাবৃত্তের মহাপয়ারঃ
নীচে আদিগন্ত-যে চঞ্চল সিন্ধু সুনীল
ঊর্ধবে মেলেছে ডানা সুন্দর দুটি গাংচিল।
স্বরবৃত্তের মহাপয়ারঃ
যোজন যোজন দেখছি শুধু নীলের খেলা সমুদ্দুরের জলে
ঊর্ধবাকাশে পাল্লা দিয়ে শুভ্র দুটি সারস উড়ে চলে।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা ছন্দঃ রূপ ও রীতি – মিহির চৌধুরি কামিল্যা
                      ২) বাঙলা ছন্দ – জীবেন্দ্র সিংহরায়
                      ৩) কবিতার ক্লাস- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।